Image description
শহীদুল্লাহ ফরায়জী

 

একজন প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জনসমক্ষে জুতার মালা পরানো—এটি নিছক কোনো ব্যক্তি-অপমান নয়, বরং সমাজে বিদ্যমান প্রতিহিংসার নৃশংস চর্চা এবং মানবিক মর্যাদা ধূলিসাৎ করার প্রয়াস।

 
 

একজনের উপর হিংস্রতা চালিয়ে কি সত্যিই আমাদের অভ্যন্তরের বিচারের ক্ষুধা মেটে, নাকি এটা আসলে আমাদের নৈতিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ! এই ধরনের ঘটনা আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার গভীর সংকট এবং প্রতিশোধপরায়ণ সামাজিক চেতনাকেই তুলে ধরে। এটা কোনো বিচারেই বিচারের প্রতীক নয়, বরং প্রতিশোধের উৎসবে রূপ নেওয়া এক নিষ্ঠুরতার সংস্কৃতি। ব্যক্তিকে অপমান করে সমাজ যেন নিজেই নিজেকে নগ্ন করে ফেলছে; এখানেই প্রশ্ন জাগে—আমরা কী ধরনের নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বিচারবোধের উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছি? আমরা কোন পথে এগোচ্ছি—ন্যায় ও সংবেদনশীলতার পথে, নাকি প্রতিশোধ ও অবমাননার চোরাবালিতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজে আমরা যদি কেবল প্রতিপক্ষকে লাঞ্ছিত করেই আত্মতুষ্টি পাই, তবে একদিন আমাদের বিবেকও লাঞ্ছনার পরিণতি ভোগ করবে।

সবচেয়ে করুণ সত্য হলো—পৃথিবীর অধিকাংশ অশুভতার সৃষ্টি করে তারাই, যারা কখনোই স্থির করেনি তাদের কী হওয়া উচিত, ন্যায়পরায়ণ নাকি অন্যায়কারী। এই নৈতিক-উদাসীনতা আমাদের সমাজের গভীরে যে-অবক্ষয়ের জন্ম দিয়েছে, আজকের অপমান-সংস্কৃতি তারই নিছক বহিঃপ্রকাশ।

এটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন প্রতিক্রিয়া নয়; এটি আমাদের বিচারবোধ, শিষ্টাচার এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে এক প্রতীকী বিদ্রোহ। গণতান্ত্রিক-প্রতিবাদ কখনোই অবমাননার সমার্থক নয়—বরং যেখানে যুক্তি ও নীতির অবসান ঘটে, সেখানেই অপমানের উন্মত্ততা জন্ম নেয়। যেখানে যুক্তি নেই, নীতি নেই, সেখানে অবমাননা এসে দাঁড়ায় বেপরোয়া অস্ত্র হয়ে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে—এই আচরণ আমাদের সামাজিক অবদমনের কুফল। যখন দীর্ঘদিন ধরে একটি রাষ্ট্রে বিচারের পথ রুদ্ধ থাকে, আইন ন্যায় দিতে ব্যর্থ হয়, ভয়ঙ্কর অন্যায়কারী সম্মানের জায়গা দখল করে নেয়, তখন জনমানুষের ভেতরে জমে ওঠে এক অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ, যা একসময় ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ভাষায় বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু এই উত্তাল ক্ষোভ গন্তব্যহীন। এর ফলে যেমন ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় না, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য কোনো গঠনমূলক দৃষ্টান্তও  গড়ে ওঠে না। বরং আমরা এমন এক সমাজে পরিণত হই—যেখানে সম্মান নয়, অপমানই প্রতিবাদের নতুন মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়।

সমাজে প্রতিহিংসা এমন পর্যায়ে গেছে—যেখানে একজনের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া অন্যের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে! পৈশাচিক এই আনন্দ—পরস্পরের মর্যাদা হরণ করা এক ভয়াবহ সামাজিক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো প্রতি ক্ষোভ কিংবা কাউকে অসম্মান করার বাসনা শুধু জীবিত থাকাকালেই যে-প্রয়োগ হচ্ছে তা নয়, মৃত্যুতেও সে-জিঘাংসার অবসান হয় না। বরং একের মৃত্যু অন্যের কাছে আনন্দের বার্তা হয়ে উঠছে! আমাদের নৈতিক বধিরতা এতোটাই গভীর যে—শবযাত্রা আর অবমাননার মধ্যে পার্থক্য করাও অসম্ভব হয়ে গেছে! আজকের সমাজে জুতোর মালা কেবল একজন অপরাধীর গলায় নয়, বরং একটি সমাজের নিজের বিবেকহীনতার গলায়ও পরানো হচ্ছে। এটি একটি প্রতীকী আত্ম-অপমান, যেখানে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সমাজ নিজেই তার নৈতিক অধঃপতনের ঘোষণা দিচ্ছে।

আমরা বিচার চাই না, অপমান চাই। যুক্তি চাই না, উত্তেজনা চাই। কিন্তু একটি সভ্য সমাজ কখনোই তার ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া—প্রতিশোধের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারে না। ‘জুতোর মালা’ হচ্ছে—প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া।

গণ-অপমান বা এই ধরনের প্রতীকী অপমান বহু মানুষের সমর্থন পায়, ঠিক যেমন জনরোষের ঢেউয়ে ডুবে যায় ব্যক্তিগত ন্যায় বা মানবিকতা। হান্না আরেন্ড বলেন—'The sad truth is that most evil is done by people who never make up their minds to be good or evil.' অর্থাৎ, ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সত্য এই যে, অধিকাংশ অমঙ্গল সংঘটিত হয় তাদের হাতেই, যারা ভালো কিংবা মন্দ—কোন পথ বেছে নেবে, সে সিদ্ধান্তেই পৌঁছায় না কখনো।’ এই ধরনের অপমান একপ্রকার Banality of irresponsibility.' ‘Banality of irresponsibility-’ বলতে বোঝায় এমন এক সমাজ-মানসিকতা, যেখানে মানুষ নিজের কাজের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা না করেই কাজ করে। তারা নিজেকে ভাবেই না কোনো নৈতিক কর্তব্যের অধিকারী হিসেবে। এটা অশুভতার মতোই বিপজ্জনক, কারণ তা জেনে বা না জেনে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়।এটি যখন ঘটে মানুষ তখন ভাবে— ‘আমি শুধু আদেশ পালন করছি’ আরও ভাবে—‘সবাই করছে, আমিও করলাম।’ মানুষ না বুঝে, না ভেবে—অবমাননার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। এই মনোভাবের ফলে অপরাধ বা অন্যায়ের দায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ থেকেই যায়, প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে, সমাজ বিবেক হারায়। যে সমাজে বিচারকে কেন্দ্র না করে অপমানকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলন হয়, সেখানে কেবল শাসকের নয়, সমাজের ও নৈতিকতার মৃত্যু ঘটে। কারণ, সমাজ তখন আর যুক্তিবান নয়, প্রতিক্রিয়াশীল। জুতোর মালা তখন যেন এক প্রতীক নয়, সমাজের নৈতিক শবযাত্রার মালা।

জুতোর মালা যেমন একজন দুর্নীতিবাজের গলায় অপমানের প্রতীক, তেমনই তা আমাদের সমাজের মূল্যবোধের ব্যর্থতারও প্রতীক। এর বদলে চাই— সংবেদনশীল, সংহত ন্যায়বোধ, যেখানে আমরা অপরাধের বিচার করবো, অপরাধীকে নয়। মানুষের সম্মানহানির মাধ্যমে নয়, আইনের শাসনের মাধ্যমে প্রতিকার চাইবো। আমাদের মনে রাখতে হবে—একটি জাতির নৈতিক উন্নতি বিচার করা যায়, তারা কাকে কীভাবে বিচার করে তা দেখে। তারা কাকে অপমান করে তা নয়, বরং তারা কীভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে—সেইটিই সেই জাতির পরিপক্বতার মাপকাঠি।

একটি জাতির সভ্যতা ও নৈতিক উন্নতির সূচক নির্ধারিত হয় এই দিয়ে যে—সে অপরাধীর প্রতি কেমন আচরণ করে, কীভাবে বিচার করে এবং কী প্রক্রিয়ায় ন্যায়ের সাধন করে। ন্যায় মানে শুধু শাস্তি নয়, ন্যায়ের পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়াও।

কোনো অপরাধীর প্রতি ঘৃণা বা অপমান—একটি সহজ সামাজিক প্রতিক্রিয়া, কিন্তু সভ্যতা দাবি করে আইনের মাধ্যমে ন্যায়ের সংরক্ষণ।একটি সমাজকে বিচার করতে হলে দেখতে হবে, সে কীভাবে আইনের ভেতর দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার করে। যদি সমাজ অপমান, প্রতিশোধ বা জনরোষের ভিত্তিতে বিচার করে, তাহলে সে আইন প্রতিষ্ঠা করছে না, বরং ন্যায়ের নামে অন্যায়কে বৈধতা দিচ্ছে। একজন অপরাধীকে অপমান করা বা ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি দেওয়া অনেক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃত দার্শনিক প্রশ্ন হচ্ছে—এই প্রক্রিয়াটির মধ্যে নৈতিকতা, ন্যায়বোধ ও মানব মর্যাদার স্থান কোথায়? একটি সভ্যজাতি অপরাধীর সম্মানহানি করে না, সে ন্যায়বিচার করে।

কীভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে—এটি অন্তর্মুখী বিচারবোধ, জাতির মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক নৈতিকতার পরিচায়ক। ন্যায় মানে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা নয়, বরং একটি সম্মিলিত মানবিক চুক্তি, যেখানে সবাই (অপরাধীসহ) ন্যায়ের প্রক্রিয়ার ভেতর একটি সম্মানজনক স্থান পায়। একটি জাতিকে তার ন্যায়বোধ দিয়ে বিচার করতে হয়—ঘৃণার উচ্ছ্বাস দিয়ে নয়। যারা এসব ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত, তাদেরকে দ্রুত  আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা না করলে—যেটুকু বিচার অবশিষ্ট আছে, তাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হলে— বিবেকের আলো জ্বালাতে হবে।

লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক