ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ
বাংলাদেশের বাম দলগুলো আওয়ামীলীগের ক্ষমতাকালে ফাংশন করতে পারে না। বিগত ১৫ বছরেও তারা মৌলিক রাজনীতি করতে পারেনি। মূলত আওয়ামীলীগের সাথে ক্ষমতার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাগাভাগিতে থাকার কালে 'কনফ্লিট অফ ইন্টারেস্ট' তৈরি হবার কারণে, কালচারাল এটাচমেন্টের কারণে তারা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে পারে না। বরং এই দীর্ঘ সময়কালে বাম দলগুলো প্রায় সব ন্যারেটিভ উৎপাদন প্রক্রিয়া ছিল জামায়াত এবং জামায়াতের প্যাকেজে মূলত বিএনপি ঠেকানোর জন্য নিবেদিত। আদতে এর মাধ্যমে বাম রাজনীতি 'সফট পাওয়ার' হারিয়েছে। ক্ষমতা বলয়ের কাছাকাছি থেকেও, তাদের কেউ কেউ সরাসরি সরকারি ১৪ দলীয় জোটে থেকেও বাস্তবে তারা ছিলেন ক্ষমতাহারা।
বিএনপি-জামায়াতের বাইরে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক বিকল্প তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বাম দলগুলো অনন্তকাল আওয়ামীলীগের গোলামীর পক্ষে সারিবদ্ধ হয়েছিল। ভোটাধিকার হরণের নৈরাজ্যকে নাগরিকের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। মঞ্জুরুল আহসান খানের সরাসরি বক্তব্য আছে এই নিয়ে। বিএনপিসহ বিরোধীদের পর্যাপ্ত পরিমাণে দমন করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তারের বহু পরে এসে এককালের অভিজ্ঞ বাম রাজনীতিবিদরা দেখছেন, আহা! বাম রাজনীতি বিষয়টাই তো হারিয়ে গেছে! অথচ বিকল্প কে হবে,সেটা ঠিক করে দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার ছিল জনতার, যে ভোটের মাধ্যমে বলে দেবে কে হবেন তার ভবিষ্যৎ নেতা। বাম রাজনীতি এই মৌলিক দীক্ষা হারিয়েছিল। বাম বরং বলে গেছে এক দিনের ভোট, একদিনের গণতন্ত্রের দরকার নাই। বাস্তবে বাংলাদেশের মানুষের লিভিং এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছে, ২০১৪ সালের আগের এক দিনের ভোট 'রাতের ভোট' এবং স্বৈরাচার থাকে ভাল ছিল।
‘রাজনীতিবিদের’ মুখে কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়নের তত্ত্ব শোনা গেল। 'ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন' তত্ত্ব আবিষ্কার করে বাম নেতারা এদেশে স্বৈরাচার পুষেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টি জাসদ সিপিবির মুখে 'অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন গপ্পের' ভূয়সী প্রশংসা আমরা শুনেছি। স্বৈরাচার তোষণের বাইরেও আছে 'ইসলাম বিদ্বেষ' এবং ভারতকে 'কিবলা' মানার অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক।
বাস্তবে স্বৈরাচারের কালে ছাত্র রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতিতে পড়েছে আমাদের বাম ছাত্র সংগঠন গুলো, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র ফ্রন্ট। মাদার সংগঠনের স্বৈরাচার সংশ্লিষ্টতায় এবং তাদের ডিক্টেশনে, বাম ছাত্র সংগঠন গুলো ফাংশন করতে পারেনি। আজকে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাম ছাত্র সংঘঠন গুলোর উল্লেখযোগ্য নেতা উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে না।
বাম দলগুলো আওয়ামীলীগের ক্ষমতাকালে কেন ফাংশন করতে পারে না? এই পাজল তাদেরই সলভ করতে হবে। আমরা ভারতে, নেপালে এবং শ্রীলংকায় বাম রাজনীতির উত্থান দেখি, ভাল পারফরমেন্স দেখি। কিন্তু বাংলার পূর্বে এবং পশ্চিমে তাদের শোচনীয় পরাজয় কেন? স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার পক্ষে বামের ন্যারেটিভ উৎপাদনের জ্ঞাত যে ঝোঁক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পক্ষে বামের যে জ্ঞাত সমর্থন- এসব পেছনে ফেলে দুই বাংলার বাম দলগুলো কীভাবে 'সোশ্যাল ডেমোক্রেসি'র মেনিফেস্টো হাজির করতে পারবে তরুনদের সামনে কিংবা এনার্কিস্ট রাজনীতির বিপরীতে ইউরোপীয় লিবারেল লেফট মেনিফেস্টোর আদলে জনবান্ধব চর্চা করতে পারবে- এই প্রশ্নের গভীরতর উত্তর খুঁজতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলার বাম রাজনীতির সাথে ইউরোপীয় সোসালিস্ট পার্টির মেনিফেস্টোর কোন মিল পাই না। ইউরোপীয় সোসালিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো সমাজ ও পলিসি কেন্দ্রিক, পাবলিক পলিসির সোশ্যাল রি-শেইপ কেন্দ্রিক, অন্যদিকে বাংলার বাম রাজনীতি এনার্কিস্ট, যা আমাদের তরুণদের আকৃষ্ট করে না।
ঠিক বিপরীতে ক্যাম্পাস গুলোতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন গুলোর বিকাশ দেখা যাচ্ছে। এমনকি ছাত্রলীগের পোস্টেও তারা লুকিয়েছে। ছাত্রলীগের খাইখাই রাজনীতির ভিতরে থেকে নিশ্চিতভাবে তারা চিন্তার দিক থেকে প্রভাবশালী থেকেছে বলেই মধ্য পর্যায়ের পদপদবী বাগিয়েছে।
কেন্দ্রীয় শিবিরের বহু সাবেক সদস্যকে আমি ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের আড়ালে ৭১ কে আড়াল করার, ভিলিফাই করার, ডিজ ওউন করার প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইনে নামতে দেখেছি। কিন্তু তরুণরা এসবকে এন্টারটেইন করছে না বলে আমি আশাবাদী হচ্ছি। এখানে বাম ছাত্র রাজনীতির একটি অদৃশ্য বিপদ হচ্ছে, নতুনদের ইসলামী ধারার ছাত্ররাজনীতির মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করা। যদি কেন্দ্রীয় শিবিরের, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বা অপরাপর ইসলামী ছাত্র সংগঠনের ছেলেমেয়েরা মূল সংঘঠনের বাইরে এসে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২৪ এর গণ অভ্যুত্থান উভয়কে একসাথে ধারণ করার যোগ্যতা দেখতে সমর্থ হয়, সমাজে অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তার বিকাশে সহযোগী হয় (যেটা কিছুটা দেখাও যাচ্ছে), তাইলে বাম রাজনীতি আরেকদফা সংকটে পড়বে, তাদের ন্যারেটিভ উৎপাদনের ক্ষমতায় প্রভাব পড়বে। এতে সমস্যা হচ্ছে, আমরা বহু সম্ভাবনাময় ব্রাইট মাইন্ডস হারিয়ে ফেলবো।
বাম ছাত্র সংগঠন গুলো সেকুলারিজমের নামে ইসলামবিদ্বেষ ও ব্রাম্মণ্যবাদী তোষণ করে, আবার ডান সংগঠন গুলো সেক্যুলারিজমের এই স্ট্যান্ডার্ডকে রিয়েল সেকুলারিজম মনে করে ভুলের আবর্তে বসবাস করে এবং সেকুলারিজমেরে সব আপিলকেই ঘৃণা করে। রাষ্ট্রে ভিন্নমতের সমাদরে ডান ও বাম উভয়কেই এই বৃত্ত ভাঙতে হবে।
মুক্তচিন্তার, বহুমুখী ধারার সমন্বয়ে উন্মুক্ত একটি ছাত্রসমাজ আমার ব্যক্তিগত চাওয়া, যেখানে সব ডোমেইনের জ্ঞানকে এন্টারটেইন করা হবে, তারা একে ওপরের সাথে চিন্তা ও তর্ক করবে, কিন্তু কেউ কাউকে ফিজিক্যালি এলিমিনেট করে দিবে না (যেমনটা স্বৈরাচারের কালে হয়েছে)। এদিক থেকে বাম ও ডান ধারার ছাত্র সংঘঠন উভয়েরই রূপান্তর চাই আমি। একটি কল্যাণধর্মী রূপান্তর, যেখানে তারা ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব ছাত্রছাত্রীর, সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে। স্কুল ও মাদ্রাসা ভেদে, পাহাড় সমতল ভেদে সব ছাত্রছাত্রীর মৌলিক অধিকারকে, জীবনের সংগ্রাম ও সম্ভাবনাকে ওউন করবে।
পারবে! আমাদের ছাত্ররা এমন চ্যালেঞ্জ নিতে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন