Image description

বাংলাদেশের আইনজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক মহান আল্লাহর হাওলায় চলে গেছেন । ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। 
জনাব আব্দুর রাজ্জাককের সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘ ২৫ বছরের। দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই। ২০০০ শুরুর দিকে এক সাংবাদিক কাম রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি আমাকে প্রথম পাঠিয়েছিলেন ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাককের  অফিসে। আমি তখন বুয়েট ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। সেই বড় ভাই আমাকে পাঠিয়েছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককের নেতৃত্ব নতুন একটা থিংক ট্যাঙ্কের (Think Tank)  কাজ শুরু করার ব্যাপারে।  


তিনি নয়াপল্টনের সিটিহার্ট টাওয়ারের ‘ল কাউন্সেল’ (Law Counsel) নামে চেম্বার পরিচালনা করতেন। তিনি তখন সস্মবত জামায়াতের নতুন সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হয়েছেন। প্রথম সাক্ষাতে বুঝলাম, তিনি আর দশজন রাজনৈতিক নেতা বা আইনজীবীর মতো নন। কথা কম বলেন, চুপচাপ থাকেন ।   শুনেন বেশী। কথা  বলেন মেপে মেপে, গুনে গুনে।  রাজনৈতিক বড় ভাই আমাকে পাঠানোর আগেই  সস্মবত তাঁকে আমার সস্মর্কে ব্রিফ করেছিলেন।মিডিয়ার প্রতি আমার আগ্রহটা মনে হয় ব্যারিস্টার সাহেব আগেই জানতেন।  এখনো মনে আছে, প্রথম দেখায় তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ ডেইলি ষ্টার আর প্রথম আলো নিয়ে আপনার মতামত কি?”  তিনি লেখাপড়া করতেন প্রচুর  । মনে আছে সেই সময় পাকিস্থানের ১৯৭১ সাল নিয়ে হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট অনলাইনে প্রকাশ হলে, তিনি ডাউনলোড করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  পড়তেন। ৭১ ইস্যু নিয়ে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব অবস্থানও ছিলো। 


সিটি হার্টের প্রথম দেখার পর থেকে আমার ২০০২ আগষ্টে  উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানী গমনের আগ পর্যন্ত মনে হয় প্রতিসপ্তাহ কমকরে হলেও একবার  তাঁর সাথে দেখা হয়েছে। বেশী ভাগ সময় দেখা করেছি, তাঁর ঢাকাস্থ   ধানমণ্ডির বাসায়।   এর প্রধান কারন তিনি তাঁর নেতৃত্ব গঠিত থিংক ট্যাঙ্কের জন্য আমার মতো সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা "একজন ইঞ্জিনিয়ার"কে কো-অর্ডিনেটর করেছিলেন। দেশে থাকতে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্টিত  থিংক ট্যাঙ্কের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমরা অনেকটাই সফল হয়েছিলাম। এর অন্যতম কারন হয়তো তাঁর ব্যবহার আর বুদ্ধিবৃত্তিক গাইডেন্স। 


আগস্ট ২০০২ থেকে ২০০৫ মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ ছিলো না। ২০০৫ শেষের দিকে তিনি জার্মানী সফরে আসেন। সেই সময় ফ্রাঙ্কফুর্টে তাঁর সাথে ফের দেখা হয়। মাইন (Frankfurt am Main) নদীর পাড় ধরে দু’জনেই হাঁটতে হাঁটতে নানা কথা হচ্ছিলো । ফাঁকে আমার পিএইচডি, ইউরোপিয় ইউনিয়ন  গঠনের ইতিহাস, বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহসহ  নানান প্রসঙ্গ । আজো মনে আছে, তিনি কথার ফাঁকে বলেছিলেন, " ২০০৬ শেষে সস্মবত স্বাভাবিক নির্বাচন হবে না দেশে”। যতটুকু মনে পড়ে, তিনি লন্ডনস্থ সাপ্তাহিক ইকোনোমিষ্ট (Weekly Economist) প্রকাশিত একটি রিপোর্ট    আর তাঁর দূতাবাস কেন্ত্রিক যোগাযোগের সূত্র ধরে ২০০৬ সালে দেশে স্বাভাবিক ক্ষমতার পালাবদল না হওয়ার আশংকা করছিলেন। 


দীর্ঘ দশ বছর পর ফের ২০১৫ সালের দিকে  তাঁর সাথে দেখা লন্ডনে। এর পর কয়েকবার দেখা হয়েছিলো। সেই সময় মনে হয়েছে, তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছিলেন। এরপরে তাঁর নতুন একটি  রাজনৈতিক দলের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার কথা  সবার জানা।  তাঁর রাজনৈতিক উদ্যোগের সাথে আমার তেমন আগ্রহ না থাকায় যোগাযোগে ছেদ পড়ে  বেশ কয়েক বছর।  


দীর্ঘ দশ বছর পর বারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক দেশে ফেরেন গত বছরের শেষে। আমি ২০২৪-এর  ডিসেম্বর মাত্র ১৭ দিনের জন্য দেশ গেলাম। তিনি অসুস্থ, চলাফেরা তেমন করেন না। ধানমণ্ডিতে তাঁর অফিসে দেখা হলো তাঁর দুই ছেলের সাথে। তাঁদের কাছেই ইচ্ছে পোষণ করলাম, তাঁদের আব্বার সাথে দেখা করতে পারি কিনা। তাঁর দুই ছেলে ব্যারিস্টার ইমরান ও এহসানের সাথে আমার আগে পরিচয় হয়নি কখনো। স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের আব্বার সাথে আমার দীর্ঘ পরিচয় অবগত ছিলেন না। জবাব আসলো দেখা করা সম্ভব নয়। বললাম, ‘ মোকাররম এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে, এটা বললেই হবে ’ ১৫ মিনিট পর চেম্বার থেকে জানানো হলো, ‘ আব্বা আপনাকে বাসায় যেতে বলেছেন’। ডিসেম্বরের শেষে ঢাকায় তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা। বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক দিন পর আপনার সাথে দেখা “ ( তিনি আমাকে আপনি করেই বলতেন)। 


ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আপাদমস্তক একজন নিরেট সজ্জন, মিতভাষী ব্যাক্তি ছিলেন। সমালোচনা করার চেয়ে কাজের  মাধ্যমে জবাব দেয়া যিনি পছন্দ করতেন বেশী । সময় সচেতন ছিলেন মারাত্মক। নামাজের ব্যাপারে ছিলেন ভয়ানক সিরিয়াস। অন্যের সমালোচনা, হতাশা দেখিনি তাঁর কথায় । ভাবছি বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গন বিশেষ করে ইসলামিক রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর শূন্যস্থান পুরন কি সহজে হবে?

 

ডঃ মোকাররম হোসেন, ইউকে