Image description
{{ author.author.title }}রিন্টু আনোয়ার
 
অবস্থাদৃষ্টে আমাদের রাজনীতিকরা এখন ভেবে দেখবেন কন্যার খবর না নিয়ে পাড়াপড়শির ঘুম নষ্ট করবেন, না আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যার যার দলের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার দিকে নজর দেবেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কী করবে তা তাদের করতে দেন। আগ বাড়িয়ে এমন কিছু করা যাবে না যাতে পতিত স্বৈরাচারী দল আবার দ্রুত পুনর্বাসনের সুযোগ পেয়ে যায়।

 এক ষড়যন্ত্র? গত কয়েক মাসে রাজনৈতিক মেরুকরণ চরম আকার ধারণ করেছে। নতুন শক্তি হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি আত্মপ্রকাশ করেছে, যারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পুরনো দ্বৈতশক্তির বিপরীতে এক নতুন ধারার রাজনীতি আনতে চায়। অন্য দিকে, বিএনপি, জামায়াত, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে কেউ কৌশলগত আবার কেউ জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে, ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ পরিকল্পনাটি সামনে এসেছে, যেখানে শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠদের সরিয়ে একটি নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরীর মতো নেতারা এ নতুন কাঠামোর সামনের সারিতে থাকতে পারেন বলে উড়ো খবরে বলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে এমন কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে বলা হয় : একটি দুর্বল আওয়ামী লীগ রাখা হবে, যাতে একদলীয় বিরোধী দল গঠনের পরিবর্তে বহুদলীয় প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। নেতৃত্ব বদল হবে দলটির। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের অপরাধ স্বীকার করে দলের অস্তিত্ব বজায় রাখা হবে। বিএনপির অংশবিশেষ এ ধারার পক্ষে।

দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম করলেও, ভেতরে ভেতরে কৌশলগত সিদ্ধান্তের দোলাচল রয়েছে বিএনপিতে। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, গণহত্যা ও লুটপাটের সাথে জড়িত নন, এমন কারো নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো বাধা নেই। মানে বিকল্প নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ ফিরলে, তাতে তাদের আপত্তি থাকবে না। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ভিন্ন অবস্থান দেখা যাচ্ছে। দলটির আমির ডা: শফিকুর রহমান বিষয়টি নিয়ে তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন জনগণ মেনে নেবে না।’

ভারত আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি হারাতে চায় না, কারণ দিল্লির দীর্ঘদিনের মিত্র ছিল এ দল। তাই ভারত ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ পরিকল্পনার মাধ্যমে এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে চাইছে, যা দিল্লির স্বার্থ রক্ষা করবে। কিন্তু ‘রিফাইন্ড’ বা ‘পরিশুদ্ধ’ আওয়ামী লীগের ধারণা নিয়ে দলটির ভেতরে কোনো আলোচনা নেই। নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার বিষয়েও কোনো চিন্তাভাবনার কথা জানা যায়নি। এ বিষয়ে দলটির পলাতক প্রধান নেতৃত্বের কোনো সায় আছে, এমন আভাসও পাওয়া যায়নি। ফলে দেশে আওয়ামী লীগের পরিশুদ্ধ অংশকে রাজনীতিতে ফেরানোর সম্ভাবনা নিয়ে যে আলোচনা বা শোরগোল চলছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বহু নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে কিনা এ প্রশ্নও ঘুরছে নতুন করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে রীতিমতো হাসিনা লীগ বানিয়েছিলেন। নিজে আজীবন সভানেত্রী। আজ্ঞাবহ চাটুকার সাধারণ সম্পাদক আর অন্যরা সব দলীয় চাকরবাকর কর্মচারী।

দলীয় জ্ঞানীগুণী যারা ছিলেন তাদের পাঠিয়েছিলেন নির্বাসনে। কাউকে উত্তরসূরি নেতা হিসেবে উঠে আসতে দেননি। এমনকি পরিবারের একজনকেও রাজনৈতিকভাবে সামনে আনেননি। নিজের একমাত্র বোনকেও না। সবাইকে বলে দিয়েছেন টাকা যত পার কামাও কিন্তু নো পলিটিক্স। রাজনীতিতে আসা যাবে না। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনা আছে তো আওয়ামী লীগ আছে, শেখ হাসিনা নাই তো আওয়ামী লীগও নেই।

যার ফলে অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ভুল স্বীকার করবে কি না, এমন একটি আলোচনা তৈরি হলেও উল্টো পথে হাঁটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। অবস্থাদৃষ্টে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগ নিজেদের ভুল স্বীকার কিংবা অতীত কর্মকাণ্ডে অনুশোচনা দেখাতে মোটেও প্রস্তুত নন বলে সহজে অনুমেয়। দলের বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা নিজের পদ ছেড়ে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বাদ দিয়ে দল পুনর্গঠন করবেন, এমন কোনো ইঙ্গিত দলটির নেতারা এখনো পাননি।

তবে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পালিয়ে বিদায় হয়েছেন এটি ঠিক, সহসা বা তার ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তার সাথে আছে বড় একটি শক্তি তা হলো দেশের ভেতর আওয়ামী লীগের ভোটব্যাঙ্ক। গত সাত মাসে আত্মগোপনে থাকা কিছু নেতাকর্মী ভিন্ন ভিন্নরূপে দেশে বিশৃঙ্খল সৃষ্টির নানা কার্ড খেলে ব্যর্থ হয়ে এখন তাদের টার্গেট সামনের নির্বাচন। ফলে তাদের সামনে এখন তিনটি অপশন। ১. হাসিনাকে বাদ রেখে একটি ডামি আওয়ামী লীগ দাঁড় করিয়ে ভোটে যাওয়া। ২. যেখানে যেখানে সম্ভব অর্থ খরচ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করানো। ৩. নির্বাচন সঠিক হয়নি বলে ধুয়া তুলে নির্বাচন বয়কট করা এবং নিজ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করে কাস্টিং কম দেখানো।

তবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচনে আসা ঠেকালে তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেমন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলতে পারবে এই দেখো আমি কত জনপ্রিয়। আমার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে আমাদের দলকে নিষিদ্ধ করেছে। তখন ভারতের হাতে শেখ হাসিনার পক্ষে ক্যাম্পেইন চালানোর একটি প্লাস পয়েন্ট হবে। এটি প্রফেসর ইউনূস ঠিকই বুঝেছেন; অথচ দেশের কিছু অতি জ্ঞানী রাজনীতিক আর বুদ্ধিজীবী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ রবে গলা ফাটাচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে আমাদের রাজনীতিকরা এখন ভেবে দেখবেন কন্যার খবর না নিয়ে পাড়াপড়শির ঘুম নষ্ট করবেন, না আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যার যার দলের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার দিকে নজর দেবেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কী করবে তা তাদের করতে দেন। আগ বাড়িয়ে এমন কিছু করা যাবে না যাতে পতিত স্বৈরাচারী দল আবার দ্রুত পুনর্বাসনের সুযোগ পেয়ে যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট