Image description
 

২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ এক ধ্বংসস্তূপের ছাইভস্ম থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে এখন একটি ক্রান্তিকাল চলছে। অবশ্য, এদেশের ইতিহাসে অনেকবারই ক্রান্তিকাল কথাটি উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু ক্রান্তিকালগুলো দেশকে সফল গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারেনি। নতুন ক্রান্তিকালের সূচনার প্রয়োজন হয়েছে। এ যাত্রায় যে ক্রান্তিকালের সূচনা হয়েছে, তার কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে কেন্দ্র করেই এ সময়ের বাংলাদেশ বিবর্তিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন ক্ষমতার তিনটি কেন্দ্র। এগুলো হচ্ছে-প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসমাজ। অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকদিন আগ পর্যন্ত অভ্যুত্থানকারী ছাত্রদের ৩ জন প্রতিনিধি ছিল। এদের একজন ছাত্রদের দ্বারা গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টিতে’ নেতৃত্ব দেবেন বলে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং এখন তিনি একজন প্রাইভেট সিটিজেনের ক্যাপাসিটিতে নতুন রাজনৈতিক দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

উল্লেখিত ক্ষমতার তিনটি প্রধান কেন্দ্রের বাইরেও রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর উপকেন্দ্র। এসব রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের অংশ না হলেও সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রশ্নে বিএনপি যখন বলল, তারা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষপাতী নয়, কারণ রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি, তখন অন্যরা বলেছিল একটি দল যখন ফ্যাসিস্ট হয়ে যায়, তখন গণতন্ত্রের স্বার্থে একে নিষিদ্ধ করাই শ্রেয়। এ প্রশ্নে কোনো ধরনের মূল্য বিচারে এ মুহূর্তে আমি প্রবেশ করতে চাই না। কারণ এ আলোচনাটি করতে হবে বিশাল ক্যানভাসজুড়ে, যে সুযোগ এ প্রবন্ধের সীমারেখার মধ্যে সম্ভব নেই। তবে ফ্যাসিবাদের শিকড়-বাকড়, উৎস মূল, আদর্শিক জটা-জালসহ সবকিছুর কবর রচনা করতে না পারলে শুধু আইনি বাধা আরোপ করে সাফল্য অর্জনের সুযোগ খুবই সীমিত। যাই হোক, এমন কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে, যা থেকে দেখা যায়, বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন শক্তিকেন্দ্র ও উপকেন্দ্রের রশি টানাটানির মধ্য দিয়ে স্থিতিতে পৌঁছেছে। এতে দোষের কিছু নেই। স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এমনটাই হয়।

সেই পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি, সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান দেশের অবস্থা নিয়ে মাস-পহেলা অথবা ঘটনা বিশেষকে কেন্দ্র করে জাতির উদ্দেশে রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতেন। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক ভাষণ দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মিডিয়াকেও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এসব সাক্ষাৎকারে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রচিন্তা, স্বদেশচিন্তা ও আর্থ-সামাজিক দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠেছে। এ সাক্ষাৎকারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, কালপ্রবাহে এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের বয়ান হিসাবে চিহ্নিত হবে।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ৭ মাস হয়ে গেল। সরকারের অর্জন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কার ও নির্বাচন, ছাত্র নেতৃত্বের নতুন দল গঠনসহ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কথা বলেছেন বিবিসি বাংলার সঙ্গে। প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিবিসি বাংলার সম্পাদক মীর সাব্বির। সাক্ষাৎকারটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ৪ মার্চ, ২০২৫ বিভিন্ন সংবাদপত্রে।

বিবিসি বাংলা থেকে বলা হয়েছে, ঠিক এক বছর আগে এর সম্পাদক মীর সাব্বিরের সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কথা হয়েছিল। তখন নাকি তিনি গ্রেফতার আতঙ্কের কথা বলেছিলেন। সেখান থেকে তিনি প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন এবং ৬ মাস পার হয়ে গেছে। জানতে চাওয়া হয়েছিল এ সময়টাকে তিনি কীভাবে দেখেন? তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে যা করতে চেয়েছিলেন তাতে কতটা সফল হয়েছেন? এ প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তার মধ্যে কোনো গ্রেফতার-আতঙ্ক বলে কোনো আতঙ্ক ছিল না। তবে তাকে যে কোনো সময় জেলে নিয়ে যেতে পারত, তাতে কিছুই করার ছিল না। যেহেতু দেশে আইনকানুন ছিল না এবং যথেচ্ছাচার চলছিল, তার মধ্য দিয়েই তার জীবন অতিক্রান্ত হচ্ছিল। তিনি ভাবেননি যে, তিনি হঠাৎ একটা সরকারের প্রধান হবেন এমন এক দেশে, যেখানে সব তছনছ হয়ে গেছে। কোনো জিনিসই ঠিকমতো কাজ করছে না, ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হবে।

 

তার প্রথম চেষ্টা ছিল সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আসল চেহারাটা বের করে আনা। মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে আনা। সেই চেষ্টার মধ্যেই তিনি ছিলেন। তারপর চিন্তা করলেন, ভবিষ্যৎটা কী হবে এবং কোন্ পথে জাতি এগোবে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সঠিক চিন্তাটাই করেছেন। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গিয়ে তিনি সংস্কারের চিন্তা করলেন। এ সংস্কারের চিন্তাটা এসেছে এই ভেবে যে, ১৬ বছর ধরে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ শাসন করেছে, কিন্তু তাকে প্রতিহত করার জন্য কিছুই করা যায়নি। ভোটারবিহীনভাবে তিন তিনটি নির্বাচন হয়েছে। অসংখ্য দুর্নীতি, ব্যর্থতা ও অপশাসনের গহ্বর থেকে দেশকে কীভাবে টেনে বের করে আনা যায়। টেনে বের করে আনতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারগুলো করতে হবে। সেজন্যই সংস্কারের কথা ভাবা হয়েছে।

আমার মনে হয়, সংস্কারের নানা প্রকরণ নিয়ে যত কথা বলা যায়, করাটা তত সহজ নয়। বুঝতে হবে কোন্ সংস্কারটা যথাযথ এবং সময়োপযোগী। বুঝতে হবে সোশ্যাল ডিনামিক্সের সঙ্গে কোন্ সংস্কারগুলো সংগতিপূর্ণ। সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়েও ভাবতে হবে। এ প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে কার্যনির্বাহী আদেশ, আইনি বিধি-বিধান তৈরি এবং সাংবিধানিক বিধি-বিধানের অন্তর্ভুক্তকরণ। এ প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অন্তর্নিহিত জটিলতা রয়েছে। সে কারণে যে কোনো দেশে সংস্কার প্রক্রিয়া এক অর্থে বিপ্লবের চেয়েও কঠিন। চীনারা ১৯৭৮ সাল থেকে সংস্কার করে চলেছে। তবুও সংস্কারের শেষ নেই। চাই সংস্কার, আরও সংস্কার। এটা সম্ভব হয়েছে গোটা চীনা জাতির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোধোদয় ঘটার ফলে। আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঠিক সংস্কার নিয়ে বোধোদয় হতে হবে। সেই বোধোদয় ঘটানোর কাজটি দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। সংস্কারকে নিছক ছেলেখেলা মনে করা সঠিক নয়।

বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দেশ এবং দেশের বাইরে তাদের ওপর আস্থা আছে কিনা সেটাই বড় কথা। তিনি মনে করেন, তাদের ওপর দেশের মানুষের বিপুল পরিমাণে আস্থা আছে। তবে কী করছেন বা কী করছেন না, সেগুলো খুচরা বিষয়। কিছু বিষয়ে ভালো ও কিছু বিষয়ে মন্দ থাকতে পারে। এটা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস অস্বীকার করেননি। অনেকের দৃষ্টিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং তারা নানারকম আতঙ্কে আছেন, এ রকম পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধান উপদেষ্টা জবাবে বলেছেন, কোন রেফারেন্স পয়েন্ট থেকে পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে, সেটা না বললে তো পরিস্থিতিটা বোঝা যাবে না। এ ব্যাপারে অপরাধসংক্রান্ত পুলিশের পরিসংখ্যানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানান, তারা চেষ্টা করছেন। সমস্যার কথা সবাই জানেন। প্রথম দিকে সমস্যা ছিল পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে, তারা ভয়ে রাস্তায় নামছিল না। এটা ঠিক করতেই কয়েক মাস চলে গেল। এখন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে। কাজেই নিয়মশৃঙ্খলার পথে অগ্রগতি হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা যায়, দেশে মব-জাস্টিসের ঘটনা বেড়ে চলেছে। পত্র-পত্রিকায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ পাচ্ছে। তমসাবাদী গোষ্ঠীগুলো ক্ষেত্র বিশেষে নারীদের হেনস্তা করছে। এগুলো বন্ধ করা প্রয়োজন। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার পরপর শেখ মুজিবের শাসনামলে অনেক মব-জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছিল। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে কেউ একজন আঙুল তুলে বলল, ওই রাজাকার, আর যায় কোথায়? উন্মত্ত জনতা হিংস্র হায়েনার মতো ওই পথচারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং মুহূর্তের মধ্যে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। এর সুযোগে অনেকে শত্রুতা উদ্ধার করেছে। তবে সময়ে এ প্রবণতা অনেকটুকুই হ্রাস পেয়েছিল। বর্তমান সময়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ করতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। দেশে যতরকম প্রচার মাধ্যম আছে, সেগুলোর সুনির্দিষ্ট একটি স্পেস এ সচেতনতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করতে হবে। এ প্রয়াসে দেশের বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সমাজনেতা, শিক্ষক ও উলামাদের কাজে লাগাতে হবে।

বিবিসি বাংলা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রশ্ন করেছিল, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কা আছে কিনা। সরকারপ্রধান হিসাবে তিনি কী মনে করেন? জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এ শঙ্কা তো সবসময় থাকে। একটা পলাতক দল দেশ ছেড়ে চলে গেছে বা তাদের নেতৃত্ব চলে গেছে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে দেশটাকে আনসেটেল করার জন্য। একথা সত্য, সবসময় থ্রেট আছেই। প্রতিক্ষণেই আছে, প্রতি জায়গাতেই আছে। কাজেই এটা হয়তো সবসময়ই থাকবে।বিষয়টি খোলাসা করার জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল হুমকিটা কি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ থেকে? জবাবে তিনি বললেন, অবশ্যই, এটা তো অনস্বীকার্য। তারা মাঝে-মধ্যেই ঘোষণা করছে। বক্তৃতা দিচ্ছে। এড্রেস করছে। সবাই তা শুনছে। মানুষ উত্তেজিত হচ্ছে।কারোর কারোর কাছে বিষয়টি তত স্পষ্ট না হলেও প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের দৃষ্টিতে খুবই স্পষ্ট। রাজনীতি ও ক্ষমতার সংগ্রামে জানা প্রয়োজন, Who are our enemies; who are our friends. এই প্রশ্নে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন না, সেটা তো স্পষ্ট।জাতীয় ঐক্য, সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক ভাষণ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ বা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, এসব নিয়েও প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রশ্ন করেছিল বিবিসি বাংলা। এগুলো নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা এ যাত্রায় সম্ভব হলো না। বারান্তরে করা যাবে আশা করি।

 

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ