Image description

গত বুধবার ‘গিরগিটি সাংবাদিকতা’ শিরোনামে লেখা মন্তব্য-প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কজন ঘোরতর ভারত ও আওয়ামীপন্থি সাংবাদিক ও সম্পাদকের রং বদলানো এবং বিএনপির পক্ষপুটে আশ্রয় নেওয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছিলাম। সেই লেখায় প্রথম আলো গ্রুপের ২০০০ নামক ম্যাগাজিনের সম্পাদক এবং বর্তমান সরকারের আমলে সচিব পদমর্যাদায় ওয়াশিংটনে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজার কথাও প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল।

আমার লেখার প্রতিবাদ করে গোলাম মোর্তোজা তার ইউটিউব চ্যানেলে কদিন আগে একটি কনটেন্ট তৈরি করেছেন। আমি তার সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তিতে অভিনন্দন এবং ইউটিউব কনটেন্টটির জন্য ধন্যবাদ জানাই। কারণ একে তো আমি বাক ও মিডিয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ, তার ওপর গোলাম মোর্তোজা আমাকে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য পাঠকদের জানানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।

আমি কলম ব্যতীত আর কোনো অস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত নই। ওই হাতিয়ারটি দিয়েই বিগত ১৮ বছর ধরে ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমার একমাত্র অস্ত্র সেই কলম কেড়ে নেওয়ার জন্য হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার এক আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া আর সব অস্ত্রই ১৫ বছরে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল।

আমি রিমান্ডে নির্যাতিত হয়েছি, র‍্যাবের আয়নাঘরে গিয়েছি, জেলে গিয়েছি, শত মামলার আসামি হয়েছি, আওয়ামী আদালত আমাকে সাজা দিয়েছে, আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অবশেষে নির্বাসিত হয়েছি।

আমি যখন কুষ্টিয়ার আদালতে হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রক্তাক্ত হয়েছি, আমার জীবন বিপন্ন হয়েছে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করেছি, তখন ‘অধুনা জনপ্রিয় তথাকথিত আওয়ামীবিরোধী ইউটিউবার’ গোলাম মোর্তোজারা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছেন, আনন্দ পেয়েছেন। উল্লিখিত কনটেন্টেও আমার ওপর জুলুমে তার সন্তোষ লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুমকে ভাষার মারপ্যাঁচে জাস্টিফাই করেছেন। তার এই স্বচ্ছতা প্রশংসার দাবি রাখে।

হাসিনার জামানায় আমার দেশ বন্ধ হয়েছে, শত শত সাংবাদিক বেকার হয়েছেন, আর এসব সুশীল সম্পাদকরা হাততালি দিয়েছেন। জন্মাবধি ইসলামবিদ্বেষ লালনকারী এই গোষ্ঠী বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিংবা ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো সাংবাদিক, লেখক ও সংবাদমাধ্যমকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।

সংবাদমাধ্যমে আমাদের মতো ব্যক্তিদের প্রবেশকে তারা সর্বশক্তি দিয়ে রুদ্ধ করতে চান। তবে কালের পরিক্রমায় যারা একসময় আমাদের অচ্ছুৎ করতে চেয়েছিলেন, জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে তারাই আজ গণমানুষের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে গেছেন। এখন তাদের রক্ষা করার জন্য সরকারি পাহারার প্রয়োজন হয়। যাই হোক, গোলাম মোর্তোজার কনটেন্টে ফিরে আসি।

গোলাম মোর্তোজা তার কনটেন্টে ২০০৪ সালে তারই পুরোনো লেখায় ভারতের প্রতি আবেগপ্রবণতার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে তিনি আমার সম্পর্কে অসত্য ও অর্ধসত্য প্রচারণা চালিয়েছেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গোলাম মোর্তোজার মতো ভারতের প্রতি কোনো বিশেষ ধরনের আবেগ অনুভব তো করেই না, বরং স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির চরম আধিপত্যবাদী আচরণকে অত্যন্ত সংগত কারণেই ঘৃণা করে।

অর্ধ শত বছরের বেশি সময় ধরে সঞ্চিত সেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আমরা ৩২ ধানমন্ডিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার মধ্যে দেখতে পেয়েছি। ৩২ শুধু ফ্যাসিবাদের আইকনই নয়, এই ভবনটি বাংলাদেশে ভারতীয় হেজেমনিরও প্রতীকরূপেও পূজিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই ওই বাড়িটিকে এ দেশের জনগণ বাকশালীদের মন্দির হিসেবেই জানে।

স্মরণে আছে, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভারতের এজেন্ট জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে প্রতিবিপ্লবী ক্যু’দেতার পর জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করা মাত্র বাংলাদেশের সব ভারতপন্থি বাম ও আওয়ামীরা দলবেঁধে ৪ তারিখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের ধানমন্ডির তীর্থে ছুটে গিয়েছিলেন। গত ১৫ বছরে হাসিনা ওই ভবনকে সরকারি মন্দির বানিয়ে বংলাদেশের জনগণকে সেখানে শেখ মুজিবকে পূজা করতে বাধ্য করেছেন।

জনতার যুক্তিসংগত ক্রোধে সেই অভিশপ্ত ভবন ধূলিসাৎ হলে এ দেশের চিহ্নিত হিন্দুত্ববাদী ও দিল্লির ক্রীড়নক বাম ও আওয়ামী সুশীলরা ‘গেল গেল’ রব তুলেছেন। অথচ এরাই ফ্যাসিবাদের ১৫ বছর কানে তুলো, চোখে ঠুলি ও মুখে ছিপি দিয়ে হাসিনার যত গুমখুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও লুটপাটে সায় দিয়েছে। তখন তাদের নীতিকথা স্মরণে আসেনি। আজ যারা তাদের ভাষায় মবের কাজকারবারে আহত বোধ করছেন, তারাই শাহবাগে মব লিঞ্চিংয়ের পক্ষে ২০১৩ সালে দলবেঁধে ‘ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান ধরেছিলেন।

গোলাম মোর্তোজা আমার বিরুদ্ধে ইউটিউবে তার কনটেন্ট সাজাতে গিয়ে মোটাদাগে চারটি বিষয়ে কথা বলেছেন—১. টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাব, ২. ফুলবাড়ী হিংসা, ৩. শাহবাগি ব্লগার হত্যা এবং ৪. একুশে পদকের মনোনয়ন। একে একে তার বক্তব্যের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করছি।

টাটার বিনিয়োগ: ২০০৪ সালের অক্টোবরের ১২ তারিখে রতন টাটা আমার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তার মাত্র দুই মাস আগে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় এক রহস্যজনক বোমা ও গ্রেনেড হামলায় অনেক মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। সেই বোমা হামলার সুযোগ নিয়ে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গ্রুপসহ (গোলাম মোর্তোজা তখন ওই গ্রুপেরই ম্যাগাজিন ২০০০-এর সম্পাদক) ভারতপন্থি তাবৎ মিডিয়া বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি ও ব্যর্থ রাষ্ট্র রূপে প্রচারে নেমেছিল।

তারা বোমা হামলার জন্য তদানীন্তন সরকার ও হাওয়া ভবন দায়ী বলে প্রচার করছিল। সেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলাম, ওই সময় যদি রতন টাটার মতো একজন বিশ্বব্যাপী সন্মানিত ভারতীয় উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশে আনা যায়, তাহলে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার ও ভারতীয় মিডিয়ার বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণাকে ব্যর্থ করে দেওয়া সম্ভব হবে।

পাঠকরা নিশ্চয়ই অবহিত আছেন যে, মোদির আদানি ও রতন টাটার মধ্যে আন্তর্জাতিক ইমেজে আসমান-জমিন ফারাক রয়েছে। রতন টাটাকে একজন অত্যন্ত স্বচ্ছ শিল্পপতি ও ভালো মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার বিরুদ্ধে কখনো দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। আমার উদ্দেশ্য সেদিন শতভাগ সফল হয়েছিল।

রতন টাটার বাংলাদেশ সফরের খবর বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হলে তা দেশের ভাবমূর্তিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে। শুধু টাটা নয়, একে একে আমিরাতের রাজপরিবার, সৌদি ধনকুবের ও রাজপুত্র এবং ইজিপ্টের শিল্পপতিরা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের দালাল গোষ্ঠী বিএনপি সরকারের সেই সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রথম থেকেই টাটা প্রকল্পের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারে নেমে পড়ে। সেই ঈর্ষা থেকে গোলাম মোর্তোজারা দৃশ্যত আজ পর্যন্ত মুক্ত হতে পারেননি।

গোলাম মোর্তোজা অবশ্য চ্যানেল-ওয়ানে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করে দারুণ উপকার করেছেন। এজন্য তার কাছে আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। তিনি আমার সাক্ষাৎকারের যে অংশ আমার ভারতের প্রতি ‘নমনীয়তা’ প্রমাণের জন্য উৎসাহের সঙ্গে প্রচার করেছেন, আমি ততোধিক উৎসাহে সেই অংশ নিচে উদ্ধৃত করছি:

“টাটার প্রস্তাবে দুটো দিক ছিল। একটি ‘অপশন-এ’ এবং একটি ‘অপশন-বি’ ছিল। অপশন-এ’র ক্ষেত্রে তারা প্রথম পাঁচ বছরের জন্য একটি সুবিধা চেয়েছে। সেই সুবিধা অনুযায়ী আজকে যদি আমি গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করি, তাহলে ফার্টিলাইজারের ক্ষেত্রে ৩ ডলার ১০ সেন্ট পড়বে অপশন-এ’র ক্ষেত্রে এবং তারা বলেছে, একটি আপার লিমিট চার ডলার। অপশন-বি’র কথা বলেছে, পাঁচ বছর পর থেকে অপশন-বি কার্যকর হবে।

অপশন-বি অনুযায়ী যদি আমরা যাই, এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম হবে ৩ ডলার ৭০ সেন্ট। আজকে যে সচিব কমিটি মূল্যায়ন করেছে, তারা অপশন-বি’র পক্ষে মত দিয়েছে। তারা বলেছে, অপশন-বি আমাদের দেশের জন্য ভালো। তার মানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আজ পর্যন্ত যত বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে, এর মধ্যে রাষ্ট্রের বেশি স্বার্থ রক্ষা করে, এমন আর কোনো প্রস্তাব আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।”

পাঠক, আপনারাই বিবেচনা করুন, গোলাম মোর্তোজার উদ্ধৃত করা আমার বক্তব্যের মধ্যে কোথায় আমি রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ভারতকে খুশি করে কথা বলেছি? আমার কোন কথাটি আপনাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে? আমরা তৎকালীন আন্তর্জাতিক জ্বালানি মূল্যের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম ৩ দশমিক ৭ ডলার চেয়েছি এবং কোনো আপার লিমিটে সম্মত হইনি।

টাটার প্রস্তাবিত কোনো আপার লিমিট মেনে না নিয়ে গ্যাসের আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করার প্রশ্নে অনড় থাকাতেই শেষ পর্যন্ত টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাব সেদিন সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা প্রস্তাব গ্রহণ না করলেও রতন টাটার বাংলাদেশ সফর এবং তিন বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রমাণ করেছিল, বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল।

পাঠক, আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলে গোলাম মোর্তোজার অপপ্রচারের বেলুন সশব্দে ফেটে যাবে। যে সচিব কমিটি সেদিন টাটার সঙ্গে দর কষাকষি করেছিল, তার প্রধানের নাম ছিল এএনএম নাসির উদ্দিন। তিনিই ড. ইউনূস সরকারের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সে সময় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের নাম ছিল শেখ আবদুর রশীদ, যিনি বর্তমানে চুক্তিতে আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী, অর্থাৎ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি।

আর সেদিন যিনি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ছিলেন, তার নাম মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া। এই মোশাররফ হোসেন শেখ হাসিনার আমলে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের পরিচালক হয়েছিলেন। আল্লাহর অসীম রহমতে আমার তিন সহকর্মীর দুই ভিন্ন সরকারের আমলে অত্যন্ত উচ্চ পদে অবস্থান প্রমাণ করে যে, ১. আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পরিচালনায় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে ছিলাম; ২. আমার অধীনে মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত ছিল এবং ৩. টাটার বিনিয়োগ নিয়ে দর কষাকষি অত্যন্ত স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে করা হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রশ্নে কোনোরকম ছাড় দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে টাটার চেয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে কোনো বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। আমার স্মরণে আছে, দর কষাকষির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আমরা প্রায় প্রতিদিন প্রেস ব্রিফিং করতাম। গোলাম মোর্তোজা, আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি, আমার তিন সাবেক সহকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রমাণ করুন, আমি কোনোদিন ভারতের পক্ষে বিন্দুমাত্র অবস্থান নিয়েছিলাম কি না; নইলে ইউটিউবে মিথ্যা প্রচারের জন্য আপনার দর্শকদের কাছে ক্ষমা চান।

টাটার বিনিয়োগ নিয়ে এত অসত্য কথা বললেন, অথচ গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের সকল স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির কোলে গিয়ে উঠল—আপনারা তখন কোথায় ছিলেন? শেখ হাসিনা কোনো চুক্তির কোনো তথ্য কি জনগণকে কখনো জানিয়েছিলেন? তিনি আমার মতো করে কি প্রতিদিন দেশবাসীকে কোনো চুক্তি অথবা বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে জানিয়েছেন? এতদিন কোথায় ছিল আপনাদের সুশীল মিডিয়া? এক রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প থেকে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার শেখ পরিবার লুট করলেও সুশীলরা সুবোধ বালকের মতো মাথা নিচু করে থেকেছেন।

ছাত্র-জনতা অকুতোভয়ে জীবন দেওয়ার পর আপনারা এখন ভারত ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সেজেছেন! বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে গোলাম মোর্তোজা এত বড় ভুল করলেন! আমাকে আর যাই হোক, ভারতপন্থি প্রমাণ করার চেষ্টা যে পণ্ডশ্রম সেটা বুঝলেন না? সত্যিই অবাক হলাম।

ফুলবাড়ী হিংসা: রাজনৈতিকভাবে সচেতন নাগরিকরা জানেন, এ দেশের বামরা মূলত রামপন্থি। এই প্রচণ্ড ইসলামফোবিক ও জনবিচ্ছিন্ন প্রজাতি কেবল মিডিয়ার সৌজন্যে টিকে আছে। যে ভারতপন্থি বাম টাটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তারাই ফুলবাড়ী হিংসারও ইন্ধনদাতা। ফুলবাড়ীর বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল প্রস্তাবিত কয়লাখনির খনন পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে। অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি ওপেন পিট পদ্ধতিতে খনি উন্নয়নের পক্ষে ছিল।

ওপেন পিট পদ্ধতি নিয়ে পৃথিবীতে পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক রকম মতামত রয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে আমি বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ও আমার শিক্ষক ড. নুরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি টেকনিক্যাল কমিটি তৈরি করি। তার সরাসরি ছাত্র হওয়ার কারণে আমার জানা ছিল ড. নুরুল ইসলাম ওপেন পিট পদ্ধতিকে খুবই অপছন্দ করেন। তা সত্ত্বেও ড. নুরুল ইসলামের একাডেমিক সততার প্রতি আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা থাকায় এবং সরকারের সদিচ্ছা প্রমাণের জন্য আমার সেই শিক্ষককেই এই গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলাম।

আমি এটাও জানতাম, মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় বিএনপি সরকারের হাতে ছিল না। পরবর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তার জন্যই কেবল আমি ড. নুরুল ইসলাম কমিটির রিপোর্টটি শেষ করে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বামেরা জেনেশুনে বাদ সাধল। তারা প্রথম আলো গ্রুপ ও অন্যান্য সমগোত্রীয় মিডিয়ার অপপ্রচারের সহায়তায় ফুলবাড়ীর জনগণকে উত্তেজিত করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়।

একপর্যায়ে বিডিআর গুলিবর্ষণ করলে তাতে তিন বিক্ষোভকারী প্রাণ হারান। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির জন্য প্রথম আলো-সমর্থিত ষড়যন্ত্রকারীরাই প্রধানত দায়ী ছিল। ফুলবাড়ীর পুরো ঘটনা নিয়ে আমি ২০০৮ সালে ‘ফুলবাড়ীর রাজনীতি’ নামে একটি ছোট বই লিখেছিলাম। বইমেলায় হয়তো বইটা পাওয়াও যেতে পারে। উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।

শাহবাগি ব্লগার হত্যা: ভারত ও আওয়ামীপন্থি মিডিয়া এবং শেখ হাসিনার সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে শাহবাগে যে ব্লগার গোষ্ঠী উন্মত্ততার সৃষ্টি করেছিল, তাদের ভয়ানক ইসলামবিদ্বেষ সম্পর্কে সবাই অবহিত। শাহবাগের বয়ানের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পাটাতন নির্মাণ করা হয়েছিল। এক যুগ পর মহান জুলাই বিপ্লবের তরুণরা শাহবাগি বয়ানকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফ্যাসিবাদকে কবর দিয়েছে।

অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্লগার হত্যার প্রসঙ্গ কনটেন্টে টেনে গোলাম মোর্তোজা শাহবাগি ফ্যাসিবাদের প্রতি তার সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং তিনি ওই হত্যার জন্য অত্যন্ত অন্যায়ভাবে প্রকারান্তরে আমাকে দায়ী করতে চেয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমি সেই সময় শাহবাগের পাল্টা বয়ান দিয়ে অত্যন্ত গর্হিত কাজ করে ফেলেছি। শেখ হাসিনা আমার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দিলেও কখনো ব্লগার হত্যার জন্য দায়ী করেননি। গোলাম মোর্তোজা প্রমাণ করলেন, তিনি হাসিনার চেয়েও বড় শাহবাগি ও ইসলামোফোব এবং কোনো ম্যাজিকে ক্ষমতা হাতে পেলে তার চেয়ে অধিক বর্বর ফ্যাসিস্ট হবেন।

২০১৩ সালে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একাকী আমার দেশ শাহবাগের বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করেছিল বলেই বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তদানীন্তন ভারতের রাষ্ট্রপতি কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, শাহবাগের প্রতি তার এতই প্রেম যে, রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের বাধা না থাকলে তিনি সেখানে ছুটে যেতেন।

ভারতীয় আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের মুখোশ উন্মোচন করে আমার দেশ এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিল। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার সেই লড়াইয়ে সঠিক ভূমিকার জন্য আমি আজও গর্ব অনুভব করি। গোলাম মোর্তোজারা যতই বেদনা বোধ করুন না কেন, বাংলাদেশের মিডিয়ার ইতিহাস থেকে ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শিরোনামকে আর মোছা যাবে না।

পাঠক আরও লক্ষ করুন, শাহবাগি ব্লগারের জন্য গোলাম মোর্তোজার ভীষণ মায়া থাকলেও শাপলা চত্বরে আলেমদের ম্যাসাকার নিয়ে তিনি মোটেও বিচলিত নন। শত শত আলেমের গণহত্যায় তিনি কিছু ব্যথিত হননি। তাই তার কনটেন্টে শাহবাগ থাকলেও শাপলা চত্বরের কোনো উল্লেখ নেই। গোলাম মোর্তোজার মিডিয়া গ্রুপ অব্যাহতভাবে শাপলা ম্যাসাকারকে সমর্থন করে গেছে। তাদের কাছে মুসলমানের কোনো মানবাধিকার থাকতে পারে না।

শাপলা চত্বর ম্যাসাকারের সঠিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার অপরাধে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর আদিলুর রহমান খান এবং নাসিরুদ্দিন এলানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এবং পরে জেলে নিয়ে গেলে গোলাম মোর্তোজাদের প্রথম আলো-ডেইলি স্টার হাসিনার গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এক যুগ পর গোলাম মোর্তোজা তার শাহবাগি চেহারা আবার জাতির সামনে উন্মোচিত করেছেন। সেজন্য তাকে ধন্যবাদ। তিনি সুযোগ পেলে হয়তো ব্লগার হত্যার জন্য মানবাধিকার কর্মী ও বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানকেও দায়ী করে ফেলবেন।

গোলাম মোর্তোজার লেখালেখি সম্পর্কে আরও একটি তথ্য জানানো দরকার। তিনি আবার চাকরির নিশ্চয়তা ও ছয় ঘোড়া উপহারের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিল্লির পায়ে বিলিয়ে দেওয়া সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের ভক্তকুলের একজন। এক-এগারোর সময় ভারতের দালাল সেই দেশদ্রোহী জেনারেলকে ধন্যবাদ জানিয়ে গোলাম মোর্তোজা স্তুতিমূলক পোস্ট লিখতেন, যখন আমি ও ফরহাদ মজহার নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে পালা করে সরকারের মুখোশ খুলে দিতাম। বাংলাদেশের জনগণকে উদ্দেশ করে বলছি, আপনারা দয়া করে এত তাড়াতাড়ি অতীত ভুলবেন না এবং যাচাইবাছাই ছাড়া কাউকে অহেতুক হিরো বানাবেন না।

একুশে পদক: ২০২৫ সালের একুশে পদকের জন্য বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ১৪ জনকে মনোনয়ন দিয়েছে। তাদের মধ্যে আমার মতো এক অকিঞ্চিৎকর ও বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির নামও আছে। গোলাম মোর্তোজা সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তিনি তো সরকারের এমন এক প্রভাবশালী ব্যক্তি যিনি নাকি ওয়াশিংটনে প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছেন। অধিকন্তু তিনি একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সম্পাদক, জনপ্রিয় ইউটিউবার।

পদক প্রদান করা হবে ২০ ফেব্রুয়ারি। হাতে এখনো সময় আছে। গোলাম মোর্তোজারা সম্ভবত ইচ্ছা করলেই পদকের তালিকা থেকে আমার নাম বাদ দিতে পারেন। আমি এতে খুশিই হব। আমার কাছে এই পদক কোনো বিশেষ মূল্য বহন করে না। ২০১৮ সালে কুষ্টিয়ার আদালতে পুলিশের পাহারায় জঙ্গি ছাত্রলীগের আক্রমণে রক্তাক্ত হয়ে বলেছিলাম, ‘দেশ ও ধর্মের জন্য জীবন দিতে আমি প্রস্তুত।’ কোনো পদকের প্রত্যাশা করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে প্রাণপণ লড়াই করিনি। বিপ্লবোত্তর দেশে আমি যখন বিভিন্ন ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যাই, আর দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী তরুণরা আমার কথা উৎসাহ নিয়ে মন দিয়ে শোনে, সেটাই আমার কাছে সর্বোত্তম পুরস্কার।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের সরকারি দায়িত্ব পালনকালে ভারত প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ে জনগণকে জানানো প্রয়োজন। সেই সময় থেকেই ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক ও এডিবিকে ব্যবহার করে দেশটি বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ দিতে শুরু করেছিল। বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দুই আন্তর্জাতিক লগ্নিকারী সংস্থার দুই তদানীন্তন প্রধান ক্রিস্টিনা ওয়ালিচ ও হুয়া দু’র সঙ্গে আমাকে ট্রানজিট নিয়ে অবিরত তর্ক করে যেতে হয়েছে।

আমি সর্বদা ট্রানজিটের বিপক্ষে অনড় অবস্থান নিয়েছি। কোনো চাপের কাছেই আমি নত হইনি। আর গোলাম মোর্তোজার ঘরানার সম্পাদকরা তখন রেহমান সোবহান ও দেবপ্রিয়র সিপিডিকে নিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার পক্ষে বিদেশি টাকায় সেমিনার করে বেড়াতেন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী এই গোষ্ঠীর পাপের ভাঁড়ার অনেক আগেই পূর্ণ হয়েছে।

শেখ হাসিনা আমাকে প্রায় পাঁচ বছর জেলে রেখেছিলেন। আওয়ামী আদালত একাধিক মামলায় আমাকে সাজা দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকার ১২৪টি মামলা দিয়েছিল, যার মধ্যে অনেকগুলো এখনো চলমান। আমি ড. ইউনূস সরকারকে কোনো মামলাই প্রত্যাহার করতে বলিনি। বরং ছয় বছরের নির্বাসন থেকে ফিরেই জেলে গিয়েছি। আমাকে র‍্যাবের আয়নাঘরে নিয়েছে।

ক্যান্টনমেন্ট থানায় পুলিশ হেফাজতে ও কুষ্টিয়া আদালতে হত্যার চেষ্টা করেছে। আমার বৃদ্ধা মা ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক ও কর্মচারীর জীবিকা কেড়ে নিয়েছিল। প্রচণ্ড জিঘাংসায় আমার দেশ অফিসে আগুন দিয়েছে, প্রেসের সব মেশিনপত্র লুট করে নিয়ে গেছে।

অথচ এমন ভয়াবহ এক সাইকো ফ্যাসিস্ট গোলাম মোর্তোজাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করেনি। তারা ফ্যাসিবাদের অন্তিম দু-তিন বছরে ইউটিউবে সরব হয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকলেও চরম মেগালোম্যানিয়াক হাসিনা তাদের উপেক্ষা করেছেন। এর রহস্য আমার অজানা। তবে আমি খুশি হয়েছি গোলাম মোর্তোজাদের পরিণতি আমার মতো না হওয়ায়।

বালাদেশের মিডিয়া দুই বিপরীতধর্মী বয়ান দ্বারা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিভাজিত। গোলাম মোর্তোজা ও তার হাউসের সাথিরা শাহবাগি ও বাকশালী বয়ানের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই বয়ানের মধ্য দিয়েই ১৯৭৫ সালে মুজিবের স্বৈরাচার এবং ২০১৩ সালে হাসিনার ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়েছিল। এর বিপরীতে আমি বাঙালি মুসলমানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দ্বারা নির্মিত বয়ানের প্রতিনিধিত্ব করি।

আমাদের এই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের পরিণতির ওপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও নাগরিকের অধিকার বহুলাংশে নির্ভরশীল। অতএব আপনারা সতর্ক হোন। সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে পরাজিত হলে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠবে। ইনশাআল্লাহ, আমার দেশ তার লড়াই অব্যাহত রাখবে।

গোলাম মোর্তোজা তার ইউটিউব কনটেন্টে এতগুলো প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন যে, তার উত্তর দিতে গিয়ে আজকের লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় পাঠকের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।