Image description
শিবির কেন স্কুল ছাত্রদের দাওয়াত দেয়?
প্রথমে যেটি মনে রাখতে হবে, শিবির প্রচলিত রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের মতো কোনো ছাত্র সংগঠন নয়। এটি একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই সংগঠনের রয়েছে বিভিন্ন স্তরে অধ্যয়নরত ছাত্রদের জন্য নিজস্ব সিলেবাস এবং নিজস্ব শিখন পদ্ধতি। যার মাধ্যমে একজন ছাত্রকে আদর্শ মানুষ হিসেবে এবং মহান রবের গোলাম হিসেবে ছাত্রশিবির তৈরি করে থাকে। আর রাজনৈতিকভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং ছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা আমাদের শত শত কাজের মধ্যে খুবই ছোট একটি কাজ। শিবিরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহ প্রদত্ত (আল-কুরআন), রাসূল স. প্রদর্শিত (আল-হাদিস) বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির তার কর্মসূচিকে সাজিয়ে থাকে। একজন মানুষের উপর নামাজ ফরজ হবার সাথে সাথে ইসলামের সকল বিধানই কার্যকর হয়। মুসলমানদের একজন খাঁটি ঈমানদার হিসেবে গড়ে তুলতে ছাত্রশিবির নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে। যেমন : কুরআন শিক্ষার আসর, হাদিস পাঠ, ইসলামিক জলসা, বিতর্ক চর্চা, বই পড়ার অভ্যাস করা, আবৃত্তি, নৈশ ইবাদত, নফল রোজা রাখার প্রতি আগ্রহী করা ইত্যাদি। এর মাধ্যমে একজন মানুষ ছোটো থেকেই পূর্ণ মুসলমান হিসেবে নিজেকে গড়ে নিতে পারে। ছোট বেলা থেকেই মানুষের আচরণ পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে গঠিত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে ইসলামী অনুশাসন পূর্ন মাত্রায় বিদ্যমান না থাকায় এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক বা ধর্মীয় শিক্ষার অগ্রাধিকার খুবই কম থাকায় ভালো মানুষ তৈরি হতে পারছে না। ফলস্বরূপ মাদক, জুয়া, সুদ, ঘুষ, যেনা, ব্যভিচারসহ নানা অপকর্মে যুবসমাজ জড়িয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ইসলামী ছাত্রশিবির ছোট থেকেই একজন সন্তানকে পিতামাতার আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে থাকে। ফলে শিবিরে দাওয়াতে যারা আসে তারা নামাজি, চরিত্রবান, অমায়িক স্বভাব ও উন্নত নৈতিকতার অধিকারী হয়। চরিত্র তৈরির এমন শিক্ষা ইসলামি সংগঠন ব্যতিত আর কেউ দেয় না। যারা বলেন, এতো ছোটো থেকে কেন শিবির করবে? আরো বড় হলে তখন যুক্ত হবে। অথচ হাজার হাজার দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে রয়েছে, স্কুল বয়সেই ছেলে মাদকের সাথে বা পর্নোগ্রাফির সাথে জড়িয়ে পরেছে। ঐশির দৃষ্টান্ত কেউ হয়তো ভুলে যাননি। আরো কিছু রিপোর্ট আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই- ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম আলোতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, শিশু-কিশোরেরা ইন্টারনেট, কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকায় ধীরে ধীরে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হতে শুরু করে। এর ফলে তারা নানা ধরনের যৌনাচরণে অভ্যস্ত হয়ে যায়। রিটি টেকনোলজি কোম্পানি বিটডিফেন্ডারের গবেষণা অনুযায়ী, পর্ন সাইটে যাতায়াত করা প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১ জনের বয়স ১০ বছরের নিচে। আর এই অল্প বয়সী বাচ্চাগুলো রেপ পর্নজাতীয় ভয়াবহ সব ক্যাটাগরির পর্ন দেখছে। অন্যদিকে, এনএসপিসিসি চাইল্ডলাইনের সাম্প্রতিক সময়ের জরিপ অনুসারে, ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সীদের মধ্যে শতকরা ১০ জন এই ভেবে ভীত যে তারা পর্নে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে, চাইলেও আর পর্ন দেখা বন্ধ করতে পারবে না। ইউএনডিপি বাংলাদেশ এবং সেন্টার ফর ম্যান অ্যান্ড ম্যাসকুলিনিটি স্টাডিজের (সিএমএসএস) যৌথ উদ্যোগে ‘ব্রেভম্যান ক্যাম্পেইন’-এর অংশ হিসেবে স্কুল পর্যায়ে শিশু-কিশোরদের পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এ গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের স্কুলগামী কিশোরদের ৬১ দশমিক ৬৫ শতাংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, পর্ন ভিডিওতে আসক্ত রাজধানীর ৭৭ শতাংশ কিশোর। পর্নোগ্রাফি শিশু-কিশোরদের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করে, তা হলো যৌনতার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত করে দেয়। যুক্তরাজ্যের বিচারবিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে ১২০টি শিশু। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ান সাইকোলজিকাল সোসাইটির ধারণা অনুযায়ী, ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ধর্ষণের জন্য দায়ী কিশোরেরা এবং শিশুদের ওপর চালানো যৌন নিপীড়নের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী এই কিশোরেরা। ইংল্যান্ডে পর্ন দেখে ১২ বছরের বালক কর্তৃক তার ৭ বছরের বোন ধর্ষণের শিকার হওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়। পর্নোগ্রাফি দেখে ধর্ষকে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশের শিশু-কিশোরেরাও পিছিয়ে নেই। নিচে কয়েক বছরে ঘটা কিছু ঘটনা উল্লেখ্য করা হলো। -- ঢাকার কেরানীগঞ্জের সিরাজনগর এলাকায় সাত বছরের শিশুকন্যাকে তার নিকটাত্মীয় নবম শ্রেণির এক কিশোর মোবাইলে পর্ন দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর ফিল্মি কায়দায় হত্যা করে। -- পাবনার চাটমোহরে পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ১৩ বছর বয়সী ভ্যানচালক কিশোর আটক। -- বগুড়ার ধুনটে তিন কিশোর কর্তৃক প্রথম শ্রেণির এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা। -- মেহেরপুরের মুজিবনগরে ৩ বছর ৫ মাস বয়সী শিশুকে মোবাইলে গেম খেলার কথা বলে নিজেদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে ১৪ বছরের কিশোর। এমন অসংখ্য ঘটনা প্রতিদিন পত্রিকার হেডলাইন হচ্ছে। আবার অনেক ঘটনা থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে। ১৩ আগস্ট ২০২৪ দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে - পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত দেশের ৬২.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। চীনের নানজিং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব দ্য এনভায়রনমেন্টের পিএইচডি শিক্ষার্থী মো. আবু বকর সিদ্দিকের তত্ত্বাবধানে বিখ্যাত উইলি পাবলিশারের ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল হেলথ সায়েন্স রিপোর্টের আগস্ট সংখ্যায় এ গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণায় মোট ৮ হাজার ৮৩২ কিশোর-কিশোরী অংশগ্রহণ করে। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট আসক্তিতে, ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষণ্নতায় এবং ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে ভুগছে। বিষণ্নতা এবং উদ্বেগজনিত লক্ষণগুলো ইন্টারনেট আসক্তির সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্পর্কিত। গবেষণার বিষয়ে মো. আবু বকর সিদ্দিক বলেন, গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলে শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি বিষণ্নতায় ভুগছে। অপরদিকে, ছেলে শিক্ষার্থীরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের তুলনায় পর্নোগ্রাফি আসক্তিতে বেশি ভুগছে। যারা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে কিন্তু শারীরিক অনুশীলন করেন না, তাদের বিষণ্নতা এবং পর্নোগ্রাফি আসক্তি বেশি। তিনি আরও বলেন, ইন্টারনেট আসক্তি, বিষণ্নতা এবং পর্নোগ্রাফি আসক্তির নেতিবাচক প্রভাব কিশোর-কিশোরীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে ঘুমের সমস্যা, একাকিত্ব এবং সামাজিক দক্ষতার হ্রাস দেখা দিতে পারে। বিষণ্নতা কিশোর-কিশোরীদের জীবনের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয় এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। পর্নোগ্রাফি আসক্তি কিশোর-কিশোরীদের যৌন আচরণ ও সম্পর্কের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে পারে, যা তাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে শিশুকিশোর ও তরুণ-তরুণী! বিশাল সংখ্যক মাদকাসক্তের মধ্যে আবার প্রায় ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিশু-কিশোর সঙ্গদোষ ও বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে, ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ কৌতূহলবশত হয়ে মাদক সেবনের মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। পর্নোগ্রাফি ও মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবলে আজ গোটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবার বা পিতামাতা সন্তানদের হেফাজত করতে পারছেনা। কারন অসৎ সঙ্গ। শিবির ছাত্রদেরকে এমন ভয়ালো থাবা থেকে রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করছে। মহান রব আমাদের যুব সমাজকে হেফাজত করুন। নুরুল ইসলাম সাদ্দাম (Nurul Islam Saddam)