![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/02d43a680eefbbed28caf46249cdf048.png)
সোহরাব হাসান
গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ৩২ নম্বরের প্রায় গুঁড়িয়ে দেয়া বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে তিন শ্রেণির মানুষকে পেলাম। এক শ্রেণির মানুষ ভবনটির ভাঙার পক্ষে নানা যুক্তি দিচ্ছিলেন, পাশের বাড়ির মেঝের নিচে কয়টি তলা আছে, সেখানে রহস্যজনক কিছু আছে কিনা, তারও বর্ণনা দিচ্ছিলেন একজন। আশপাশের লোকজন কৌতূহল নিয়ে তার কথা শুনছিলেন। আরেক শ্রেণির লোক পরিত্যক্ত লোহার রড, জানালা-দরজা, ইট ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছিলেন রিকশায় করে। গরিব মানুষ হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা-ই নিয়ে যাচ্ছিলেন। আবার কেউ রিকশা ডেকে আনছিলেন ভাঙা আসবাবপত্র নিয়ে যেতে। একজন তরুণকে দেখলাম পাশের বাড়ির দেয়ালের রড কাটছিল একটি যন্ত্র দিয়ে। পাশে বিদ্যুতের খাম্বা ছিল, যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো।
আরেক ধরনের মানুষ সেখানে গিয়েছিলেন, যাদের সংখ্যাই বেশি, এসেছেন কৌতূহলবশত। এটি তাদের কাছে কেবল একটি বাড়ি নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত একটি হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন। একাত্তরের মার্চে এই ৩২ নম্বর থেকেই স্বাধীনতার আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল। এদের মধ্যে দু’একজন পরিচিত মানুষ পেলাম। তারা হতবিহ্বল। বললেন, ভারত থেকে শেখ হাসিনা যে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন, তা তরুণদের ক্ষুব্ধ করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি ভেঙে দেয়া হলো কেন? শেখ হাসিনা তো এখানে বসে সরকার চালাননি।
গাড়ি থেকে নামার সময় শুনলাম, একজন ভদ্রমহিলা অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘জয় বাংলা।’ আশপাশের কেউ শুনতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। তবে কেউ বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাননি। ভদ্রমহিলা ভেতরে ঢুকে সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে ভাঙা বাড়ির কয়েকটি ছবিও তুললেন। আগের দিন একজন নারী নিগৃহীত হয়েছিলেন ‘জয় বাংলা’ বলে।
কিন্তু এই বিশাল চত্বরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কোনো নেতা-সমর্থককে পেলাম না। গত বছর ৫ই আগস্ট ‘বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’ পুড়িয়ে দেয়ার পর রোকেয়া প্রাচীসহ কয়েকজন শিল্পী এসেছিলেন প্রতিবাদ জানাতে। এবারে কেউ এলেন না। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের দাপটে সাধারণ মানুষ ৩২ নম্বরে ঢুকতে পারতো না। এখন সেটি বিরান ভূমি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পরও আমরা একই চিত্র দেখেছি। তখন বাড়িটি ছিল, এখন বাড়িটিও নেই।
গত বছর ৫ই আগস্টে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পনের বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কি? আওয়ামী লীগ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? আওয়ামী লীগের অবস্থা কি তার পূর্বসূরি মুসলিম লীগের মতো হবে?
এই প্রশ্নের সরল উত্তর নেই। একটি রাজনৈতিক দল তখনই দল হয়ে ওঠে যখন সেটি নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে চলে। একটি রাজনৈতিক দল তখনই দল হয়ে ওঠে যখন সেটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। যারা গত পনের বছর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা দলের নীতি-আদর্শের কথা মুখে বললেও পালন করেননি। তৃণমূল থেকে শীর্ষ স্তর পর্যন্ত দল চলেছে স্বেচ্ছাচারী কায়দায়। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ছিলেন কোণঠাসা। সুযোগ সন্ধানীর দাপট ছিল সর্বত্র। দলে রাজনীতির চর্চা ছিল না, ছিল ক্ষমতা চর্চা।
যেই নেতৃত্ব এত বড় ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানকে অস্বীকার করে তাদের আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের নেতৃত্ব দেয়ার নৈতিক অধিকার আছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা তো দেশে থেকেই মামলা-হামলা মোকাবিলা করলেন, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে গেলেন কেন? দেশি- বিদেশি সংবাদমাধ্যমে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-নেতাদের দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থ পাচারের যেসব ভয়াবহ খবর এসেছে, তাতে মনে হয় না এসব মোকাবিলার নৈতিক সাহস তাদের আছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনরোষের মুখে না হয় দেশ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তার সরকার ও দলে যে তাবৎ তাবৎ নেতা ছিলেন, কর্মীদের বিপদে ফেলে তারা পালিয়ে গেলেন কেন? তারা আওয়ামী লীগ কথিত সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন না কেন? ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির পর তার দলের ডজনখানেক কর্মী-সমর্থক রাগে ক্ষোভে আত্মহত্যা করেছিলেন। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশেও সীমিত পর্যায়ে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়েছিল। কিন্তু ৫ই আগস্টের পর কোনো প্রতিবাদ হলো না। এটা আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয়।
এই পরাজয় থেকে দলকে উদ্ধার করতে হলে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন-এ কথা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী বলেছেন। তাদের অভিযোগ- যে দলের নেতারা কর্মীদের বিপদে ফেলে পালিয়ে যান, তাদের হাতে দল নিরাপদ থাকতে পারে না।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, যিনি আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ভারতে চলে গেছেন। তিনি বলেছেন, গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে দায় এড়ানো যাবে না। গোয়েন্দাদের কাছে যদি তারা ‘দেশের সবকিছু ঠিক আছে’ শুনতে চান, তারা তো সেটাই বলবেন। তাদের মিথ্যা ছলনায় ভুলাবেন। সামরিক গোয়েন্দাদের দায় না হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছিল না। কিন্তু তিনি বেসামরিক গোয়েন্দাদের দায় এড়াবেন কীভাবে? সপ্তাহখানেক ধরে ডিবি অফিসে আন্দোলনকারী চার তরুণ ও এক তরুণীকে আটকে রাখা হলো কেন? যখন পুরো দেশ সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে তখন ডিবি হারুনের নাটক মানুষকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করেছে।
অনলাইন আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘আফটার দ্য ব্লাডশেড: ক্যান আওয়ামী লীগ রিসারেক্ট ইটসেল্ফ?’ শীর্ষক প্রতিবেদন করেছে। এর মূল কথা হলো: আইনপ্রয়োগকারীদের হামলায় বিক্ষোভকারী এবং পথচারীদের কমপক্ষে ৮৩৪ জন প্রাণ হারান। এই বিক্ষোভ শুরু হয় ১লা জুলাই। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাওয়ার মধ্যদিয়ে তার ইতি ঘটে। তবে হামলায় আহত হন কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ। তার মধ্যে আছেন শিশু ও নারী।
এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ও আহত হওয়ার দায় কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এড়াবেন? আত্মগোপনে থাকা তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলেছেন, ২০১৪ সাল থেকে সুযোগ সন্ধানীরা ও স্থানীয় এমপিদের পরিবারের সদস্যরা তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় কাঠামোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এর ফলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।
বাস্তবতা হলো, জুলাই-আগস্টে যে এত বড় হত্যাযজ্ঞ হলো, এত মানুষ আহত হলেন, তার দায় স্বীকার করেনি আওয়ামী লীগ। তারা আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাও চায়নি। বরং বরাবর পুরো ঘটনাকে অস্বীকার করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে।
প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী হবে? কারা দলটির নেতৃত্ব দেবেন। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বেশির ভাগ নেতা পলাতক কিংবা কারাগারে। এ অবস্থায় কোনো দল সংগঠিত হতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতারা ভাবছেন, ফেসবুক ইউটিউব দিয়েই দল চালাবেন। কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। তাদের এই চিন্তাটা যে কতোটা আহাম্মকি সামপ্রতিক ঘটনাবলিই তার প্রমাণ। মানুষ গত জুলাই-আগস্টের অপরাধ অনেকটা ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধানের উস্কানিমূলক বক্তৃতা জনগণকে ফের ক্ষুব্ধ করেছে। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি জনগণের ভাষা না বোঝে, তাদের নেতৃত্ব দেয়ার নৈতিক অধিকার আছে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন।
আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, ‘যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলে দলটির পা রাখার জন্য একটি জায়গা সৃষ্টি হবে। তবু নেতৃত্ব, সংগঠন ও তৃণমূল পর্যায়ে গণসংযোগের মাধ্যমে জনআস্থা পুনর্গঠন ছাড়া আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতিতে পুনরুজ্জীবন লাভ করা হবে অত্যন্ত জটিল।’
সমস্যা হলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র রাজনীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। দলের প্রধান কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই দল পরিচালনার ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতে আছেন। তার পক্ষে সেখান থেকে দল পুনর্গঠন কোনোভাবে সম্ভব নয়। আবার তিনি কাউকে দায়িত্বও দিচ্ছেন না। সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ কয়েকজন তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন নেতার নাম শোনা গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসী নেতৃত্বের সবুজ সংকেত পাওয়া যায়নি।
পঁচাত্তরের পর শেখ হাসিনার দেশে আসার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পারিবারিক বলয়ের বাইরেই ছিল। তারপরও দলটির ঘুরে দাঁড়াতে সমস্যা হয়নি। বরং নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হয়েছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগকে নতুন নেতৃত্বের বিষয়েও নতুন করে ভাবতে হবে।
মাসুদ হাসানুজ্জামানের ভাষায়, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সেই পা রাখার জায়গা পাবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে। আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোনোভাবে সুযোগ দেয়া হবে না। কেউ কেউ নিষিদ্ধ করারও দাবি জানিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোও প্রায় একই মনোভাব পোষণ করে। তবে যেই দলটি আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে ১৫ বছর নির্যাতন- নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাদের নেতারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার বিষয়টি দেখছেন উদারভাবে। তারা বলেছেন, কোনো দল নিষিদ্ধ করা তাদের কাজ নয়। জনগণই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।