বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন দেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে বিএনপি। এর পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকা- ও জনসংযোগে সহায়তা করার জন্য স্থানীয় নেতাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সমমনা ও অন্যান্য দলের সঙ্গে যোগাযোগ ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করছে দলটি।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান বাতিল ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি বিএনপির সায় পায়নি। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএনপি বলেছে, এ উদ্যোগের পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। এতে করে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে এবং এর সুযোগ নিতে পারে ক্ষমতাচ্যুত গোষ্ঠী। পাশাপাশি বিএনপি এসব ইস্যুতে না গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করেছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র বলেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো নির্ধারণ হয়নি। তবে নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের আরও সক্রিয় রাখতে আগামী মাসে দেশের সব মহানগরসহ বিভাগীয় জেলাগুলোতে ১০ দিনের কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাঠপর্যায়ে কাজ করতে না পারা বিএনপি ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে তৃণমূলে সাংগঠনিক কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে দলের কর্মকা- পরিচালনা করছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাংগঠনিকভাবে মাঠে থাকার নির্দেশনা রয়েছে। একইভাবে নির্বাচন ঘিরে ঐক্য জোরালো করতে উদ্যোগ নিয়েছে।
সম্প্রতি বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দলের ছয় নেতার আসনের থানা-উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির নেতাকর্মীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে। চিঠিতে তাদের সাংগঠনিক কাজে সহায়তা করতে বলা হয়েছে।
এ চিঠি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে ওইসব এলাকার নেতাকর্মীর মধ্যে। এ চিঠি কি নির্বাচনী সমঝোতা, নাকি নির্বাচন সামনে রেখে ঐক্য ধরে রাখার কৌশল সেটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
চিঠি পাওয়া নেতাদের মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের আসন লক্ষ্মীপুর-৪, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার বগুড়া-২, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকির ঢাকা-১২, গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) সভাপতি নুরুল হক নুর পটুয়াখালী-৩ ও রাশেদ খানের ঝিনাইদহ-২ এবং জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার আসন কিশোরগঞ্জ-৫।
এসব চিঠির বাইরে ১২-দলীয় জোট নেতা ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমকে মৌখিকভাবে লক্ষ্মীপুর-১ আসনে কাজ করতে বলা হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক কয়েকটি দলের নেতারা জানান, এসব চিঠির মাধ্যমে তারা যাতে প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কাজ করতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগের মতো কর্মসূচি, কর্মিসভা, সাংগঠনিক সভা যাতে নির্বিঘ্নে করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে সবুজ সংকেত দিয়ে চিঠি দিয়েছে এমনটা আমার জানা নেই। নাগরিক ঐক্যের নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে আন্দোলনে ছিল, এখনো মাঠে রয়েছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ যেহেতু ঠিক নেই, তাই এ নিয়ে মন্তব্য করাটা ঠিক হবে না।’
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘আমরা চিঠির বিষয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, নানা কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জোটের নেতারা কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সেখানে যাতে নির্বিঘেœ কর্মকা- পরিচালনা করা যায়, সেজন্য জোটের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বিএনপির সহায়তা চেয়েছেন। মৌখিকভাবে বলা হলে, বিষয়টি কার্যকর হয় না। তাই স্থানীয় বিএনপির নেতাদের চিঠি দিয়ে সহায়তার কথা বলা হয়েছে।’ বিষয়টি এর বেশি কিছু নয় বলে জানান ইরান।
বিএনপি সূত্র বলছে, কোনো নেতাকেই প্রার্থী হিসেবে সবুজ সংকেত এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। প্রায় প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থীকে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছে দলটি।
সূত্রগুলো জানায়, আপতত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ‘দূরত্ব’ ঘোচানোর চিন্তা বাদ দিয়ে ধারাবাহিকভাবে অন্যসব দল নিয়ে এগোতে চাচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) অন্যান্য দলের সঙ্গেও যোগাযোগ চলছে। রাজনীতির মাঠে ঐক্য জোরালো করতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ৪২ দল এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী ৬৪ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক ও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর ও সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনের জন্য সবসময় প্রস্তুত। এজন্য আলাদা প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে জোটের নেতাদের নির্র্বাচনের প্রস্তুতির জন্য আলাদা চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, নির্বাচনের ঢামাঢোল শুরু হলে অনেক রাজনৈতিক হিসাব সামনে চলে আসবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য, সম্ভাব্য দুই প্রার্থী, জোটের দুজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ইতিমধ্যে জনসংযোগ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। তিন কৌশলে মাঠে কাজ করছে বিএনপি। একটি হচ্ছে কিছু আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সরাসরি কাজ করতে বলেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দ্বিতীয়ত, কিছু আসনে একাধিক প্রার্থীকে মাঠে রাখতে চাইছে দলটি। ফলে কয়েকজনকে মাঠে কাজ করতে বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, সম্ভাব্য জোট প্রার্থীদের সক্রিয় রাখা হচ্ছে।
নোয়াখালীর একটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দুই দফা স্কাইপে আলোচনা হয়েছে। তাকে নির্বাচনী এলাকায় সক্রিয় থেকে মাঠ গোছাতে বলা হয়েছে। এলাকায় অহেতুক সমস্যা এড়াতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের মাধ্যমে জেলার শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তাকে সহযোগিতার কথা বলেছেন।’
এ নেতা জানান, দলের কয়েকজন সিনিয়র ও সাবেক ছাত্রনেতা মিলিয়ে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জন নেতার প্রতি এমন নির্দেশনা রয়েছে।
কিছু আসনে একাধিক প্রার্থীকে মাঠে রাখার ক্ষেত্রে দলের হাইকমান্ডের অভিমত হলো যোগ্যতা, মেধা ও জনপ্রিয়তার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া। আগামী নির্বাচনের আগপর্যন্ত যারা টিকে যাবেন তাদের মধ্য থেকে প্রার্থী বেছে নেওয়া হবে। আর জোট প্রার্থীদের চিঠি দেওয়া হয়েছে কারণ হলো আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ সময়ে জোটের ঐক্য ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে বিএনপি। ফলে নির্বাচনের আগপর্যন্ত অনেকেই এমন চিঠি পেতে পারেন। পরে সার্বিক রাজনৈতিক স্বার্থে দরকষাকষির একপর্যায়ে কিছু আসনে জোটের নেতাদের ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে দলের শীর্ষ মহলে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সবসময়ই প্রস্তুতি রয়েছে। একটা দীর্ঘ আন্দোলনের পর সামনে নির্বাচন আসছে। দিনক্ষণ ঠিক হলে প্রার্থী বাছাই ও জোটের প্রার্থীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। একটা বিষয় পরিষ্কার, সেটি হচ্ছে দল ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়ন করতে যা প্রয়োজন সেভাবেই বিএনপি এগোবে।’
রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারে ২০২২ সালের ডিসেম্বর বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার করার কথা বলা হয়েছে। সেই সরকার সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করবে।
জানা গেছে, এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’কেন্দ্রিক কর্মসূচির পর অবস্থা বুঝে সাংগঠনিক কর্মসূচির গতি বাড়ানো-কমানো হবে। দলীয় প্রার্থীদের এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বিবেচনায় রাখতে চায় দলটি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা আরও বলছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা চিন্তা করে ছাত্রদল থেকে আসা নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে সাবেক সংসদ সদস্যরা (এমপি), যারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিলেন, তারাও প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন