Image description
 

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কালে ভারত হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বরকন্দাজ। একই সঙ্গে চীন ঠেকানোর জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ভারতকে এশিয়ার উদীয়মান শক্তি হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করে। এর ফলে ভারতের জনমানসে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়—‘ভারত হয়তো এশিয়ার সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে।’ ভারতীয়দের মধ্যে উগ্রজাতীয়তাবোধ তীব্র রূপ নিতে থাকে। এর হাত ধরে উত্থান ঘটে ভয়ংকর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির।

 

এই সময়ে ভারতে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অবনমন ঘটলেও সামরিকায়ন ঘটে দ্রুত বেগে। বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় ভারত। এমনকি সৌদি আরবকে টপকে ভারত শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সিপ্রির তথ্য অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভারত টানা শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। একই সময় বিশ্বের দ্বিতীয় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হলো সৌদি আরব। সিপ্রির তথ্যমতে, অস্ত্র আমদানির পেছনে বছরে ভারতের খরচ কমপক্ষে ১২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৯ দশমিক ৮ ভাগ আমদানি করেছে ভারত। ভারতের সমরাস্ত্র আমদানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল নাগাদ ভারতের অস্ত্র আমদানি বেড়েছে ৪ দশমিক ৭ ভাগ।

 

সামরিক ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে দেশটি। অস্ত্র আমদানির এই প্রতিযোগিতা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রসদ জোগালেও ভেতর থেকে ভারতের যে উন্নয়ন হওয়ার কথা তা থমকে যায়। ধর্মীয় ও বর্ণবাদী রাজনীতি ভারতকে ভয়ংকর গণহত্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জেনোসাইড ওয়াচের গ্রেগরি স্টান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ভারত বড় ধরনের এক গণহত্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এর কারণ হচ্ছে, সমাজে তীব্র মাত্রায় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। একটি অংশকে বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে নির্মূল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

 

ভারতের ভেতরের এই গভীর সংকটের মধ্যে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে আধিপত্যবাদী নীতি আরো জোরদার হয়েছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান দেশটির নিরাপত্তার জন্য বড় সংকট। কারণ দেশটির পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তজুড়ে রয়েছে বৈরী দুটো দেশ চীন ও পাকিস্তান। দুটি দেশ সামরিক দিক দিয়ে ভারতকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা রাখে। এর মধ্যে ১৯৬২ সালে চীনের কাছে ভারতের শোচনীয় পরাজয় ভারতের মানুষের মনস্তত্ত্বে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। অবশ্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতকে এক ধরনের বিজয়ের স্বাদ এনে দেয়, যদিও মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে ভারত অংশ নিয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রভাববিস্তারের নতুন কৌশল গ্রহণ করে। এর মধ্যে ১৯৭৪ সালে সিকিমকে ভারতের অঙ্গীভূত করা হয়। ভারতের সহায়তায় সিকিমের তৎকালীন ভারতপন্থি রাজনৈতিক দল সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংবিধান সংশোধন করে ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।

 

সিকিমকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার এই সাফল্য ভারতকে বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করার মতো সাহসী করে তোলে। এর ফলে আমরা দেখি ভারত ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কায় এবং ১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে। ভারতের এ ধরনের হস্তক্ষেপ এসব দেশের মানুষকে ভারতের ব্যাপারে আরো বেশি বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এমনকি ভারতকে তারা একটি শত্রু দেশ হিসেবে মনে করে থাকে।

 

পরবর্তী সময়ে ভারত অন্য কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ না করলেও সিকিমের সাফল্য থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোয় একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে একই রকম কৌশল দেখা যায়। এসব দেশে ভারতপন্থি একটি করে রাজনৈতিক দল রয়েছে, যে দলগুলো শুধু ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে না, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের পথ করে দেয়। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তে বিশেষ দলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে এসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে থাকে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে বড় বাধা।

 

Alfaz-Anam 2

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেও বারাক ওবামার সময় ২০০৯ সাল থেকে ভারত এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এই সুযোগে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোয় ভারত অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। মাওবাদী দলগুলো দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ সময়ে নেপালের রাজনীতিতে কলকাঠি নেড়ে নেপালি কংগ্রেসকে ক্ষমতার অংশীদার করার চেষ্টা করে ভারত। নেপালের মানুষ এতটাই ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল যে ভারতপন্থি দলটি ধীরে ধীরে নেপালের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে নেপালিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য একাধিকবার দেশটির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করেছিল। এর ফল হিসেবে নেপাল চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভূবেষ্টিত নেপাল ভারতের পরিবর্তে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। নেপালের অবকাঠামো খাতে চীনের বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা এখন অনেকটা কমে এসেছে।

 

মালদ্বীপে দীর্ঘদিনের শাসক মামুন আবদুল গাইয়ুমের পদত্যাগের পর ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ নাশিদ ক্ষমতায় আসেন। এরপর মোহাম্মদ সলিহকে সমর্থন দেয় ভারত। দীর্ঘসময় ভারতপন্থি দুটি দল মালদ্বীপে ক্ষমতায় ছিল। ২০১৩ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের বিজয়ের পর মালদ্বীপের পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটে। মালদ্বীপের সর্বশেষ নির্বাচনে ইনডিয়া আউট কর্মসূচির মাধ্যমে বিজয়ী হয়েছেন মোহাম্মদ মইজ্জু, যিনি আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সময় মালের মেয়র ছিলেন। পরে অবশ্য তিনি আলাদা দল গঠন করেন। ইয়ামিনকে মুক্ত না করে কারারুদ্ধ করে রাখেন। সম্প্রতি তিনি ভারতের সাথে সর্ম্পক তৈরির চেষ্টা করছেন, তার এই নীতি মালদ্বীপের মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। মইজ্জুর জনপ্রিয়তা এখন কমে আসছে।

 

চীনের বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে ইয়ামিনের সময় যে উন্নতি হয়েছে, তা মালদ্বীপের মানুষকে চীনের প্রতি যেমন আগ্রহী করে তোলে, তেমনি ভারতের প্রতি অনীহা তাদের মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে দুটো দ্বীপের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সমুদ্রের মধ্যে চীনের সাহায্যে এক মাইলের বেশি দীর্ঘ একটি ব্রিজ স্থাপন করা হয়, যা মালদ্বীপের যোগাযোগে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। চীনের সাহায্যে নির্মিত এই ব্রিজটি মালদ্বীপের মানুষের মধ্যে চীনা বন্ধুত্বের একটি প্রতীক হয়ে আছে। মালদ্বীপের রাজনীতিতে আগামী দিনে ভারতের ভূমিকা যে আরো কমে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে বিতর্কিত এক নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতপন্থি রাজনৈতিক দলের প্রধান শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। এরপর টানা দেড় দশক ভারতের সমর্থন নিয়ে তিনি নিষ্ঠুর স্বৈরশাসন কায়েম করেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বড় পার্থক্য হলো ভারতের সমর্থনপুষ্ট হাসিনা সরকার দেশের মানুষের ওপর ভয়াবহ এক নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে দেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়। শেখ হাসিনা মূলত একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেন। তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণআন্দোলন দমনে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেন। ভারতের প্রতিবেশী আর কোনো দেশে এভাবে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ভারতপন্থি সরকারের পতন ঘটেনি।

 

হাসিনার পতনের পর তার নিষ্ঠুর শাসনের পেছনে ভারতের নিবিড় সংযোগের তথ্য সামনে আসছে। ভারত শুধু হাসিনার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে কূটনৈতিক সমর্থন দেয়নি, একতরফা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আদায়ে চাপ সৃষ্টি করেছে। ভারতের সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দাদের তৎপরতা ছিল ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশের মানুষ দৃঢ়ভাবে মনে করে হাসিনা নিজ দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছে, তাতে ভারতের সমর্থন ছিল। একাধিক বিরোধী দলের নেতাকে গুম করে ভারতে আটকে রাখা হয়। এমনকি হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর দাবি করেছেন, বিক্ষোভ দমনে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের অংশ নেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য তাদের কাছে আছে।

 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় দিল্লির সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি ও ভারতের স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র হতে থাকে। নেপাল, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে ভারতপন্থি দলগুলো যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে ভারতের ব্যাপারে প্রকাশ্য ভূমিকা নিতে হচ্ছে।

 

ভূখণ্ডগত অবস্থান, জনসংখ্যা ও অর্থনীতির বিচারে নিঃসন্দেহে ভারত এশিয়ার প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি। একই সঙ্গে ভারত এমন এক দেশ, যেদেশের চারপাশে প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণ দেশটিকে শত্রু হিসেবে গণ্য করে। ভারত এই প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে সব সময় বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে পুতুল শাসকশ্রেণি তৈরি করার চেষ্টা করে আসছে। ফলে এসব দলের অন্যায় কার্যক্রমের দায় ভারতকে নিতে হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশে প্রভাববিস্তারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এই কৌশল বারবার ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ভারত আধিপত্যবাদী এই কৌশল পরিত্যাগ করতে পারছে না। এর ফলে শুধু চীন ও পাকিস্তান নয়, প্রতিবেশী কোনো দেশই আর ভারতকে বন্ধু ভারতে পারছে না। ভারত হয়ে উঠেছে বন্ধুহীন এক দেশ।

 

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ