Image description

মাহমুদুর রহমান

 

বর্তমানে সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রায় ৩১ শতাংশ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর বিপরীতে মুসলমান জনগোষ্ঠী প্রায় ২৫ শতাংশ। বিস্ময়করভাবে ৮০০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন ইসলাম ধর্ম পালন করলেও একক জাতি হিসেবে একুশ শতকে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও উপেক্ষিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় আদতে মুসলমানের প্রাণের কোনো মূল্য নেই।

যেকোনো শক্তিধর দেশ নিজ দেশে অথবা ভিনদেশের মুসলমানকে অপমানিত করতে পারে, নির্যাতন করতে পারে, এমনকি হত্যাও করতে পারবে। এই অত্যাচারের জন্য সেই রাষ্ট্রকে কোথাও কোনো জবাবদিহি করতে হবে না। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ মোড়ল মিলে জাতিসংঘকে প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে রেখেছে।

তারা যার যার ভূরাজনৈতিক স্বার্থে লাজলজ্জাহীনভাবে আন্তর্জাতিক আইনের নিত্যনতুন ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করে থাকে। অন্যদিকে তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের শাসকরা নিজেরাই এত জুলুমকারী এবং তাদের মধ্যে এমন অনৈক্য যে, উম্মাহর স্বার্থরক্ষায় ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সংগঠন ওআইসির ৫৭টি দেশের যোগফল এক বিশাল শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নয়।

ফলে প্রতিটি দেশেই মুসলমানদের নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে, সেটা তারা সংখ্যালঘু অথবা সংখ্যাগুরু যা-ই হোক না কেন। তুলনামূলকভাবে এই মুহূর্তে ফিলিস্তিন ও ভারতের মুসলমানরাই সবচেয়ে করুণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। প্রধানত, এই দুই দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর সেই নিদারুণ অবস্থা নিয়েই আমার আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন।

দুর্ভাগা ফিলিস্তিন : নিজের দেশ ও ভিটা থেকে উচ্ছেদ হওয়া অসহায় ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী ট্যাগ দিয়ে দখলদার জায়নবাদী ইসরাইলি বাহিনী কর্তৃক তাদের নির্বিচারে হত্যার লাইসেন্স দেওয়ার মতো এক নির্মম বিশ্বব্যবস্থার অধীনে আমাদের বসবাস। প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার নামে আমরা এমন এক চূড়ান্ত অসভ্য ও বর্বর সময়ে বাস করছি, যখন সর্বত্র, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি চলছে।

পৃথিবীতে আজ ক্ষমতা থাকলে অসহায় মানুষের ওপর সব ধরনের জুলুম বৈধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সমর্থনে ইসরাইল গাজার অসহায় ও অবরুদ্ধ জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের ১৮ মাস ধরে অব্যাহত গণহত্যার মাত্রা এই পবিত্র রমজান মাসে আরো তীব্র করেছে। প্রতিদিন সেখানে শত শত নারী, শিশু ও পুরুষ মার্কিনিদের সরবরাহকৃত বোমা, মিসাইল ও গোলার আঘাতে নিহত হচ্ছে। চিকিৎসার ন্যূনতম সুযোগ থেকে বঞ্চিত আহত শিশুদের আর্তচিৎকারে আল্লাহর আরশও বোধহয় কেঁপে উঠছে।

অশ্রু-ভারাক্রান্ত চোখে আমরাও অসহায় আক্রোশে শুধু বলে চলেছি, ‘আর কত, এই পাশবিকতার শেষ কোথায়?’ নির্মম ইসরাইলি বাহিনী গাজায় এ পর্যন্ত ৬২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনের নাগরিককে হত্যা করেছে, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। ১৮ মার্চ শুধু এক দিনে সেখানে যে ৪৩৬ জন নিহত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ১৮৩ শিশু, ৯৪ নারী ও ৩৪ বর্ষীয়ান ফিলিস্তিনি। সেখানকার প্রায় ২০ লাখ অনাহারক্লিষ্ট ও সুপেয় পানির অভাবে পিপাসার্ত আদমসন্তান প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, আর তথাকথিত বিশ্ববিবেক চোখ বন্ধ করে রেখেছে। মিসাইল-সজ্জিত শত শত ইসরাইলি ড্রোন দিবারাত্র গাজার আকাশ ঢেকে দিয়ে অবিরাম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে শুধু বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করেই বসে নেই, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটি জায়নবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে সরাসরি মুসলমান নিধনেও অংশ নিচ্ছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইইউ’র আশকারায় ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইনকে কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে ফিলিস্তিন, লেবানন ও সিরিয়ার ওপর বর্বর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যৌথভাবে ইয়েমেনের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

পবিত্র রমজান মাসের প্রতি কোনোরকম শ্রদ্ধা আক্রমণকারীরা দেখাচ্ছে না। একচ্ছত্র ক্ষমতার দাপটে ওয়াশিংটনে ট্রাম্প প্রশাসন মুসলমানদের প্রতি তাদের অপরিসীম ঘৃণা প্রকাশে আর কোনো কূটনৈতিক রাখঢাক রাখারও প্রয়োজন বোধ করছে না। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সপ্তাহে সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানের অনুভূতির প্রতি কোনো সম্মান না দেখিয়ে বলেছেন, ইসলাম নাকি ‘তাদেরকে’ ঘৃণা করে (‘Islam hates us.’)। আমার ধারণা করছি, তিনি ‘তাদেরকে’ (us) বলতে কেবল যুক্তরাষ্ট্রকে নয়, পুরো পশ্চিমি দুনিয়াকেই বুঝিয়েছেন।

এ-জাতীয় ইসলামোফোবিক বক্তব্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগেও দিয়েছেন। তবে তার এবারের বক্তব্যের মধ্যে একটা বিষয় আমি বুঝতে অক্ষম যে, ইসলাম ধর্মবিধানের মধ্যে কোথায় তিনি পশ্চিমের প্রতি বিরাগ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি যদি বলতেন, তার ধারণা মুসলমানরা পশ্চিমা বিশ্বকে ঘৃণা করে, তা হলে সে কথার হয়তো একটা অর্থ করা যেত।

কিন্তু এবার তিনি ২০০ কোটি মানুষের ধর্মকেই সরাসরি আক্রমণ করে বসেছেন। আমি মনে করি, এই বিস্ময়কর তিরস্কারের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসলামোফোবিয়াকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি কি এরপর তাহলে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করতে চান? আমাদের স্মরণে আছে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ (War against terror) ঘোষণার সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ একবার ক্রুসেডের হুমকি দিয়েছিলেন।

ট্রাম্পের এই অবিশ্বাস্য সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী মন্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেই ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করেন। এই বক্তব্য দেওয়ার আগে তিনি গাজার জনগণকে যেভাবে নরক দেখানোর হুমকি দিয়েছিলেন (Hell will rain down), তার মধ্যেও সেই চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছিল।

তিনি এমন হুমকি দিতেও দ্বিধা করেননি যে, তার নির্দেশ অনুযায়ী ফিলিস্তিনিরা গাজা থেকে স্বেচ্ছায় উচ্ছেদে সম্মত না হলে তাদের পাইকারিভাবে হত্যা করা হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘৃণাসূচক মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েই ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটি হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গ করে আবার গণহত্যা শুরু করেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেহেতু গাজার জনগোষ্ঠীকে তাদের বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং পাইকারিভাবে হত্যা করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন, তাই আমার আশঙ্কা ফিলিস্তিনি জাতিকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করাই হবে এই সুযোগে কট্টর জায়নবাদীদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে যদি লাখ লাখ মানবসন্তানকেও হত্যা করতে হয়, তাতে ক্ষমতাধরেরা বিন্দুমাত্র বিচলিত হবে না। ফিলিস্তিনিদের লাশ জায়নবাদীদের কাছে শুধু একটি সংখ্যামাত্র। আজ সাহরি খেয়েই লিখতে বসেছি। দূর থেকে ভেসে আসা ফজরের আজান শুনছি আর গাজার অসহায় শিশুদের কথা ভেবে চোখ ভিজে আসছে।

মোদির ভারতে নিপীড়িত মুসলমান : বিশ্বের সব রাষ্ট্রের মধ্যে এই মুহূর্তে যে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত, অত্যাচারিত ও অপমানিত হচ্ছে, তার নাম হলো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। এই রমজান মাসেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চলছে। মাত্র কয়েক দিন আগে দেশটির বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তাদের আনন্দ-ফুর্তির ধর্মীয় উৎসব হোলি উদ্‌যাপন করার আয়োজনের অংশ হিসেবে প্রধান সড়কের পাশের সব মসজিদ ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল।

কারণ হোলির শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী উন্মত্ত হিন্দুদের মধ্যে মসজিদ দেখলেই নাকি সেটি বাবরি মসজিদের মতো ধ্বংস করবার বাসনা জাগ্রত হতে পারে। একই উত্তর প্রদেশে খালিদ প্রধান নামে আইআইএমটি ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে রাজ্যটির পুলিশ। খালিদের অপরাধ, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খোলা মাঠে তার সতীর্থদের জামাতে নামাজ পড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিল।

এক কট্টর হিন্দুর অভিযোগ অনুযায়ী, খালিদের পোস্টে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের ধর্মীয় অনুভূতিতে ভয়ানক আঘাত লেগেছে! এমন উদ্ভট অভিযোগ আমলে নিয়ে ভারতীয় পুলিশ মুসলমান ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করেছে। এটা বাংলাদেশের জনগণের কল্পনাতেও আসবে না যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হিন্দু ছাত্রকে শুধু দুর্গাপূজার ভিডিও পোস্ট করার ‘অপরাধে’ গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এই কয়েক মাস আগে এ দেশে দুর্গাপূজার সময় সংখ্যাগুরু মুসলমানরা পালা করে রাত জেগে মন্দির পাহারা দিয়েছে।

এর চেয়েও ন্যক্কারজনক ঘটনা মহারাষ্ট্রে ঘটেছে। সেই রাজ্যের নাগপুরে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কবর রয়েছে। নরেন্দ্র মোদির কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির রাজনৈতিক বয়ানে সর্বদা সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একজন অত্যাচারী ও হিন্দু নিধনকারী শাসকরূপে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এই বিষয় নিয়ে বলিউডে ইতিহাস বিকৃত করে এক সুপারহিট ও ইসলামোফোবিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে।

সেই সিনেমা প্রদর্শিত হওয়ার পর বিজেপির সন্ত্রাসী দুই অঙ্গসংগঠন বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আওরঙ্গজেবের কবর ধ্বংস করার জন্য সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তারা মোগল সম্রাটের কুশপুত্তলিকা ও কবরের পবিত্র কলেমাখচিত চাদর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। মুসলমানরা প্রতিবাদ করলে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। মধ্য যুগে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ভারত বিশ্বের অন্যতম প্রধান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলেও একবিংশ শতাব্দীর ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বয়ানে মোগল সম্রাটদের প্রধানত অত্যাচারী ও হিন্দুবিদ্বেষী রূপেই চিত্রিত করা হয়ে থাকে।

অথচ সব নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক মোগল শাসনব্যবস্থাকে সেক্যুলার বলেছেন এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সেই সময় ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আজকের আমেরিকার সঙ্গে তুলনীয় ছিল। সারা বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জিডিপি শুধু আওরঙ্গজেবের ভারতে উৎপাদিত হতো। এখন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি সারাবিশ্বের জিডিপি’র প্রায় ২৬ শতাংশ।

নাগপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গাবার্ড ভারত সফরে এসেছিলেন। অনেকে তুলসী গাবার্ডকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে ভুল করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে মাইক ও ক্যারোল গাবার্ডের মেয়ে তুলসী, আমেরিকান সামোয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, পলিনেশিয়ান সংস্কৃতিতে বড় হয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন।

বিতর্কিত হিন্দু সংগঠন ইসকন তুলসী গাবার্ডের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং ট্রাম্প প্রশাসনে গাবার্ডের গোয়েন্দা প্রধানের পদপ্রাপ্তিতে সংগঠনটি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নাগপুরে দাঙ্গা চলাকালে ভারতে অবস্থান করেও তুলসী গাবার্ড সে দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কে একটি বাক্য উচ্চারণ না করে বরঞ্চ বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। সংগত কারণেই বাংলাদেশ সরকার তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রেসিডেন্টের প্রথম মেয়াদের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফরকালে কট্টর হিন্দু দাঙ্গাকারীরা দিল্লিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের পুড়িয়ে মারছিল। সে সময়ও ট্রাম্প ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে নীরব ছিলেন।

উপসংহার : প্রায় এক যুগ আগে এই আমার দেশ পত্রিকার মন্তব্য-প্রতিবেদনেই লিখেছিলাম, মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই। ওই শিরোনামে আমার লেখা একটি বইও সে সময় একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। এক যুগ পর মুসলমানের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। আজ তীব্র মনোবেদনা নিয়ে আমাকে লিখতে হচ্ছে, মুসলমানের প্রাণের কোনো দাম নেই। এই পরিস্থিতির জন্য কি কেবল ইসরাইল, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিংবা অন্যান্য ইসলামোফোবিক পশ্চিমা রাষ্ট্র দায়ী? আমি মনে করি, এদের চেয়ে অনেক বেশি দায় বিলাসী, আত্মসম্মানহীন ও ভীরু তথাকথিত ইসলামি বিশ্বের।

মুসলিম শাসকদের মধ্যকার অনৈক্য, অদূরদর্শিতা ও কুৎসিত বিলাসব্যসনের অপচয়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রহীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং জনগণের মধ্যকার অশিক্ষা ও অলসতার মিলিত ফল হলো ২০০ কোটি মুসলমানের আজকের করুণ পরিণতি। আমরা নিজেরা না শুধরালে এই আশা করতে পারি না যে, কোনো এক জাদুবলে ইসলামোফোবিক পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর শাসকদের ‍হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটবে এবং তারা দয়াপরবশ হয়ে আমাদের প্রাপ্য সম্মান দিয়ে দেবেন।

এভাবে কখনো বিশ্ব ভূরাজনীতির পরিবর্তন হয় না। অর্থবহ পরিবর্তন ঘটাতে হলে মুসলিম বিশ্বের সংস্কার অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, মুসলিম বিশ্বের কায়েমি স্বার্থবাদীরা সহজে এই পরিবর্তন মেনে নেবে না। বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে রেখেছিল।

ভারতীয় সেবাদাস দানব শেখ হাসিনার পতন ঘটাতে জানা-অজানা অকুতোভয় তরুণদের নেতৃত্বে মহান বর্ষা বিপ্লব সংগঠিত করতে হয়েছে। তাদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই বিপ্লব হয়তো অনুপ্রেরণা জোগাবে।

মুসলমান সমাজের পথচলা দীর্ঘ হতে পারে। তবে হাল না ছেড়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাত্রা আরম্ভ করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রায়ন করা গেলে উম্মাহর সাধারণ স্বার্থে একতাবদ্ধ হওয়া সম্ভব।

সেইসঙ্গে শিক্ষার সার্বিক উন্নতি ঘটলে শিয়া-সুন্নি ও মাজহাবের অধিকাংশ মতভেদ বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপের মাধ্যমে দূরীভূত হবে। এই মৌলিক কাজগুলো অনিষ্পন্ন রেখে মুসলমানের দুর্গতি নিরসনের কোনো আশু সম্ভাবনা আমি দেখতে পাই না। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি—তিনি যেন আমাদের সঠিক পথ দেখান।