
আমীন আল রশীদ , সাংবাদিক, কলামিস্ট
পুশ-ইন মানে ঠেলে দেওয়া। অর্থাৎ একটি দেশ তার দেশ থেকে প্রতিবেশী দেশে যখন অবৈধ নাগরিকদের ঠেলে দেয়, সেটিকে বলা হয় পুশ-ইন। এটা যৌক্তিক কারণেও হতে পারে। অর্থাৎ যদি সংশ্লিষ্ট দেশের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকে যে, তাদের দেশে প্রতিবেশী দেশের অবৈধ নাগরিক রয়েছেন, তখন তারা সেই দেশের সীমান্ত দিয়ে এই ধরনের পুশ-ইন করতে পারে। কিন্তু তারা যদি অবৈধ না হন বা যে দেশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তারা যদি সত্যিই ওই দেশের নাগরিক না হন, তাহলে এই ধরনের পুশ-ইন অবৈধ এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। অনেক সময় অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরকেও ঠেলে দেওয়া হয়। সেটাও পুশ-ইন।
ভারত সম্প্রতি প্রচুর মানুষকে (সঠিক সংখ্যাটি জানা যায়নি) বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে এই অভিযোগ তুলে যে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক এবং অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবির তরফে বলা হচ্ছে, ভারত যাদেরকে এরকম পুশ-ইন করেছে, তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক নন। উপরন্তু তাদের মধ্যে অনেকে রোহিঙ্গা—যাদের মধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএচসিআরের নিবন্ধিতরাও রয়েছেন।
গত ৭ মে ভোর ছয়টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ভাওয়ালকুড়ি সীমান্তবর্তী নতুনহাট বাজার এলাকায় ২২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের টহল দল পুশ-ইনের শিকার পাঁচজনকে আটক করে জানতে পারে যে তারা একই পরিবারের সদস্য এবং ভারতের আসামের মাটিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন। তাদের নিকট থেকে ইউএনএইচসিআর, নয়াদিল্লি কর্তৃক ইস্যুকৃত পাঁচটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড উদ্ধার করা হয়।
বিজিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, দুই বছর আগে তারা মিয়ানমার থেকে ভারতে পালিয়ে যান এবং আসামের মাটিয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সম্প্রতি কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে চোখ বেঁধে একটি অজানা স্থানে নামিয়ে দেয় এবং কোনো প্রশ্ন না করে সামনে হাঁটতে বলে। সারারাত হেঁটে তারা ভোরের দিকে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পৌঁছায়। পরে বিজিবি তাদের আটক করে।
প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘের নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদেরকেও ভারত কী করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়? এটা সুস্পষ্টভাবে জাতিসংঘের সাথে ভারতের শর্তের খেলাপ এবং একইসঙ্গে মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। কিন্তু বাংলাদেশ কি ভারতের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাকে অবহিত করেছে বা লিখিতভাবে অভিযোগ জানিয়েছে? ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কথা বলেছে? পুশ-ইনের নামে যে অন্তত পাঁচজন নিবন্ধিত রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ ঠেলে দেওয়া হলো, এ বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশ কি কোনো জবাবদিহি চেয়েছে?
মনে রাখতে হবে, পুশ-ইন শুধু একটি মানবিক ও কূটনৈতিক সমস্যা নয়। বরং এটি একটি দেশের সার্বভৌমত্বেরও প্রশ্ন। ধরা যাক ভারত সম্প্রতি যাদেরকে পুশ-ইন করেছে, তার মধ্যে কিছু অপরাধীও রয়েছে। তারা যদি বাংলাদেশে ঢুকে আত্মগোপনে চলে যায় এবং নানারকম নাশকতামূলক কাজ করে, বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায়, সেটি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় বিপদের কারণ হবে।
প্রশ্ন হলো, ভারত হঠাৎ করে কেন এই ধরনের পুশ-ইন শুরু করলো? এর উত্তর খুব সহজ। সেটি হলো, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঘটনাটি ভারত সরকারের জন্য একটি বড় অস্বস্তি। বস্তুত ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কও ব্যাহত হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে ভিসা আদান-প্রদান কার্যত বন্ধ। এমনকি যে-সব লোক ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, তারাও ভিসা জটিলতায় আটকে যাচ্ছেন।
পক্ষান্তরে ভারত নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার মেডিকেল ট্যুরিজমের একটি বিরাট জায়গা দখল করেছিল বাংলাদেশের মানুষেরা। বিশেষ করে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতাল ও নিউ মার্কেটকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, সে বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে এসে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণেরও চেষ্টা করেছিল। তার কিছু তৎপরতা বিজিবি ও স্থানীয় মানুষের প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা গেছে।
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখার চেষ্টা হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য (সেভেন সিস্টার্স) ঝুঁকিতে পড়বে—এই কথা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে। সুতরাং বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি ভারতের নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকেও প্রয়োজন। এই উপলব্ধিটা থাকলেই কেবল একটি সম্মানজনক ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা দাঁড়াতে পারে।
গত বছরের আগস্ট মাসেই বাংলাদেশে নোয়াখালী-ফেনী-কুমিল্লায় অঞ্চলে যে অস্বাভাবিক বন্যা হলো, তার পেছনেও ভারতের একটি ব্যারাজ থেকে পানি ছেড়ে দেয়াকে দায়ী করা হয়। সব মিলিয়ে নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে যে স্বাভাবিক ও সুন্দর সম্পর্কটি দুই দেশের মানুষের জন্যই প্রয়োজন ছিল, সেখানে একটি বিরাট ছন্দপতন ঘটেছে।
তার মধ্যে যুক্ত হয়েছে পুশ-ইন। ভারত কেন এই ধরনের তৎপরতা শুরু করলো? তার উত্তর সম্ভবত এই যে, ভারত চায় বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করতে। এই চাপ তৈরি করে সে কি এখানে তার খবরদারি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নাকি সে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট তার অস্বস্তির বদলা নিচ্ছে—তা পরিষ্কার নয়।
পুশ-ইনের মধ্যেই ভারত স্থলপথে বাংলাদেশে থেকে পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। শনিবার (১৭ মে) এক বিজ্ঞপ্তিতে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ। তবে কলকাতা ও মুম্বাইয়ের নবসেবা সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পোশাক আমদানি করা যাবে। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের ল্যান্ড কাস্টমস চেকপোস্ট দিয়ে ফল, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা ও আসবাবপত্র রপ্তানিও বন্ধ থাকবে। পশ্চিমবঙ্গের ফুলবাড়ী ও চ্যাংড়াবান্ধা স্টেশনেও এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের প্রায় ১৫৭ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার মানে ভারত নানাভাবেই বাংলাদেশকে যে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে, সেটি খুবই স্পষ্ট।
সরকার কী করছে?
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিজিবির অপারেশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিকের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বেড়েছে। সীমান্ত রক্ষায় সীমান্ত এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো হয়েছে—যার বড় উদাহরণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৫ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশো মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে বিএসএফ। তবে বিজিবি ও স্থানীয় মানুষের কঠোর প্রতিরোধের মুখে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফসলের মাঠে বিজিবি সদস্যদের পাশে কাস্তে হাতে স্থানীয়দের কৃষকদের প্রতিরোধের চিত্র গণমাধ্যমে এসেছে।
গত ১৭ মে সাতক্ষীরায় এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ভারত থেকে পুশইনের মাধ্যমে আসাদের মধ্যে বাংলাদেশি থাকলে তাদের পুশব্যাক করার সুযোগ নেই। তবে ভারতের নাগরিক ও দেশটির রোহিঙ্গারা থাকলে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার ফেরত পাঠানো হবে।
কিন্তু এতকিছুর পরেও এটা মাথায় রাখতে হবে যে, এভাবে পুশ-ইন ঠেকানো যাবে না। কেননা বাংলাদেশের সীমান্ত পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র নয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চার হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত তার মধ্যে স্থল, পাহাড়ি ও নদী এলাকাও আছে। সুতরাং পুরো সীমান্ত কংক্রিটের দেয়াল কিংবা দুই স্তরের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সিলগালা করে দেয়া বাস্তবসম্মত নয়। ফলে ভারত সরকার যদি সত্যি সত্যিই বাংলাদেশকে চাপে বা অস্বস্তিতে রাখতে চায়, তাহলে বিভিন্ন দুর্গম এলাকা দিয়ে পুশ-ইন শুরু করবে। তার সবগুলো ঘটনা প্রতিরোধ করা বিজিবির পক্ষে কঠিন। স্থানীয় মানুষদের জন্য তো বটেই।
সমাধান কী?
সমাধান হলো দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। পুশ-ইন একটি রাজনৈতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় ইস্যু। এটাকে রাজনৈতিকভাবে, তথা ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সমাধান করতে হয়। এটা যুদ্ধ করে সমাধান করারও বিষয় নয়। এটি একেবারেই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও সমঝোতার বিষয়। প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক না হোক, অন্তত স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজ না করলে আয়তন ও শক্তিতে এবং কৌশলগত অবস্থানের কারণে তুলনামূলক ছোট রাষ্ট্রের জন্য বিপদটা বেশি।
ভারতের ব্যাপারে মূল অভিযোগ হচ্ছে তারা তাদের প্রতিবেশী সকল দেশকেই নিজেদের অধীন মনে করতে চায় বা অধীন করে রাখতে চায়। তারা নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যেভাবে ডিল করে, বাংলাদেশকেও সেভাবে ডিল করতে চাইলে এটা একধরনের ভুল কূটনীতি। দুটি কারণে এটি অসম্ভব। ১. বাংলাদেশ হচ্ছে এই অঞ্চলের একমাত্র দেশ যে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। অতএব একটি স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রের মানুষকে আরেকটি দেশ তাদের অধীন মনে করবে আর সেই দেশের মানুষ সেটা মেনে নেবে, এটা অসম্ভব। ২. বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখার চেষ্টা হলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য (সেভেন সিস্টার্স) ঝুঁকিতে পড়বে—এই কথা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে। সুতরাং বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন, তেমনি ভারতের নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকেও প্রয়োজন। এই উপলব্ধিটা থাকলেই কেবল একটি সম্মানজনক ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা দাঁড়াতে পারে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বপূর্ণ এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিবেচনায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকলে পুশ-ইনের মতো ঘটনা যেমন বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনি বাংলাদেশিদের ওপর নির্ভরশীল ভারতের মেডিকেল ট্যুরিজমসহ অন্যান্য ইস্যুতেও দুশ্চিন্তা কমবে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।