বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সির (ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুু) কারণে প্রাণ হারান। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। মারা যান প্রায় ২৩ হাজার মানুষ। প্রখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল দ্য ল্যানসেট বলছে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু থেকে সৃষ্ট নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসেনি। ১১৪টি দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে বিভিন্ন জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এতে অচিরেই খুব সাধারণ সংক্রমণ বা সামান্য কাটাছেঁড়া থেকে মৃত্যু হবে মানুষের। খুব দ্রুত যদি এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তা হলে বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠবে।
শঙ্কার বিষয় হলো, বাংলাদেশে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো গবেষণা নেই। কিছুদিন আগে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালিত ‘ফাইন্ডিংস ফ্রম অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স সার্ভিলেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, এ দেশেও প্রায় সব ধরনের জীবাণু ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞরা এমন পরিস্থিতিকে নীরব মহামারী উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) জানিয়েছে, ২০১৮ সালে তাদের আইসিইউতে ৯০০ রোগী ভর্তি হন। যাদের মধ্যে ৪০০ জনের মৃত্যু হয়। এ মৃতদের প্রায় ৮০ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ছিল।
আমাদের জন্য একে ভয়ঙ্কর খবর বলে উল্লেখ করেছেন বিএসএমএমইউর বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মৃতদের শরীরেও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু পাওয়ার ঘটনায় সহজেই প্রতীয়মান হয়, দেশজুড়ে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সির অবস্থা খুব খারাপ। সামনে হয়তো এমন সময় অপেক্ষা করছে, যখন একজন মানুষ হাসপাতালে জীবাণু সংক্রমিত অবস্থায় থাকবে অথচ কোনো ওষুধই তার কাজে আসবে না। এর মতো মর্মান্তিক আর কিছু হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমনা বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ ফার্মেসি আছে, যাদের বড় অংশ অনিবন্ধিত। এ ফার্মেসিগুলো যদি একদিনে অন্তত ৫টি করে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে, তা হলে দিনে তারা ১০ থেকে ১৫ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে। যার মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের হয়তো এটার প্রয়োজন ছিল। এভাবে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ অপ্রয়োজনে বা ভুলভাবে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। অ্যান্টিবায়োটিক এভাবে বিক্রি হলে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার খুব স্বাভাবিক।’
আইইডিসিআর তাদের ‘ফাইন্ডিংস ফ্রম অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স সার্ভিলেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া প্রায় সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। গবেষণা দলের প্রধান আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জাকির হোসেন হাবিব বলেন, ‘ইমিপেনেম অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া। এ জীবাণু সাধারণত তিনভাবে শরীরে আক্রমণ করে মানুষের মৃত্যু নিশ্চিতে করে। মূত্রনালির মাধ্যমে, কাটা বা ক্ষতস্থানে সংক্রমণ ঘটিয়ে এবং আইসিইউতে রোগীর শরীরে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটিয়ে। এ ছাড়া ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া অ্যামিকাসিন অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ, নাইট্রোফুরানটনের ক্ষেত্রে ৭৭ শতাংশ, জেনটামাইসিনের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এমনকি বছরখানেক আগে বাজারে আসা পঞ্চম প্রজন্মের সর্বাধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক সেফিপিম-এর ক্ষেত্রেও ৪৫ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে এ জীবাণু। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় পিডিআর বা প্যান ড্রাগ রেজিস্টেন্স। অন্যদিকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে মূত্রনালির সংক্রমণ ঘটানো জীবাণু প্রটিয়াস, সিউডোমোনাস এরোজিনোসা, অ্যাসাইনোটা ব্যাক্টর, টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের জীবাণু সালমোনেলা, রক্ত আমাশয়ের জীবাণু সাইগেলা, কলেরার জীবাণু ভাইব্রো কলেরা। এসব জীবাণুর কোনোটি এমডিআর বা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্স, কোনটি এক্সডিআর বা এক্সটেনসিভ ড্রাগ রেজিস্টেন্স (এমডিআরের চেয়ে বেশি প্রতিরোধী)। ফলে এখন যে রোগই হোক না কেন, নিশ্চিন্তে ওষুধ খাওয়ার অবস্থা নেই।’
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. সাইয়েদুর রহমান বলেন, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে সব অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণু অপ্রতিরোধী হয়ে যাবে। তাই ব্যাক্টেরিয়ার সঙ্গে যেন ওষুধের দেখা না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। বন্ধ করতে হবে অ্যান্টিবায়োটিকের যাথেচ্ছ ব্যবহার। যেখানে প্রয়োজন শুধু সেখানেই ব্যবহার করেতে হবে অ্যান্টিবায়োটিক। মনে রাখতে হবে, কোভিডের চেয়ে এ মহামারী বেশি ভয়ঙ্কর। কমিশনের প্রলোভন থেকে চিকিৎসক এবং ওষুধ বিক্রেতাদের সংযত হতে হবে। সরকার সবাইকে সচেতন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। সব অ্যান্টিবায়োটিকের মোড়কে লাল রং থাকবে। সেই উদ্যোগ সফল করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। যা অনেক শিশুর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ না থাকা শিশুদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর শঙ্কা ১৭ গুণ বেশি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানিয়েছে, জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেট লাল রঙের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে প্যাকেট দেখে সবাই বুঝতে পারে এটি অ্যান্টিবায়োটিক। যা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেনা বা বিক্রি নিষিদ্ধ। এ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেটে কমপক্ষে ততগুলো ওষুধ রাখতে হবে, যাতে একটি কোর্স সম্পন্ন হয়। তা হলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সি কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন