Image description

মনোজ দে

 

এবার একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচারে একজন তরুণী নতুন বাংলাদেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছিলেন। খুব দ্বিধাহীনভাবে তিনি বলছিলেন, সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে দায়িত্ব নেওয়া সরকারের কাছে তাঁর প্রত্যাশা হলো, তিন বেলা খেয়ে-পরে যেন ভালোভাবে থাকতে পারে, আর ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে যাতে আবার ঘরে ফিরতে পারে। ছয় মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে শুধু এই মধ্যবিত্ত তরুণীর নয়, বাংলাদেশের সব মানুষের এখনকার সাধারণ চাওয়া এটি।

ছাত্রদের নতুন দলের নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক, অভ্যুত্থানে কার কতটা ভূমিকা এবং কে কার চেয়ে বড় মাস্টারমাইন্ড, এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে আগের চেয়ে কতটা পার্থক্য দেখা গেল, বাংলাদেশের দুজনের কোন সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন, এসব বিষয় নিয়ে গত কয়েক দিন ফেসবুক সরগরম হয়ে আছে।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ফেসবুকের নিউজফিডে একের পর এক খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনার পোস্ট, ফটোকার্ড, সংবাদ, ছবি, ভিডিও ভেসে আসছে। এর মধ্যে রাজধানীর বনশ্রীতে দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে মোটরসাইকেলে করে আসা ডাকাতেরা গুলি করে সোনা ও টাকা লুট করে নেওয়ার ভিডিও অসংখ্য মানুষ শেয়ার করে সবাইকে সতর্কভাবে চলার কথা বলেছেন। ভিডিওতে আক্রান্ত ব্যবসায়ী বারবার করে ‘ও আম্মাগো’ বলে চিৎকার করছিলেন। সেই চিৎকার সবার মাঝেই ভয় ছড়িয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

আরেকটি সিসিটিভির ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পথের কুকুরকে খাবার দিতে যাওয়া এক দম্পতিকে রামদা হাতে কয়েকজন ছিনতাইকারী ঘিরে ধরেছে। আরেকটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রামদা, চাপাতি হাতে কিশোর বয়সী দুই ছিনতাইকারী জ্যামে আটকে থাকা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে কীভাবে মুঠোফোন নিয়ে সটকে পড়ছে। সবার সামনেই অস্ত্র হাতে তারা ছিনতাই করছে। সেই ছিনতাইয়ের ভিডিও ফেসবুকে আসছে। সম্প্রতি এ রকম ছিনতাই, ডাকাতি যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আগে যেমন রাতে ও ভোরের দিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যেত, কিন্তু এখন সন্ধ্যায় ও দিনের বেলাতেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। শুধু ছিনতাই নয়, সংঘবদ্ধ চুরি, ডাকাতির ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। সিসিটিভির কারণে সেসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসছে।

একের পর এক এসব অপরাধের ঘটনা নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ তৈরি করছে। এর মধ্যে আবার ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোও নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নকে আরও তীব্র করে তুলছে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন এবং এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ সবার মধ্যেই আতঙ্ক তৈরি করেছে।

বাস ডাকাতির ঘটনাটি ঘটেছে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে। মূলধারার গণমাধ্যমে এসেছে এরও দুই দিন পর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার তিন দিন পর পুলিশ মামলা নিয়েছে।

মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘গুলিবিনিময়কালে’ যে দুজন নিহত হয়েছেন, তাঁর একজন জুম্মন। টিবিএসের খবর জানাচ্ছে, সাবেক টাইলস মিস্ত্রি জুম্মন গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চাকরি হারান। পরে মিরাজের সঙ্গে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ে যোগ দেন তিনি। ফলে মানুষ কাজ হারাতে থাকলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধ কমানো কতটা সম্ভব?

কল্পনা করুন তো, তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতেরা বাসটিতে ডাকাতি করেছে। এরপর তারা নিরাপদে নেমে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাঁরা সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাঁদের মানসিক ট্রমা কতটা গভীর হতে পারে। অথচ ভুক্তভোগী নারীদের এবং সর্বস্ব হারানো যাত্রীদের গভীর রাতে রাস্তার মধ্যেই ফেলে রেখে চলে আসতে চেয়েছেন বাসচালক ও তাঁর সহকারীরা। যাত্রীদের চাপে শেষমেশ বাস চালাতে রাজি হয়েছেন।

এরপর তাঁরা বাস নিয়ে দুটি থানায় গেছেন। ডাকাতির ঘটনা তাঁরা বর্ণনা করেছেন। সহযাত্রী নারীরা যৌন নিপীড়নের এবং তাঁদের একজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন বর্ণনাও তাঁরা দিয়েছেন। কিন্তু দুটি থানার কোনটিই তাঁদের মামলা নেয়নি। ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেনি। তৃতীয় থানায় গিয়ে তাঁরা তাদের অভিযোগ জানাতে পেরেছেন। কি অদ্ভুত নিয়ম! চলন্ত বাসে কোন থানার মধ্যে অপরাধ হয়েছে, সেটা প্রমাণের দায়িত্ব কি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের?

পুলিশ তাদের দুজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। পুলিশ বলেছে, বাসে ধর্ষণ হয়নি, শ্লীলতাহানি হয়েছে। প্রথমত, ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দটাই আপত্তিকর ও রাজনৈতিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক। দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগী নারীদের বক্তব্য না শুনে এই উপসংহারে তারা কীভাবে পৌঁছাতে পারে? ২৩ ফেব্রুয়ারি যমুনা টেলিভিশনে বাসের একজন নারী যাত্রী ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে তিনি দাবি করেছেন, একজন নারীকে তাঁর ভাইয়ের পাশ থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ডাকাতেরা ‘ধর্ষণ’ করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ কেন ঘটনার এক সপ্তাহ পরও ভুক্তভোগী নারীদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি?  নিরাপত্তা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, সেটা বের করার ব্যাপারে তাদের এমন অনাগ্রহ কেন?

গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশি ব্যবস্থা যখন একেবারে ভেঙে পড়েছিল, তখন জননিরাপত্তা নিয়ে নানা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মানুষ ছিল তখন ঐক্যবদ্ধ। পাড়ায় পাড়ায় পাহারা দিয়ে ছাত্র-জনতা অপরাধীদের প্রতিহত করেছে। অভ্যুত্থানের ছয় মাস পর, বিশেষ করে যখন অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ নামের বিশেষ অভিযানে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই সময়ে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুরো শক্তিকে রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তারে নিয়োজিত করা হয়েছে?

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে। সেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা তাঁরা করেছেন। কেউ কেউ তাঁর পদত্যাগও দাবি করেছেন। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গতকাল রোববার দিবাগত রাত ৩টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের দোসরেরা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দায় দেওয়া হলে সেটা মানুষকে কতটা আশ্বস্ত করতে পারে? সবচেয়ে বড় কথা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাত ৩টার সংবাদ সম্মেলনে নাগরিকেরা আশ্বস্ত হওয়ার বদলে উদ্বিগ্ন হন।

গত কয়েক মাসে দেশের ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে পাড়ার মোড়ের পানের দোকানি—সবার মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। ব্যবসায়ীরা এমনটাও বলেছেন, সামগ্রিকভাবে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে, তাতে তাঁরা কেন তাঁদের টাকা বিনিয়োগ করবেন। দেশে গত ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমে গেছে, তারও মূল কারণ এই অনিশ্চিত পরিবেশ।

অপরাধ বেড়ে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হওয়া—এ তিনের সঙ্গে আইনের শাসন ও অর্থনীতির প্রশ্নটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘গুলিবিনিময়কালে’ যে দুজন নিহত হয়েছেন, তাঁর একজন জুম্মন। টিবিএসের খবর জানাচ্ছে, সাবেক টাইলস মিস্ত্রি জুম্মন গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চাকরি হারান। পরে মিরাজের সঙ্গে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ে যোগ দেন তিনি। ফলে মানুষ কাজ হারাতে থাকলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধ কমানো কতটা সম্ভব?

মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ তৈরি হয়েছে, সেটা সরানোর দায়িত্ব সরকারের। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরা কিংবা ঘরে ফিরে চুরি, ডাকাতির আতঙ্ক নিয়ে রাত যাতে জাগতে না হয়, সেই চাওয়াটা কি খুব বেশি?

  • মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় মন্তব্য