
ড. আবুল বাশার ভূঁইয়া
ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ২০২৪ সালের শেষ দিকে ও ২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারত তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
ভারত সবসময় বাংলাদেশে তার নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করেছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বিজয়ে ভারত প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছিল, যখন অধিকাংশ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। সেই সময় ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
অনেকের মতে, এটি ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ।
ভারতের এই নীতির ফলে বাংলাদেশে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। এই প্রভাবের ফলে ক্ষমতাসীন দল যে কোনো প্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই টিকে থাকতে পেরেছে এবং বিরোধী দলগুলো ক্রমাগত কোণঠাসা হয়েছে।
ভারতের ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও নির্বাচনী সুশাসনের জন্য গভীর হুমকি হিসেবে কাজ করেছে।
এই বাস্তবতা বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ভারত-বিরোধী মনোভাব গঠনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে পানি, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্যবৈষম্য এবং অসম চুক্তিগুলোর ফলে সাধারণ জনগণ মনে করে ভারত একটি 'নির্বাচনপন্থী স্বৈরশাসনকে' দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কথাই প্রচলিত ভারত সব ডিম একটি ঝুড়িতেই রেখেছে, অর্থাৎ কেবল আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছে।
২০১৪ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে বিএনপি ভারতের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ, ন্যায্য ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল। বারবার তারা দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও ভারত প্রায় একচেটিয়াভাবে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রেখেছে। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এমন এক অবস্থান তৈরি করেছে, যেখানে ভারত নতুন করে বিএনপিকে বিবেচনায় নিচ্ছে।
দিল্লির নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, যদি বিএনপি ভারতের কিছু মৌলিক দাবি বা শর্ত মেনে চলে, তাহলে ভারতও তাদের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী হতে পারে। এই পটভূমিতে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের প্রধান শর্তই হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা।
দিল্লির কূটনীতিকরা একান্ত আলোচনায় বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ যেকোনো সম্পর্ক নির্ভর করবে এই বিষয়ে বিএনপির অবস্থানের ওপর।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাসও বলেছেন, “জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধ এখন খুবই স্পষ্ট, এবং তা ভারত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।”
বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, “আমরা জামায়াতের চিন্তাধারা, তালেবানেইজেশনের কনসেপ্টের ঘোর বিরোধী। আমরা এর বিরোধিতা করে এসেছি, এবং করেই যাব।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে যদিও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মেনে চলা হয়, তবুও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নজির রয়েছে। যেমন ২০১৪ সালে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন এবং নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। তাই বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াতকে ঘিরে ভারতের স্পষ্ট অবস্থান নতুন কিছু নয়।
এদিকে, নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার বলেছেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়া প্রয়োজন।
বিপরীতে, বিএনপির অনেক নেতা মনে করেন, নির্বাচন জরুরি ভিত্তিতে হওয়া উচিত এবং আওয়ামী লীগকে এতে অন্তর্ভুক্ত করাই রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের পতনের পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণের প্রতিযোগিতায় জামায়াত এখন সরব এবং সংসদে শক্তিশালী উপস্থিতির লক্ষ্যে মাঠে সক্রিয়।
জামায়াতের নেতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আওয়ামী লীগে যারা ফ্যাসিজমের পক্ষে ছিলেন তারা পালিয়েছেন, আর যারা ছিলেন না তারা এখন 'বড় দুটি দলে' অবস্থান নিতে পারেন।
পরিস্থিতির জটিলতা এমন যে, বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে একক বড় দল হিসেবে নির্বাচনে যায় এবং জয়লাভ করে, তবে ইসলামপন্থীদের উত্থান বা রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতে, “আমরা কাউকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলেই নির্বাচনই একমাত্র পথ।”
ভারত দৃশ্যত বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক কৌশল অনেকটাই ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রিত। ভারত চায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বজায় থাকুক, যাতে এই জোটের সম্ভাব্য ক্ষমতাগঠনের পথ রুদ্ধ হয় এবং এর পেছনে রয়েছে আদর্শিক, কৌশলগত ও কূটনৈতিক কারণ।
বিজেপি ও আরএসএস নেতৃত্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইসলামপন্থী দলগুলোকে ‘নিরাপত্তার হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা বাংলাদেশে জামায়াতের অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐতিহাসিক সম্পর্ক ভারতের কাছে তাই অগ্রহণযোগ্য, কারণ এটি ভারতের ইসলামবিদ্বেষী অভ্যন্তরীণ ন্যারেটিভের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া, ভারত মনে করে বিএনপি যদি জামায়াতকে বাদ দেয়, তবে তারা আরও দুর্বল ও অনুগত শক্তিহীন হয়ে উঠবে যা ভারত সহজেই প্রভাবিত করতে পারবে। তদুপরি, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ‘মৌলবাদ বিরোধী’ শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে, ভারত বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিকে প্রান্তিক করে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে।
এর পাশাপাশি ভারতের একটি দীর্ঘদিনের ভূরাজনৈতিক কৌশল হলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে অস্থির করে রাখা এবং প্রয়োজনে তাদের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা।
ইতিহাসে যেমন সিকিমকে একতরফাভাবে ভারতভুক্ত বা হায়দরাবাদে সামরিক হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল। তেমনি বাংলাদেশকেও একটি দুর্বল ও অনুগত-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।
বাংলাদেশ যদি একটি শক্তিশালী, স্বাধীনচেতা ও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে উঠে আসে, তাহলে ভারত তার প্রভাব হারাবে। বিশেষভাবে, জামায়াতে ইসলামীকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সবচেয়ে অনুপ্রবেশ-প্রতিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে, কারণ দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রলোভনে প্রভাবিত হওয়ার ইতিহাস নেই এবং তারা বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। এটাই ভারতকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ফেলে। এই কারণেই জামায়াতকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে ভারত প্রবলভাবে চেষ্টা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের পক্ষ থেকে 'ইসলামপন্থীদের' বিষয়ে যে ধাঁচে শর্ত আরোপ করা হচ্ছে, তা এককথায় একটি পুরনো ন্যারেটিভের পুনরাবৃত্তি। এমন ন্যারেটিভ কেবল রাজনীতিকে আরো একপাক্ষিক করে তোলে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আন্তর্জাতিকভাবে ভুলভাবে উপস্থাপন করে।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং তার আদর্শিক মিত্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এই দুটি সংগঠন ভারতজুড়ে ইসলামবিদ্বেষীকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং তা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে। বিজেপি সরকারের শাসনামলে মুসলিম পরিচয়কে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ঘটনা, এনআরসি-সিএএ ইস্যু, কাশ্মীর পরিস্থিতি এবং সীমান্তে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এসবই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের অংশগ্রহণকে একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে উপস্থাপন করতে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীকে উৎসাহিত করেছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট পূর্ববর্তী পরিস্থিতির তুলনায় অনেকটাই আলাদা। পশ্চিমা বিশ্বে জামায়াতের অবস্থানও কিছুটা বদলেছে। ২০০০-এর দশকে ইসলামি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের আতঙ্ক যখন প্রবল, তখন জামায়াত অনেকটাই কোণঠাসা ছিল। কিন্তু এখন পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জামায়াত এখন নিজেদেরকে একটি 'আইনি রাজনৈতিক দল' হিসেবে উপস্থাপন করছে, যারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশ নিতে চায়। ব্রাসেলস ও লন্ডনে তাদের সাম্প্রতিক সফর ও বৈঠক সেই প্রচেষ্টারই অংশ।
এই প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাৎ কেবল সৌজন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশলের দিকনির্দেশক।
এ সাক্ষাৎকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলের কৌতূহল বেড়ে যায়। জামায়াতের পক্ষ থেকেও এই সাক্ষাৎকে গুরুত্ব দিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে যেখানে তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি 'অতীতের সহকর্মিতার স্মৃতি'কে স্মরণ করে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ড. শফিকুর রহমান গত ৪ এপ্রিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর ব্রাসেলসে একটি কৌশলগত সফরে যান। তার সফরসঙ্গী ছিলেন দলের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
এই সফরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাউথ এশিয়ান ককাসের সদস্য এবং ইইউ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জামায়াত প্রতিনিধি দলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ব্রাসেলস সফর শেষে জামায়াত নেতারা লন্ডনে যান এবং সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয় তারেক রহমানের বাসায়, যেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান নিজেও উপস্থিত ছিলেন।
এই সাক্ষাৎকে অনেকেই মনে করছেন বিএনপি-জামায়াত পুরনো সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের একটি সম্ভাব্য সূচনাবিন্দু।
জামায়াতের আমির নিজেই এই সাক্ষাতের বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করে বলেন, “বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমরা একসঙ্গে অনেক দিন কাজ করেছি। উনি অসুস্থ। ওনার খোঁজখবর নেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বহুদিন পর আমাদের দেখা হয়েছে। আমরা ওনার জন্য দোয়া করেছি, ওনার কাছে দোয়া চেয়েছি।”
এই বৈঠকের পর পরই বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে পূর্ববর্তী তথ্য পুনরায় উত্থাপন করে জানানো হয় ভারত বিএনপিকে সমর্থনের পূর্বশর্ত হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়। যখন দৃশ্যমানভাবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে পুনরায় সংলাপ, সাক্ষাৎ এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিকল্পনার সমন্বয় দেখা যাচ্ছে, তখন কেন এই পুরনো শর্ত পুনরায় সামনে আনা হলো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, ভারতীয় নীতিকৌশল এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা একসঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। বিবিসি বাংলা সাধারণত তথ্য যাচাই করেই রিপোর্ট করে, কিন্তু তাদের সময় নির্বাচন ও নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছানোর প্রক্রিয়া অনেক সময় ভিন্ন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সহায়তা করে। তাই বিবিসির এই রিপোর্টকে বিএনপি-জামায়াত পুনর্মিলন প্রতিরোধের একটি কৌশল হিসেবেও দেখা যায়। সার্বিকভাবে ভারতের শর্ত, বিবিসি বাংলার সময়োপযোগী প্রতিবেদন, লন্ডনের বৈঠক এবং ইউরোপে জামায়াত নেতাদের কূটনৈতিক তৎপরতা সবকিছু মিলে বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরির সূচনা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে একে অপরকে শত্রু নয়, বরং রাজনৈতিক সহচর হিসেবে বিবেচনা করে দেশের স্বার্থে একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করা। বিশেষ করে বিএনপির জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
সুতরাং, এই মুহূর্তে বিএনপির কৌশল নির্ধারণ এবং ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা শুধু দলীয় রাজনীতির নয় বাংলাদেশের সমগ্র গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিক নির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। তবে বিএনপির উচিত হবে ভারত-বিরোধী জনমত এবং অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে, দেশের জনগণের আস্থা অর্জন করে এমন এক কৌশল গ্রহণ করা, যা গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার পক্ষে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে জামায়াতের জন্যও সময় এসেছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাইরেও বৃহত্তর বাস্তবতা উপলব্ধি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কৌশলে আধুনিকতা আনার। শুধু ঐতিহ্যগত ধারার মধ্যে থেকে নয়, বরং কৌশলগত, গণতান্ত্রিক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার সময় এখন।
সর্বোপরি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি এবং কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটি দৃঢ়, স্বচ্ছ ও কৌশলগত সম্পর্ক অপরিহার্য।
অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে, এই দুটি দল যদি একটি ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে নিজেদের ঐক্যকে পুনর্গঠন করে, তবে তা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক এবং জনগণের অধিকারে সংবেদনশীল করে তুলবে। যদি তারা সব অভিন্নমনা রাজনৈতিক শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত না করে এবং জামায়াতসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে যৌথ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা না করে, তবে তা হবে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে যেখানে ভারত ছিল একমাত্র শক্তি যারা এই হত্যাকাণ্ড ও দমননীতিকে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে।
লেখক
সহযোগী অধ্যাপক
সানওয়ে ইউনিভার্সিটি, সেলাঙ্গর, মালয়েশিয়া