দেশে প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক পর্যায়ে বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিদিন বেশি দাম দিয়ে কিনে মানুষ কি খাচ্ছেন? হোটেল রেস্তোরাঁর সুস্বাদু গ্রিল, কাবাব, শর্মা, রোস্ট, চিকেন স্যুপ থেকে শুরু করে মাছ-গোশত, ফলমূল, শাক-সবজি, দুধ ও অন্যান্য পানীয় দ্রব্যসহ সর্বত্র ভেজালের ছড়াছড়ি। অভিজাত হোটেল থেকে রাস্তার ফুটপাত একই চিত্র। ভেজাল খাবার খাওয়ায় কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এ ছাড়াও নানা জটিলতায় পড়ছে মানুষ এসব ভেজাল খাবার খেয়ে। অথচ ভেজাল খাবার তদারকি দায়িত্ব যাদের সেই সব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) যেন জেগেই ঘুমাচ্ছে। মাঝেমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠান অভিযান চালায় এবং ভ্রাম্যমান আদালত বসায় সেগুলো কার্যত লোক দেখানো এবং টিভি ক্যামেরা দেখানোর জন্য। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নামকরা হোটেল এবং ফাস্টফুডের দোকানে অনুসন্ধান করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সর্বোত্রই ভেজাল খাবার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ভেজাল খাদ্যের তালিকায় বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। দেশের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায়ও গরুর দুধ, দইয়ের মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় অণুজীব, অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক এবং সিসা পাওয়া যায়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এতে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভেজাল খাওয়ার কারণে ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৮ হাজার ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা গেছে ১০ হাজার ৬২২ জন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. এম আকতারুজ্জামান বলেন, কিছু কিছু খাবারে ভেজালতো আছেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এ বিষয়ে তদারকি করা। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম বলেন, অভিযান দিয়ে নিরাপদ খাদ্য হয় না। নিরাপদ খাদ্যের জন্য দরকার জানা, বোঝা এবং মানা। তারপর হচ্ছে অভিযান। খাবারটা একটা বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাপার। আমাদের অভিযান হয়, সবাই যেহেতু অভিযান করে; আমরাও করি। কিন্তু সেখানে সমস্যাটা হচ্ছে, আমাদের লোকবল খুবই কম। তা ছাড়া অভিযান কোনো দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল দেবে না। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম খাদ্য। নাগরিকদের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন চালু হয়েছে। তবে নিয়মিত নজরদারি ও আইন বাস্তবায়নের অভাবে থামছে না অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য। ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতার কারণে মানুষ আজ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। খাদ্যদ্রব্যে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল আর বিষাক্ত দ্রব্যের অতিরঞ্জিত ব্যবহারে নির্ভেজাল খাবার পাওয়াই দায়। ভেজাল খাদ্যের প্রভাবে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস এবং কিডনি অকেজো হওয়ার মতো অন্যান্য ক্রনিক রোগ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলমূল, মাছ, গোশত থেকে শুরু করে শাক-সবজি, দুধ ও অন্যান্য পানীয় দ্রব্যসহ সর্বত্র ভেজালের ছড়াছড়ি। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর অর্থলিপ্সা আর নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অন্যদিকে তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) তৎপরতা চোখে পড়ার মতো নয়। দু’চার দিন অভিযান পরিচালনার পর আবারো নিখোঁজ হয়ে যান তারা। যদিও তারা বলছেন, জনবল সঙ্কটের কারণে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এতে অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা আরো বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে রীতিমতো ‘ঘুম হারাম’ নিম্ন, মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের।
এরই প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে। গুরুত্বপূর্ণ এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান রাজনৈতিক সঙ্কটে থাকা শ্রীলঙ্কার চেয়েও একধাপ পেছনে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। আর শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৭৯তম।
বাজারে বর্তমানে এমন কোনো খাবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো ভেজাল নেই। ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায় গরুর দুধ, দইয়ের মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় অণুজীব, অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক এবং সিসা পাওয়া যায়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এতে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। আর কনডেন্সড মিল্কে পাওয়া যায় পাম তেলসহ বিভিন্ন রাসায়নিক। পরীক্ষায় ধরা পড়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা স্যাকারিন, আটা-ময়দাসহ বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে তৈরি করে ভেজাল গুঁড়োদুধ। এমনকি রং ও রাসায়নিক মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে চালও। বাজারে বিক্রি হওয়া সরিষার তেলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে কৃত্রিম ঝাঁজ তৈরি করছেন। চিনিতেও দেদার ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ঘনচিনির নামে এখন মানুষকে খাওয়ানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, সাইট্রিক অ্যাসিড, সোডিয়াম সাইট্রেটের মতো ক্ষতিকর উপাদান। শিশু খাদ্যের বিক্রি ভালো হওয়ায় ভেজাল মেশানো হচ্ছে আইসক্রিমেও। সেপ্টেম্বর মাসে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ভোক্তা অধিকারের অভিযানে সাতক্ষীরায় ভেজাল দুধ প্রস্তুতকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়।
ফল খাওয়ার উপকারিতা যেকোনো বয়সের যে কারোর জন্যে দারুণ। একদম ছোট শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-তরুণ, প্রাপ্তবয়স্ক এমনকি বৃদ্ধদেরও নিয়মিতভাবে ফল খাওয়া উচিত এবং প্রতিদিন কিছু পরিমাণে হলেও ফল খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং বি কমপ্লেক্স রয়েছে বাংলাদেশের মৌসুমি ফলে। কিন্তু দেশি ফলেও ফরমালিন মেশানোর ঘটনা ধরা পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।
দেশি প্রায় সব ফলেই ফরমালিন মেশানো হয়। ইথোফেন নামের বিষাক্ত হরমোনাল স্প্রে দিয়ে কাঁচা ফল পাকানো হয়। আবার পচা ফল তাজা রাখতেও কেমিক্যাল রয়েছে। এটি ফরমালিনের চেয়েও ভয়ানক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তরমুজের ভেতর সিরিঞ্জ দিয়ে ক্ষতিকর এরিথ্রোসিন বি এবং স্যাকারিন পুশ করে লাল ও মিষ্টি করার কাণ্ডও ধরা পড়েছে। বাদ পড়ছে না আম, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আনারসও। জাতীয় ফল কাঁঠালও এর বাইরে নয়। এক সময় ‘ঘাই’ দিয়ে কাঁঠাল পাকানোর কথা শোনা যেত। ‘ঘাই’ মানে পেরেক ধরনের একটা রড বা পাইপ দিয়ে বোঁটার দিক ফুটো করে দেয়া। এতে কাঁঠাল দ্রুত পাকে। এখন ঘাইয়ের সঙ্গে বিষও দেয়া হয়। এ তালিকার সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ফলের নাম কলা। বাংলাদেশে সবরি-চাঁপা-সাগর কলা উৎপাদন হয়। সময়ের আগে কলায় বিশেষ করে সবরি কলায় হরমোন স্প্রে করা হয়। অপরিণত কলা কেরোসিনের স্টোভের হিট দিয়ে নরম করা হয়। রাইপেন-ইথোফেন বা কার্বাইড স্প্রে করে পাকানো হয়। স্প্রে করার আগে কলা পরিষ্কার করা হয় সার্ফএক্সেল বা শ্যাম্পু দিয়ে। পাকানোর এ বিষাক্ত পদ্ধতি রাজধানীর বাদামতলি থেকে কারওয়ানবাজার এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলার আড়তে চলছে হরদম। সেই বিষাক্ত কলা বাজার থেকে কিনে খায় মানুষ। মৌসুমি আরেক দেশি ফল লিচুতেও পাঁচ থেকে ছয়বার কীটনাশক স্প্রে করা হয়। ঝরে না পড়া, বোঁটা শক্ত রাখা, রঙ চকচকে করাসহ সব কিছুর জন্য বিষ দেয়া হয়। এখন আবার আমড়া-জাম্বুরায়ও পর্যন্ত কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। চলতি বছরের ১২ এপ্রিল গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অভিযান চালিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করে অনেক ব্যবসায়ীকে অর্থদণ্ড দেয় বিএসটিআই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবসায়ীরা সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০ গুণ বা তারচেয়েও বেশি মাত্রায় সে সকল বিষাক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে থাকে। টমেটো, মাল্টা ও লিচুতে সবচেয়ে বিপদজনক মাত্রায় এর ব্যবহার হয়ে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। গরু, ছাগল ইত্যাদি গবাদি পশুকে মোটা-তাজা করতে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন কেমিক্যাল ও সারজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার করে যা উক্ত পশুসহ এর গোশত আহারকারীদের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে।
হোটেল রেস্তোরাঁয় বিক্রি হওয়া সুস্বাদু গ্রিল, কাবাব, শর্মা, রোস্ট, চিকেন স্যুপ ইত্যাদিও ভেজালমুক্ত নয়। জানা যায়, রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশন সংলগ্ন মুরগির আড়তে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে মরা মুরগি হোটেলের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা অবস্থায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৬-৭ জনের অন্য একটি চক্র এসব মরা মুরগি ৭০-৮০ টাকায় কিনে তা হোটেলে সস্তায় বেঁচে থাকে। অধিক মুনাফালোভী মালিকরা জেনে-শুনে তা পরিবেশন করে থাকেন। মরা মুরগি ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি পোলট্রি ফিডেও ক্রোমিয়ামের মত ভয়াবহ কেমিক্যাল পেয়েছেন। যা আগুনে জ্বালালেও তার ক্ষয় নেই, মাটিও তা হজম করতে পারে না। বিভিন্ন কোল্ড ড্রিংস এবং পানীয়ও রয়েছে ভেজালের এ তালিকায় এবং সমানভাবে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে নীরবভাবে। মানবতার যে চরম অবনতি হয়েছে এবং মানবিক মূলবোধের যে অবক্ষয় হয়েছে তারই বড় উদাহরণ হচ্ছে ওষুধেও ভেজাল। ভেজালের তালিকা থেকে মানুষের জীবনের সুস্থতার সহায়ক ওষুধও মুক্ত নয়। বিভিন্ন সময় নানান জায়গায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন ওষুধে ভেজালের অভিযোগে।
খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বিষয়ে অভিযোগ পাহাড়ের সমান উঁচু। কিন্তু সেই তুলনায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার ও বিএসটিআই অভিযান চালালেও তা অপ্রতুল। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের অভিযানে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন থেকে শুরু করে ফুটপাতের বিভিন্ন খাবারের দোকানও ছাড় পায়নি। অবশ্য অভিযান পরিচালনার পরদিন থেকেই আবার একই দৃশ্যপট ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
সম্প্রতি বনানীর ইবিজা বিসত্রো রেস্টুরেন্ট, মিরপুরের সিরাজ চুইগোশ রেস্টুরেন্ট, সেগুনবাগিচার বাগিচা রেস্টুরেন্ট, গুলশানের বাফেট রেস্টুরেন্ট, শ্যামলীর সোয়াদিকা রেস্টুরেন্ট, মতিঝিল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় পথ খাবার হোটেল ও ভ্রাম্যমাণ খাদ্য স্থাপনা, এলিফ্যান্ট রোড, ধানমন্ডি-৮, রবীন্দ্র সরোবরসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি এলাকায় হোটেল-রেস্তোরাঁ ও স্ট্রিট ফুড, কারওয়ান বাজারে মাছ-গোশতের দোকান, কদমতলীর বোম্বে সুইটসের কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এমনকি পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিনে বিক্রয় নিষিদ্ধ রেডবুল এনার্জি ড্রিংক, রুটি মোড়কীকরণে লেভেলিং প্রবিধানমালা লঙ্ঘন, মেয়াদোত্তীর্ণ বাদাম, ডাল ঘুগনি, ময়দা, জাপানিজ একটা খাবার পাওয়া যায়, পচা পেঁপে ও আপেল পাওয়া যায়, ফ্রিজে ফেসিয়াল মাস্ক ও খাবার একত্রে রাখা, ডাস্টবিন খোলা অবস্থায় রাখাসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি ধরা পড়ে। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড দিয়েছিল নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০১৯ সালে প্রাণের মতো বড় কোম্পানির ৫২টি পণ্য বিএসটিআইয়ের মানে অকৃতকার্য হয়েছিল।
গবেষণা সংস্থা গ্লোবক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মারা যায় ৯১ হাজার ৩০০ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছে, তার প্রায় তিন গুণ মানুষ মারা গেছে ২০২০ সালে। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৮ হাজার ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা গেছে ১০ হাজার ৬২২ জন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের রোগ এবং মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে খাদ্য ও পানীয়তে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি। ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, খাদ্য জীবনের জন্য অপরিহার্য বিষয়। সেই খাবার যদি বিষাক্ত হয় তাহলে শরীরের ক্ষয়পূরণ হয় না, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের পরিপাকতন্ত্র, লিভার-কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। তিনি বলেন, প্রতিদিন দেশে ক্যানসারের রোগী বাড়ছে। কিডনি বিকল হওয়ার ঘটনা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। থাইরয়েডের সমস্যা, লিভারের অসুখ বাড়ছে।
ভেজাল খাবারে শুধু শরীরের ক্ষতিসাধন হয়, তা নয়। বরং মানসিক স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নাঈম আকতার আব্বাসী বলেন, ভেজাল খাবারের প্রভাবে শিশুদের মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। ব্রেনে কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের কারণে মেমরি লস, খিটখিটে মেজাজ, মনযোগ কমে যাওয়া, কোন সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত হতে না পারার মতো সমস্যা হয়ে থাকে। বয়স্কদের ক্ষেত্রেও স্মৃতিশক্তি কমে যায়, বিষণ্নতার লক্ষণগুলো চলে আসে, খাওয়ায় অরুচি, অনিদ্রা, ঘুম কম হওয়ার মতো লক্ষণগুলো দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচ্চাদের মতো বিরক্ত হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত রেগে যাওয়া, এসব প্রভাব পড়ে।
বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, আমরাতো বিএসটিআই থেকে মোবাইল কোর্ট করছি। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং ভোক্তা অধিকার তারাও এটা করছে। আমি ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে কথা বলবো। হয়তো আগামী সপ্তাহে আমাদের নতুন ডিজি চলে আসবেন। তাকে আমি পরামর্শ দিয়ে দেবো, যে এলাকায় মোবাইল কোর্ট করা হচ্ছে, কিছুদিন পর ঐ এলাকাটা যেন আবার চেক করে দেখে যাতে এলাকাটা ভালো থাকে; খারাপ হয়ে না যায়। তিনি বলেন, একটা এলাকায় একবার অভিযান পরিচালনা করে আসলো, পরে আর গেল না তখন ঐ এলাকাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমাদের মোবাইল কোর্ট বাস্তব অর্থে কোনো কাজে লাগছে না। ম্যাজিস্ট্রেটদের আমি পরামর্শ দেবো, অভিযান এলাকাটা পরে আবার যেন চেক করে দেখেন। তাতে কিছ কিছু এলাকা হয়তো ভালো হবে। এজন্য আমাদের লোকবল কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আরো বেশি ম্যাজিস্ট্রেট পেলে আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারবো।
ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, নিরাপদ খাদ্য এটাতো আমার ছোট একটা অংশ মাত্র। আর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাজই হলো এটা। আমাকে পেট্রোল পাম্প, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, চাল, ডিমসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়। আমাদের তো একটা বিষয় নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। তেলের দাম, চিনির দাম, কসমেটিক্সসহ সব কিছু নিয়েই কাজ করতে হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন