
মাহমুদুর রহমান
মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে রাজধানীর অযুত জনতা ‘মার্চ ফর গাজা’ এবং ‘নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা’য় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। এই দুই দিনের বিশাল গণজমায়েত বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছে, আমরা দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমান উম্মাহর প্রতি যেমন সংবেদনশীল, তেমনই নিজস্ব জাতীয় সংস্কৃতির ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে, জাতীয় কোনো দিবস উদ্যাপনে কোনো হেজেমনিক রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি বাংলাদেশের জনগণ আর গ্রহণ করবে না।
বাংলাদেশে এতদিন বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার নামে ইসলামের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সুপরিকল্পিতভাবে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত ‘বাঙালিত্বের’ ধারণায় বাঙালি মুসলমানদের একপ্রকার অচ্ছুত ও বহিরাগত হিসেবে দূরে ঠেলে রাখার প্রক্রিয়া উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রণালীতে জন্মলাভ করা তথাকথিত ‘বাঙালি রেনেসাঁ’র সময়ই আরম্ভ হয়েছিল।
বাঙালি রেনেসাঁর হিন্দু প্রবক্তারা বাঙালি মুসলমানদের কতখানি ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে দেখতেন তার উদাহরণ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর বিখ্যাত বইতে রেনেসাঁ-সম্পর্কিত লেখার নিচের উদ্ধৃতি থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়—‘The very first result of this renaissance was a progressive de-Islamization of the Hindus of India and a corresponding revival of Hindu traditions. Throughout the nineteenth century the culture of the Hindus of India was taken back to its sanskritik foundations. The only non-Hindu influences which it recognized and tried to assimilate were European. All the thinkers and reformers of modern India from Ram Mohan Roy to Rabindra Nath Tagore based their life-work on the formula of a synthesis, by which they understood a synthesis of Hindu and European currents. Islamic trends and traditions did not touch even the area of their consciousness. Thus, the new Indian culture of the nineteenth century built a perimeter of its own and put specifically Muslim influences and aspirations beyond the pale. In relation to it, the Muslims stood outside as an external proletariat, and if the Muslims wanted to come into its world they could come only after giving up all their Islamic values and traditions.’ (Nirad Chandra Chaudhuri, Autobiography of an unknown Indian)
সকল পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে উপরোক্ত ইংরেজি উদ্ধৃতির বাংলায় অনুবাদ করা প্রয়োজন মনে করছি—‘রেনেসাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু মানস থেকে ইসলামের সকল প্রকার সংস্পর্শ বিচ্ছিন্ন করে সেখানে হিন্দু আচার ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা হয়। উনিশ শতকের পুরোটা সময় ধরে সকল হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানকে সাংস্কৃতিক (অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য কিংবা মনুবাদ) কেন্দ্রমূলে প্রত্যাবর্তন করানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়।
হিন্দু সাংস্কৃতিক মূলধারার বাইরে তখন যে বিদেশি সংস্কৃতিকে সম্মান-সহকারে আত্মীকরণের চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা ছিল ইউরোপীয়। রাম মোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত আধুনিক ইন্ডিয়ার সকল সমাজ সংস্কারক ও চিন্তকরা হিন্দু এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনের জন্য তাদের সারা জীবনের কর্ম উৎসর্গ করেছেন।
ইসলামের ঐতিহ্য ও দর্শন তাদের চিন্তাচেতনায় কখনো স্পর্শও করেনি। উনিশ শতকে তৈরি হওয়া ইন্ডিয়ার নতুন সংস্কৃতিতে প্রধানত মুসলমানদের বাইরে রাখার অভিপ্রায়ে একটি প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। মুসলমানরা সেই প্রাচীরের বাইরে অচ্ছুত হিসেবেই দাঁড়িয়ে থাকত। যদি কোনো মুসলমান হিন্দুদের সৃষ্ট সেই জগতে প্রবেশ করতে চাইত, তা হলে তাকে সকল ইসলামি ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ পরিত্যাগ করে আসতে হতো।’
সংখ্যালঘু মুসলমানদের বহিরাগত ট্যাগ দিয়ে তাদের নীচকুলজাত দেখিয়ে হেনস্তা করার যে প্রক্রিয়া ব্রিটিশ কলোনিতে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা ‘বাঙালি রেনেসাঁ’র বয়ানে শুরু করেছিল, সেটি আজ পর্যন্ত ভারতে অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের সম্মানটুকু থেকেও মুসলমানরা বঞ্চিত। জামাতে নামাজ পড়ার একটি সাধারণ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করার অপরাধেও মোদির হিন্দুত্ববাদী ইন্ডিয়ায় একজন মুসলমান ছাত্রকে জেলে যেতে হয়েছে।
১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণ করা না গেলে আমাদেরও আজ ভারতের অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলমানদের মতো অমানবিক জুলুম সহ্য করতে হতো। পাঠকরা কি আদৌ উপলব্ধি করতে পারছেন যে, তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁর যুগে আমাদের পূর্বপুরুষদের কতখানি অপমান ও অনাদর সহ্য করতে হয়েছে? রাম মোহন রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো উনিশ শতকের সমাজের কর্তাব্যক্তিরা মুসলমানদের প্রজার বাইরে আর কোনো মর্যাদা দিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
প্রজার মধ্যেও তারা হিন্দু-মুসলমান পার্থক্য করতেন। একজন হিন্দু প্রজা জমিদারের দহলিজে বসার সুযোগ পেলেও মুসলমান প্রজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তৎকালীন হিন্দু অভিজাত শ্রেণি ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে এলিট হতে চেয়েছে, অথচ হাজার বছরের প্রতিবেশী মুসলমানের সংস্কৃতিকে কখনো আপন মনে করেনি। আজ পর্যন্ত সেই ইসলামবিদ্বেষের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
হিন্দু জমিদার শ্রেণির অব্যাহত অবমাননা ও জুলুমের কারণেই ১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের নিপীড়িত মুসলমান জনগোষ্ঠী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, ব্রিটিশ আমলের বৃহত্তর বাংলায় সংখ্যাগুরু মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অচ্ছুত করে রাখতে যেসব হিন্দু রথী-মহারথীরা মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদেরই অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ দেশের একশ্রেণির কথিত মুসলমানরা দিবারাত্র কেবল পূজাই করছেন না, আজ তারই রচিত গান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে! ছায়ানটের মতো ইসলামবিদ্বেষী সাংস্কৃতিক সংগঠনের বৈশাখ উদ্যাপন রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া পূর্ণতা পায় না! অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এত লেখার মধ্যে কোথাও বাঙালি মুসলমানের জীবনের কথা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যে বা যারা রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সংগীত রূপে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, তাদের হয় কোনো আত্মসম্মান জ্ঞান ছিল না, অথবা তারা এই অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে একেবারে মূর্খ ছিলেন। ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন জাতির ললাটে এ রকম অপমানই লেখা থাকে। একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের প্রচুর পড়াশোনা করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে জাতি একবার ইতিহাসমনস্ক হয়ে উঠলে তাকে কোনো বিজাতীয় সংস্কৃতি দিয়ে আর মগজধোলাই করা সম্ভব হবে না।
উনিশ শতক থেকে আবার বর্তমানে ফেরা যাক। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের এবারের ভিন্নধর্মী, স্বতঃস্ফূর্ত ও আনন্দমুখর নববর্ষ উদ্যাপনে হতাশায় ভেঙে পড়া ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের হাহাকার দেখে বেশ অনুকম্পা অনুভব করেছি। তাদের মধ্যে কারো নাকি দম একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ বৃদ্ধ বয়সে আবার বাঙালি হয়ে ওঠার বাসনা ব্যক্ত করেছেন, আবার কেউবা পরাজয় মেনে নিয়ে তাদের মতাবলম্বী সবাইকে দেশান্তরী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
যুক্তিসংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত একটিমাত্র বর্ষবরণেই কি তাদের এই তীব্র মর্মবেদনা? আমি মনে করি, এদের এই যাতনা মূলত সব ক্ষেত্রে পরাজয়ের ফসল। ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে ভারত আমাদের দেশে মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক জগতে অনেক প্রচেষ্টায় যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তারই পরাজয় ঘটেছে এবারের পহেলা বৈশাখে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দিল্লির দালালদের পক্ষে সেই শোচনীয় পরাজয় মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই এমন সমস্বরে আর্তনাদ। জুলাই বিপ্লবে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হলেও এরা ভেবেছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গন বরাবরের মতো ভারতপন্থিদের দখলেই থাকবে। এখন সাংস্কৃতিক ময়দানও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তারা মানসিকভাবে বাস্তুচ্যুত বোধ করছে।
বলাই বাহুল্য, এই বিশেষ শ্রেণির পরম মোক্ষলাভের স্থান হলো একমাত্র ভারতমাতা। তাদের সকলের পরম পূজনীয় পিতা শেখ মুজিবের রক্তপিপাসু দানব কন্যা শেখ হাসিনাও এখন সেখানেই আছেন। সুতরাং আমি ঐকমত্য পোষণ করছি যে, একমাত্র ভারতে গেলেই চেতনাজীবীরা তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া দমও নিতে পারবেন এবং রাবীন্দ্রিক আদর্শের বাঙালি হয়ে বাকি জীবন সেখানে সুখে কাটাতে পারবেন। ভারত সরকার তো ঘোষণা দিয়েই রেখেছে, বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ভারতে গেলেই তাদের সে দেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। পাঠকরা হয়তো বলবেন, হাসিনাবিহীন বাংলাদেশে ‘দম বন্ধ হয়ে যাওয়া বাঙালিদের’ মধ্যে জীবনাচারে ইসলাম ধর্ম না মানলেও মুসলমান নামধারী তো অনেকেই আছেন।
তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা তো ভারত সরকার এখনো বলেনি। আপনাদের কথায় যুক্তি আছে। তবে আমি মনে করি, এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়াও খুব সহজ। এরা সবাই ভারতে গিয়ে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নিলেই তাদের নাগরিকত্বের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সপ্তাহ খানেক আগেই সংবাদপত্রে পড়লাম, শেখ পরিবারের একজন নাকি ভারতে গিয়ে কেবল হিন্দুই হননি, এর মধ্যে সেই দেশের নাগরিকত্বের কাগজপত্রও জোগাড় করে ফেলেছেন।
তা ছাড়া জুলাই বিপ্লবের পর যে হাজার দশেক আওয়ামী লীগের পাণ্ডা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছে, তাদেরও দেশটির সরকার কোনো ঝামেলা ছাড়াই থাকতে দিয়েছে—তাদের সবাই হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্ম পরিবর্তনও করেনি। ফ্যাসিস্ট শাসনের ১৫ বছরে পাচার করা বেশুমার ডলার খরচ করে সেই মন্ত্রী, এমপি ও পাণ্ডারা কলকাতা, দিল্লি ও মুম্বাই শহরে বেশ ফুর্তিতেই দিন কাটাচ্ছে। আওয়ামী ও বামের ছদ্মবেশে রামপন্থিদের জন্য ভারত সার্বিক বিবেচনাতেই একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
সুতরাং এত কষ্ট মনের ভেতরে চেপে রেখে, দম বন্ধ করে, আমাদের মতো অচ্ছুত মুসলমানদের দেশে না থেকে মোদির রামরাজ্যে চলে যাওয়ার বন্ধুসুলভ পরামর্শটাই চেতনাজীবীদের গ্রহণ করা উচিত।