পোস্টমাস্টার বাবার স্বল্প বেতনের অভাবী সংসারের সন্তান ছিলেন তিনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ভরতপুরে জন্ম নেওয়া এই চিকিৎসকই বাংলাদেশে নতুন এক ধারার ‘আন্দোলন’ গড়ে তোলে হয়ে ওঠেন মহীরুহ। ‘ডায়াবেটিস আন্দোলন’ সৃষ্টি করে দেশের লাখ লাখ মানুষের সামনে অচেনা এক রোগ নিয়ে বিপুল সচেতনতা তৈরি করেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। যার পুরো নাম শেখ আবু মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ও বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা।
ডায়াবেটিক রোগী ও ডায়াবেটিস রোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত। বলা যায়, প্রতিটি পরিবারেই এখন ডায়াবেটিসের বসবাস। রোগের সঙ্গে কলেবর বেড়েছে চিকিৎসা সুবিধারও। এই চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার পিছনে যে মানুষটির নাম চলে আসে তিনি ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
১৯৫০-এর দশকে যখন ডায়াবেটিস রোগটির সঙ্গে দেশের মানুষের পরিচয় হয়নি, তখন ডা. ইব্রাহিম উপলব্ধি করেন এই রোগটির ভবিষ্যৎ প্রকটতা। তিনি বুঝতে পারেন, যেহেতু দেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ও নিরক্ষর, সেহেতু দরিদ্র ডায়াবেটিক রোগীর বোঝা হয়ে উঠবে এটি। সেই চিন্তা থেকে দেশের সর্বসাধারণের জন্য ডায়াবেটিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটা আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ার তাগিদ অনুভব করেন তিনি।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিজ বাসভবনে ‘পাকিস্তান ডায়াবেটিক সমিতি’ গঠনে প্রথম বৈঠক করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যা 'বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি' হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। গত ৬ দশক থেকে তার প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিক সমিতি ও এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান—বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক, বারডেম মেডিক্যাল কলেজ দেশের মানুষের পরম আস্থার জায়গায় রূপ নিয়েছে।
‘ডায়াবেটিক সমিতি ডা. ইব্রাহিম ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন’—বলছিলেন সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সাইফ উদ্দীন। তিনি বলেন, সে সময় ডায়াবেটিস নিয়ে কোনও আলোচনা হতো না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত রোগ থাকতে আপনি ডায়াবেটিক নিয়ে কেন সমিতি করলেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন ডাক্তার, আমি অনেক রোগের চিকিৎসা করতে পারি, ভালো করতে পারি। কিন্তু এটা এমন একটা রোগ, ভালো করা যায় না, নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটার জন্য রোগী, রোগীর পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা লাগবে। ডায়াবেটিক শুধু মেডিক্যাল সমস্যা না, এটা সামাজিক সমস্যাও।
সাইফ উদ্দীনের ভাষ্য, ডা. ইব্রাহিম চাইতেন ডায়াবেটিক সেবাটাকে মানুষের কাছাকাছি নেওয়ার।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, ১৯১১ সালে ডা. ইব্রাহিমের জন্ম হয়েছিল বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ভরতপুরে। অভাবী সংসারের সন্তান ছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের স্কুলটার দূরত্ব ছিল ৬ মাইল, তাও পায়ে হেঁটে যাতায়াত। সেই অজপাড়াগাঁয়ের ছেলেটাই হয়ে ওঠেন একসময় বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক; চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম।
ডা. ইব্রাহিমের প্রাথমিক থেকে মেডিক্যাল পড়াশোনা পশ্চিমবঙ্গেই। ১৯৩৮ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে চূড়ান্ত মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে এমবিবিএস পাস করেন তিনি। সেখানেই শুরু তার কর্মজীবন। ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে। পরে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগ দেন তিনি। সেখানে যোগ দেওয়ার ২ বছরের মাথায় দেশভাগ হয়।
তখন ডা. ইব্রাহিম চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যোগ দেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন হিসেবে। একইসঙ্গে তিনি জেনারেল হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিনের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম যুক্তরাজ্য থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরের বছর আমেরিকান কলেজ অব চেস্ট ফিজিশিয়ানস থেকে এফসিসিপি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫০ সালে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ফিজিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন। পরে সেখানেই নিযুক্ত হন মেডিসিনের অধ্যাপক হিসেবে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে থাকাকালীন কয়েকজন বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষীকে নিয়ে শুরু করেন পাকিস্তান ডায়াবেটিক সমিতি। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে তিনি আমেরিকান কলেজ অব চেস্ট ফিজিশিয়ানস পাকিস্তান চ্যাপ্টারের গভর্নর, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এশিয়া অঞ্চলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করেন।
সত্তরের দশকেই চিকিৎসক ইব্রাহিম প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডারস (বারডেম)। বর্তমানে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এবং ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষায়িত এশিয়ার প্রথম হাসপাতাল বারডেম।
ডা. ইব্রাহিমের জামাতা ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডায়াবেটিক একটি সারা জীবনের রোগ, তাই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। মানুষকে সচেতন করতে ও সর্বশ্রেণির মানুষকে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে ডা. ইব্রাহীম উদ্যোগ নেন। তার পরিকল্পনা ও চেষ্টায় দেশে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে, যা উপমহাদেশে উদাহরণ।
অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান জানান, বারডেম ছাড়াও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালিত ছোট-বড় ১০০টি হাসপাতাল রয়েছে এবং চিকিৎসাসেবা পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে।
বারডেম সূত্র বলছে, প্রতিদিন সাড়ে ৩ হাজারের বেশি রোগী বারডেমের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা ও খাবারের সম্পূর্ণ খরচ বহন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বারডেমে মোট ৬০টি বিভাগে এখন ৫১৯ জন চিকিৎসক, ৬৩৯ জন নার্স ও আড়াই হাজারেরও বেশি কর্মচারী নিয়োজিত। বারডেমে নিবন্ধনকৃত রোগীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৭ লাখ। রোগীদের আর্থিক অবস্থাভেদে ওষুধ ও চিকিৎসায় ২৫ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত ছাড়ও দেয় বারডেম। বারডেমে ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিজম বিষয়ে এমফিল, এমডি ও পিএইচডিসহ ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি কোর্স পরিচালনা করা হয়।
সেগুনবাগিচায় টিনের ঘরে যাত্রা শুরু হয়েছিল
বিশাল পরিসরে এখন বারডেম পরিচালিত হলেও শুরুর সময়টা সহজ ছিল না ডা. ইব্রাহিমের জন্য। ১৯৫৭ সালে সেগুনবাগিচায় নিজ বাসভবনে মাত্র ৩৮০ স্কয়ার ফুটের একটি টিনের ঘরে ২৩ জন ডায়াবেটিক রোগী নিয়ে বহির্বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডা. ইব্রাহিম। তিনি চেয়েছিলেন কোনও ডায়াবেটিক রোগী বিনা চিকিৎসায় যেন মারা না যায়। সে কারণে তিনি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। ১৯৮০ সালে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে নতুন আঙ্গিকে স্থাপিত হয় বারডেম। যেখান থেকে বৃহত্তর পরিসরে পরিচালিত হচ্ছে দেশের ডায়াবেটিক আন্দোলন।
ডা. ইব্রাহিম জানতেন, ডায়াবেটিক সেবা শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সারা দেশে মানুষকে সহজে সেবা প্রদানের লক্ষ্যে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৪ সালে খুলনা ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হয় ডায়াবেটিক সেবার যাত্রা। বর্তমানে ৬১ জেলায় ও ২৯টি থানায় ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমে সর্বস্তরের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। ডায়াবেটিক সমিতির নিবন্ধিত সেবাগ্রহীতা বর্তমানে ৩০ লাখেরও বেশি।
ডা. ইব্রাহিমকে নিয়ে লিখেছেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। তিনি ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য। এক নিবন্ধে ড. মজিদ উল্লেখ করেন, ‘রোগ ভালো না করে টাকা নেওয়ার বিষয়ে ডা. ইব্রাহিম লজ্জাবোধ করতেন। সেজন্যই ভালো করা যায় না এমন রোগ ডায়াবেটিসের জন্য তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বিনা পয়সার চিকিৎসালয় খুলতে।’
ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ এও উল্লেখ করেন, ‘চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি (ডা. ইব্রাহিম) জনসেবা করবেন, এটাই ছিল তার মূল জীবন দর্শন।’
১৯৬৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার ডা. ইব্রাহিমকে সিতারা-ই-খিদমত উপাধিতে ভূষিত করে বলে বারডেম থেকে জানানো হয়।
বলা হয়, স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হিসেবে পরিচিত স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি দেশে চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হন। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন এবং একই বছর চিকিৎসা ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য মাহবুব আলী খান পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৬ সালে জর্ডানে অবস্থিত ইসলামিক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য তাকে প্রতিষ্ঠাতা ফেলো নির্বাচন করা হয়। তিনি ১৯৮৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের জন্য কুমিল্লা ফাউন্ডেশনের স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ স্মারক স্বর্ণপদক, ১৯৮৯ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের স্বর্ণপদক এবং ১৯৯১ সালে চিকিৎসাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মওলানা আকরম খাঁ স্মারক স্বর্ণপদক লাভ করেন বলেও জানায় বারডেমের অফিসিয়াল সূত্র।
পথিকৃৎ এই মানুষটি ১৯৮৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন