Image description
‘সাহিত্য এখন কোণঠাসা অবস্থায় আছে; কারণ, মানুষ নিজেই এখন আবদ্ধ’
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আপনার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী কয়েক দিন পরই। সৃজনশীল রচনা দিয়ে শুরু করে খুব দ্রুতই আপনি ধাবিত হয়েছেন মননশীল সাহিত্যে। সতীর্থরা যখন গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখায় মত্ত, সেই সময় আপনার অভিমুখ সাহিত্যসমালোচনায়—মননশীল রচনার দিকে। এর পরিপ্রেক্ষিত ও কার্যকারণ যদি বলেন... সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: কবিতা আমি কখনো লিখিনি। গল্প লিখেছি, উপন্যাস যে লিখিনি, তা-ও নয়; কিন্তু ও পথে এগোনো হয়নি। কবিতাতে প্রথম বাধাটি ছিল ছন্দ মেলাতে পারব না—এই ভয়; দ্বিতীয় বাধা কল্পনাক্ষমতা শক্তিশালী নয়—এই বোধ। আর কথাসাহিত্যের চর্চা যে ছাড়তে হলো, তার পেছনেও ছিল দুটি কারণ। একটি হলো অভিজ্ঞতার সীমা। আমি দেখেছি, আমার লেখাতে বৃত্তের উপমা বেশ ভালোভাবেই আছে; আমি বড় হয়েছি এবং রয়ে গেছি একটি বৃত্তের মধ্যেই। সে বৃত্তটা মধ্যবিত্তের। সেখানে আমার জন্য গল্প-উপন্যাসের পর্যাপ্ত উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় কারণটা সাহিত্যের মান সম্পর্কে ধারণা। সাহিত্য পঠন-পাঠনের দরুন কথাসাহিত্যের উৎকর্ষের যে মানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে, ভয় হয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে পারার চেষ্টাটা হবে পণ্ডশ্রম। আবার তৃতীয় একটা কারণও থাকতে পারে। সেটা হলো, সাহিত্যের শিক্ষকতার কারণে বিশ্লেষণপ্রবণতার বৃদ্ধি। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের জন্য সংশ্লেষণ শক্তির দরকার; সেটার ঘাটতি ঘটেছিল বলেও হয়তো ধারণা। সে তুলনায় প্রবন্ধে দেখেছি স্বাধীনতা বেশি। নিজের চিন্তা ও উপলব্ধির কথা বলা যায়, অভিজ্ঞতারও ব্যবহার চলে; মানটাও থাকে নিজস্ব। তবে মননশীল ও সৃষ্টিশীল রচনার মধ্যে যে দুর্লঙ্ঘ্য কোনো প্রাচীর আছে, তা-ও সত্য নয়। মননশীল রচনাতেও সৃষ্টিশীলতা আনা সম্ভব। ওই দুইকে মেলানোর চেষ্টাটাও আমার ছিল। আলতাফ: যুক্তরাজ্যের লিডস ও লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মার্ক্সীয় দর্শনের পাশাপাশি এর সাহিত্যতত্ত্ব দিয়ে ব্যাপকভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন আপনি। এই রূপান্তরের প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে বলুন। সিরাজুল: রূপান্তর ঠিক নয়, বলা যায় বিকাশ। ঢাকায় তো আমরা থাকতাম একটা মফস্বলীয় পরিবেশে। বাইরে গিয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয়টা বেড়েছে। মার্ক্সীয় চিন্তার বিষয়ে আগ্রহটা আগেও ছিল, কিন্তু পরিচয়ের সুযোগ ছিল সীমিত। লিডসে গিয়ে সুযোগটা বাড়ল। সাহিত্যও ইতিহাসের ভেতর থেকেই রচিত—এটা তো জানতামই; কিন্তু ইতিহাসে যে অর্থনীতি থাকে, থাকে শ্রেণিবিভাজন ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব—মার্ক্সবাদ এই জ্ঞানটা আমাকে বিশেষভাবে দিয়েছে। লেখক যতই নিরপেক্ষ হোন না কেন, সমাজের দ্বন্দ্বগুলো তাঁর ওপর প্রভাব ফেলবেই। তিনি না চাইলেও তাঁর একটি মতাদর্শিক অবস্থান সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। মতাদর্শটা সাহিত্যে সব সময়ই থাকে। আসলে কোনো সাহিত্যই আদর্শনিরপেক্ষ নয়। মার্ক্সবাদ ইতিহাসের ব্যাপারে ঔৎসুক্য এবং মতাদর্শের প্রশ্নে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। আমার মধ্যেও সেটা ঘটেছে। আলতাফ: লেখক ও সমালোচক হিসেবে আপনার বিশ্লেষণের কাঠামোটি আবর্তিত হয়েছে মার্ক্সীয় দর্শনের আলোকে। এখন কেউ যদি বলেন, একটি নির্দিষ্ট তত্ত্ব–দর্শনের আলোকে বিচিত্র সাহিত্যকর্মকে বিচার করা একদেশদর্শিতা—কী বলবেন? সিরাজুল: আশা করি একদেশদর্শিতা ঘটেনি। সাহিত্যকে আমি সাহিত্য হিসেবেই দেখেছি। প্রথম বিচারটা নান্দনিক। তবে নান্দনিক বিচার অসম্পূর্ণ থাকে ভেতরের বস্তুকে বিচারে না নিলে এবং কোনো সাহিত্যই মহৎ সাহিত্য হয় না, যদি না ভেতরে গভীর কিছু থাকে। পাখির গান বা বাগানের ফুল যে অর্থে সুন্দর, সাহিত্যের সৌন্দর্য অবশ্যই তার চেয়ে গভীরতর। এই গভীরতাটা আসে দার্শনিকতা থেকে। দার্শনিকতারই অংশ হচ্ছে মতাদর্শ। আমার চেষ্টা ছিল ওই দার্শনিকতাটাকে দেখার। দার্শনিকতার কারণেই সাহিত্যে বক্তব্য আসে। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে লেখক যা বলতে চাইছেন, তাঁর লেখা তা বলছে না। ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্ব রচনাকে প্রাণবন্ত করে। দ্বন্দ্ব থাকে ভাষা ও আঙ্গিকের সঙ্গে বক্তব্যের। এই ব্যাপারেও আমার কৌতূহল ছিল। সব মিলিয়ে, আমি বলব যে আমার একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল; আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে সাহিত্যসমালোচনা করতে চেয়েছি। এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই একদেশদর্শিতা বলে মনে হতে পারে। আমার নিজের কিন্তু তা মনে হয়নি। আলতাফ: স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে কলকাতা ও ঢাকার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ও মূল ফারাকগুলো আপনার কাছে কী মনে হয়? সিরাজুল: পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন শোনা যাচ্ছিল আমাদের সাহিত্য হবে স্বতন্ত্র। ভাষা, বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা—সবই হবে পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের একাংশও বাদ দেওয়া চাই। তেমন কাণ্ড কিন্তু ঘটেনি। তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র যেহেতু আলাদা এবং সমাজবিকাশের ধারাও যেহেতু স্বতন্ত্র, তাই সে বাস্তবতার প্রকাশ সাহিত্যে তো ঘটবেই। আর এটাও তো মানতে হবে যে বাংলাদেশ যেহেতু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ বৃহৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্যমাত্র, তাই বাংলা সাহিত্যের চর্চা এখানেই বেশি হবে এবং হচ্ছেও। আর এই চর্চার ক্ষেত্রে মননশীলতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য অধিক সমৃদ্ধ বলে আমার ধারণা। তা ছাড়া তুলনামূলকভাবে আমাদের সাহিত্যে বৈচিত্র্যও বেশি। আলতাফ: আপনারা সাহিত্যসমালোচনার ধারাটি এখানে যেভাবে গড়ে তুলেছিলেন, সেটি পরে আর বিস্তৃত হলো না কেন? স্বাধীন বাংলাদেশে সাহিত্যসমালোচনা বিকশিত না হওয়ার পেছনের কারণগুলো কী? সিরাজুল: প্রশ্ন এখানে দুটো। আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাহিত্যসমালোচনার ধারাটি কেন বিস্তৃত হলো না এবং সাহিত্যসমালোচনাই-বা কেন বিকশিত হলো না। দুটি বিষয় কিন্তু পরস্পর সংলগ্ন। সাহিত্যবিচারে ইতিহাসের স্থান বিবেচনা ও ইতিহাসবিচারে দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগ—এরা যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, ততটা গুরুত্ব পায়নি। নান্দনিক বিচারটাই মুখ্য হয়ে রয়েছে। এর পেছনের ঘটনাটা হলো জ্ঞানচর্চার দুর্বলতা। জ্ঞানের চর্চা উৎসাহ পায়নি। বিশেষত দর্শনচর্চা অবহেলিতই থেকেছে। সাহিত্যসমালোচনা বলে নয়, সাহিত্যের নিজেরই মূল্য কমে গেছে। সমাজে বস্তুগত উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু সে উন্নতি পুঁজিবাদী ধরনের। এই উন্নতি মুনাফা চেনে, সংবেদনশীলতা বোঝে না। সাহিত্য তো বস্তুগত মুনাফা দেবে না, দেবে অন্তর্গত আনন্দ, বিকশিত করবে সংবেদনশীলতাকে। ভোগবাদিতা এসেছে, এসেছে স্থূল বিনোদন। সাহিত্য তো স্থূল বিনোদনের সামগ্রী নয়। দুরন্ত তৎপরতা চলছে মিডিয়ার। মিডিয়া জগৎটাকে বড় করতে গিয়ে ছোটই করে ফেলেছে। ছোট পর্দায় আমাদের আটকে রাখছে। যেমন ধরা যাক চলচ্চিত্র। সেটা তো সামাজিকভাবে উপভোগ করার জিনিস, এখন প্রায় সবাই তো সিনেমা দেখছে ব্যক্তিগতভাবে, যেন লুকিয়ে লুকিয়ে। সাহিত্যের লড়াইটা কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধেই। সাহিত্য হচ্ছে সামাজিক। বই আমরা একলা একলাই পড়তে পারি, পড়িও; কিন্তু বই আমাদের যুক্ত করে বড় জগতের সঙ্গে, নিয়ে যায় অজানা-অদেখা মানুষদের কাছে; আমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। পুঁজিবাদী উন্নতির চাপে এখন কেবল সাহিত্য নয়, মানবিক বিদ্যারই কোণঠাসা দশা হয়েছে। ১০০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কমার্স বলে কোনো স্বতন্ত্র অনুষদ তো নয়ই, বিভাগও ছিল না। কমার্স ছিল অর্থনীতি বিভাগের একটি অংশ। তারপর কমার্স অনুষদ হলো, অনুষদে বিভাগের সংখ্যা বাড়ল। কমার্স অনুষদে এখন নয়টি বিভাগ। অনুষদের নামও গেছে বদলে। সেখানে বাণিজ্য নেই, উঠে এসেছে ব্যবসা, অনুষদের নাম হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ। একসময় ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট ছিল না। পরে হয়েছে এবং এখন তা অত্যন্ত আকর্ষণীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রূপ নিয়েছে। বাণিজ্য অধ্যয়নের গুরুত্ব অনেক; মানবিক বিদ্যার অবস্থা গরিব আত্মীয়ের মতো। উন্নয়ন একপেশে হচ্ছে। ভারসাম্য থাকছে না। এই উন্নয়নে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; তাই সাহিত্যসমালোচনাও মর্যাদা পাচ্ছে না। সাহিত্য তো আসবে প্রথমে, তারপর না সমালোচনা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। পাকিস্তান আমলে আমরা একটি মাসিক পত্রিকা বের করতাম পরিক্রম নামে। পত্রিকাটির একটি বড় আকর্ষণ ছিল দেশি-বিদেশি বইয়ের আলোচনা। বাংলাদেশ আমলে সাহিত্যপত্র নামের একটি ত্রৈমাসিকের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম; সেখানেও সাহিত্যসমালোচনা থাকত; তবে আগেরটির চেয়ে কম। ২০ বছর হতে চলল, সাহিত্য-সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছি, তাতে সাহিত্যসমালোচনা ছাপা হয় আগের দুটির তুলনায় অনেক কম। সাহিত্যসমালোচনার এই নিম্নগমন বস্তুগত উন্নয়নের বিপরীতমুখী করুণ সহযাত্রী। নিয়মিত প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা এখন নেই বললেই চলে। দৈনিক পত্রিকায় আগে সপ্তাহে দুই পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকত সাহিত্য সাময়িকীর জন্য; এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অত্যন্ত সংকুচিত, কোথাও কোথাও অন্তর্হিত। চাপ আছে বিজ্ঞাপনের। খবরটা ওই একই; সাহিত্যের পঠন-পাঠন ভালো অবস্থায় নেই, সাহিত্যসমালোচনাও তাই প্রাণবন্ত নয়। আলতাফ: অতীতে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন পীড়ন ও সংকটে লেখকসমাজ বরাবরই সোচ্চার ছিলেন। আর এখন নানাবিধ সংকটে, উৎপীড়নে হাতে গোনা কয়েকজন বাদে লেখকদের একটা বড় অংশকেই সেভাবে সরব হতে দেখা যায় না। তাহলে অলক্ষ্যে আমাদের সমাজে ও লেখালেখির জগতে কি কোনো রূপান্তর ঘটে গেছে? সিরাজুল: না, কোনো রূপান্তর ঘটেনি। তবে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা যে ধারায় বিকশিত হওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল, সে ধারায় ঘটেনি। কথা ছিল আমরা মুক্তি পাব। মুক্তি পাব আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কবল থেকে। সেটা পাইনি। রাষ্ট্র বরঞ্চ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি আমলাতান্ত্রিক এবং বৈষয়িক সব উন্নতির একই রাস্তা—পুঁজিবাদী। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আত্মস্বার্থপর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র সমালোচনা সহ্য করে না। সমাজ ইহজাগতিকতা থেকে পশ্চাতে সরছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। গণমাধ্যম স্বাধীন মত প্রকাশকে উৎসাহ দেয় না, নীরবে তার কণ্ঠ রোধ করে। সার্বিক এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ এখন অত্যন্ত ক্ষীণ। সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও এই ব্যবস্থার অধীনে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁদের কাজ তো বিদ্যমানের কাছে আত্মসমর্পণ নয়। ব্যবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে না থাকলে ব্যবস্থা তো বদলাবেই না, তাঁদের কাজ ও মূল্য হারাবে। সমস্যাটা অবশ্য কেবল আমাদের দেশের নয়, সারা বিশ্বেরই। প্রতিবাদ বিশ্বজুড়েই হচ্ছে, আমাদের দেশেও তা হওয়া চাই। হবে বলে আশা রাখি; নইলে সত্য তো হবে হতাশা ও আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণ কিন্তু আত্মহত্যারই পথ। আলতাফ: অন্বেষা নামে আপনার প্রথম বই েবর হয় ১৯৬৪ সালে। এরপর ৫৭ বছরে নানা বিষয়ে অনেক বই লিখেছেন আপনি। নিজের লেখা প্রিয় বই কোনগুলো? সিরাজুল: বিশেষ রকমের প্রিয় বই হচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালী মধ্যবিত্ত, আমার পিতার মুখ এবং জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি। আলতাফ: বন্ধু ও সহযাত্রী নাজমা জেসমিন চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছিলেন বন্ধুর মুখচ্ছবি। আপনার বন্ধুটি গত হয়েছেন অনেক দিন। তাঁর অভাব কীভাবে অনুভব করেন? সিরাজুল: নাজমা চলে গেছে তিন দশকের বেশি হলো। তার মৃত্যু সেই ১৯৮৯ সালে। শূন্যতাটা ভীষণ গভীরে। সেটা পারিবারিকভাবে যেমন, সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রেও তেমনি। আমাদের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের। ক্ষতির পরিমাপ করাটা সত্যি অসম্ভব। বেঁচে থাকলে নাজমা অনেক ক্ষেত্রে অনেক কাজ করতে পারত। সৃষ্টিশীলতার পূর্ণ মুহূর্তেই তার প্রস্থানটা ঘটল। একটা কারণ তখনকার চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতা। সাহিত্যের নিজেরই মূল্য কমে গেছে। সমাজে বস্তুগত উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু সে উন্নতি পুঁজিবাদী ধরনের। এই উন্নতি মুনাফা চেনে, সংবেদনশীলতা বোঝে না। আলতাফ: করোনা মহামারি আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে? লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো নতুন ভাবনা কি এসেছে? সিরাজুল: করোনা মহামারি বিশ্বের সব মানুষকে অসামাজিক প্রাণীতে পরিণত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রোগটা পুঁজিবাদ থেকেই উদ্ভূত এবং পুঁজিবাদেরই প্রতিভূ। পুঁজিবাদী উন্নয়ন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার নিরাপত্তা দেয়নি এবং প্রকৃতির ওপর নির্মম নিষ্পেষণ চালিয়েছে। প্রকৃতি নানাভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে; করোনাভাইরাসের আক্রমণ তারই একটি। এই মহামারি মানুষের সামাজিকতাকে খর্ব করে দিয়েছে। আমাকেও প্রভাবিত করেছে বৈকি। না, নতুন কোনো ভাবনা আমার আসেনি; তবে পুরোনো ভাবনা জোরদার হয়েছে। সেটা হলো এই যে এই ব্যবস্থার বদল চাই এবং তার জন্য যা প্রয়োজন হবে তা হলো, সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। আলতাফ: আপনি তো আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছেন। সেটি কবে আলোর মুখ দেখবে? সিরাজুল: আত্মজৈবনিক লেখা কিছু কিছু আগেও লিখেছি। এখনকার কাজটা হচ্ছে অভিজ্ঞতার সারবস্তুগুলোকে একসঙ্গে করা। অনেকটা ছেঁকে তোলা। এ নিয়ে সব সময়ই ভাবছি। খসড়াও দাঁড় করাচ্ছি। তবে কখন শেষ করতে পারব, সেটা নির্ভর করছে অন্য কাজের দায়িত্ব কমানোর ওপর। কমানোর চেষ্টা চলছে, যাতে জরুরি ওই লেখাটার ওপর আরও বেশি এবং সম্ভব হলে পূর্ণ মনোযোগই দেওয়া যায়। আলতাফ: ৮৫ বছর পূর্ণ করে জীবন সম্পর্কে আপনার উপলব্ধি কী? একজন সাহিত্যিক হিসেবে নিজের সাহিত্যকে আপনি কীভাবে দেখেন? সিরাজুল: উপলব্ধিটা এই রকমের—জীবন যেভাবে কেটেছে, তার থেকে অন্যভাবে কাটাটা সম্ভব ছিল না। যা করতে পেরেছি, মোটামুটি তা-ই করার কথা ছিল। তবে আরও ভালোভাবে, অভিনিবেশসহকারে, যত্ন নিয়ে হয়তো করা যেত। মূল কাজটা হওয়ার কথা ছিল সাহিত্যিক। সেটা করেছি। আর যা করেছি তা হলো পত্রিকা সম্পাদনা। হাতে লেখা পত্রিকা ও দেয়ালপত্রিকা থেকে শুরু করে মাসিক, ত্রৈমাসিক ও দ্বিবার্ষিক, এমনকি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনারও অভিজ্ঞতা হয়েছে। সম্পাদকের কাজটা না করে উপায় ছিল না। ওই কাজে আনন্দও ছিল। সাহিত্যকে আমি অত্যন্ত মূল্যবান মনে করি। সাহিত্য এখন অনেকটা কোণঠাসা অবস্থায় আছে; কারণ, মানুষ নিজেই এখন আবদ্ধ। এই ব্যবস্থা টিকবে না। এর বদল অবশ্যম্ভাবী। কারণ, মানুষ তার মনুষ্যত্ব খোয়াতে রাজি হবে না। আর সেই মানুষ্যত্ব রক্ষার কাজে সাহিত্য অবশ্যই একটা ভূমিকা রাখবে। জরুরি ভূমিকা।