মন্ত্রবলে কুমির হয়ে যায় নদের চান্দ
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রবাহমান বিভিন্ন নদীকে ঘিরে অনেক কিংবদন্তি রয়েছে। এমনই একটি কিংবদন্তি রয়েছে মাগুরার মধুমতি নদীকে নিয়ে। জেলার মহম্মদপুর উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মধুমতি নদীর তীরবর্তী গ্রাম পাচুড়িয়া। ছোট্ট এই গ্রামের জেলেপাড়া এবং নদের চান্দ কুমিরের গল্প এখনো শোনা যায় লোকমুখে। জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে যে গল্প এখনো শোনা যায় গ্রাম থেকে গ্রামে। এখনো অনেক মা সেই গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে থাকেন শিশুদের।
মায়েরা এখনো গল্প করেন, নদের চান্দ নাকি ছিলেন এক জেলেপুত্র। মন্ত্রবলে তিনি একদিন কুমির হয়ে মধুমতি নদীতে নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু আর ফিরে আসতে পারেননি মানুষ হয়ে। আর তার শোকে সুন্দরী স্ত্রী সরলা সেই নদীর পানিতেই ডুবে মারা যান। নদের চান্দের মা প্রাণপ্রিয় সন্তানের জন্য এখনো প্রতিদিনই নদীর পাড়ে অপেক্ষার প্রহর গোনেন। হয়তো একদিন সে ঠিকই ফিরে আসবে তার ঘরে এ আশায়।
লোকমুখে শোনা নদের চান্দ কুমিরের গল্প এমনই। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পাচুড়িয়া গ্রামের জেলে পাড়ায় বাস করেন গদাধর নামে এক জেলে। সংসারে তার বউ আর তিনি। নদের চান্দের তখনো জন্ম হয়নি। বর্ষাকাল। মধুমতি নদীতে অনেক মাছ পড়ছে। নদীর দিকে তাকিয়ে গদাধর জেলের চোখ ঝলমল করে উঠে। জাল আর নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে চান তিনি। জেলে পাড়ার অন্যরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাছ ধরতে যাবেন। কিন্তু গদাধরের পথ আগলে বসেন তার স্ত্রী। ক’দিন পরই তার সন্তানের জন্ম হবে। এই সময় স্বামী গদাধর পাশে থাকলে মনে সাহস পাবেন। কিন্তু বউয়ের মিনতি বাধা উপেক্ষা করে গদাধর মধুমতিতে ভাসিয়ে দেন তার নৌকা।
এদিকে আষাঢ় গেল, শ্রাবণ গেল। গদাধরের বউয়ের কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে সন্তান। শখ করে তার নাম রেখেছেন নদের চান্দ। বর্ষা শেষে পাচুড়িয়ার জেলেরা অনেক মাছ আর টাকা-কড়ি নিয়ে ফিরলেন গ্রামে। কিন্তু পুরো বর্ষাকাল পেরিয়ে গেলেও ফিরলেন না গদাধর।
গ্রামে ফেরা জেলেদের কাছে নদের চান্দের মা জানতে পারলেন নৌকাডুবির খবর। মধুমতি নদীর স্রোতে হারিয়ে গেছেন গদাধর।
স্বামীর শোকে নদের চান্দের মা ছেলেকে কোলে নিয়ে মধুমতি পাড়ে সারাদিন বসে থাকেন; যদি কোনোদিন ফিরে আসেন নদের বাবা। এদিকে ছোট্ট শিশু নদের চান্দ পানির উত্তাল তরঙ্গ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু মা তাকে কেবলই বুকে আঁকড়ে রাখেন।
এভাবে চলে গেল অনেকগুলো বছর। দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল নদের চান্দ। সারাপাড়া ঘুরে বেড়ান সে। নদের চান্দও মাছ ধরতে যেতে চায় মধুমতিতে। কিন্তু নদীতে নামা তার একেবারেই মানা। মা চান- নদের চান্দ ক্ষেত-খামারে কাজ করুক, কিন্তু নদীতে নয়। মনে ভয়- যদি তার বাবার মতো সেও হারিয়ে যায়।
দেখতে দেখতে নদের চান্দ যুবক হয়ে উঠলেন। মা ভাবেন- জেলে পাড়ার সুন্দরী সরলার সঙ্গে বিয়ে দিলেই ছেলেকে বাড়িতে আটকে রাখা যাবে। কথা হলো ঠিকঠাক। কিন্তু বিয়ের কথায় উদাস হয়ে পড়েন নদের চান্দ। রাঙা বউয়ের কথা শুনেও তার মনে কোনো সাড়া জাগে না। তার মনে ভাবনা- মাকে না বলেই পালিয়ে যেতে হবে বাড়ি থেকে।
একদিন তাই হলো! রাত গভীর। গভীর ঘুমে নদের মা। চারিদিকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। এমন অবস্থায় নদের চান্দ বেরিয়ে পড়েন অজানার পথে। এদিকে মায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা সব মরীচিকা হয়ে দেখা দিলো।
কিন্তু বছর দশেক পর নদের চান্দ ঠিক ফিরে এলেন আবার মধুমতি নদী তীরে সেই জেলে পাড়াতেই। এদিকে নদের মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। মাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন নদে। তাদের ঘর আবার চাঁদের আলোর মতো ভরে উঠলো। আঁধার ঘরে আবার আলোর শিখায় আলোকময় হলো। মা মনে মনে ভাবলেন- আর দেরি নয়, এবার নদেকে বিয়ে দিতেই হবে। নদের চান্দও রাজি হয়ে গেলেন।
জেলে পাড়ার মেয়ে সরলা। নদের চান্দ ছোটকাল থেকেই তাকে চেনেন। পাড়ার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে সরলা। বিয়ে হয়ে গেল তাদের দুজনের। রাঙা বউ পেয়ে নদের চান্দের মন আনন্দে নেচে উঠলো। সারাদিনই সে বউয়ের আঁচল ধরে চলে। মাও এমন অবস্থা দেখে খুব খুশি। ভালোই কাটছে তাদের।
একদিন রাতের বেলা। সরলা আহ্লাদি কণ্ঠে জানতে চাইলেন- তিনি তাকে বিয়ে না করে পালিয়ে গিয়েছিলেন কেন। কিন্তু নদের চান্দ কোনোভাবেই বলবেন না। ওদিকে সরলাও নাছোড়বান্দা, তাকে বলতেই হবে; নাহলে ঠোট ফুলিয়ে থাকেন। অগত্যা নরম হলেন নদে। তবে শপথ করতে হলো সরলাকে, তিনি যেন কাউকেই বিষয়টা না বলেন।
নদে জানালেন দশ বছর আগে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা। তিনি বললেন, বিয়ে না করে সরলার থেকে অনেক দূরে সেই কামরুপ কামাক্ষাতে গিয়ে এতোদিন সাধনা করেছেন। সেখানকার মহিলা তান্ত্রিক তাকে অনেক যাদুমন্ত্র শিখিয়েছেন। যেসব যাদুমন্ত্রবলে মুহূর্তেই যে কাউকেই মানুষ থেকে অন্য প্রাণি বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু কাউকেই বলা যাবে না। তান্ত্রিক মন্ত্রকের মানা।
নদের কাছে এমন গল্প শুনে সরলা খুশি হলেও কাউকে বলতে না পারার কষ্টে পেট ফুলছিল। তিন দিন চলে গেল। সরলা নদের সঙ্গে কথা বলেন না। সরলার প্রতি তার ভীষণ রাগ হয়। একদিন দুপুর বেলা মান ভাঙ্গাতে ঘরের মধ্যে ডেকে যাদু দেখানোর আশ্বাস দেন নদে। কিন্তু কেউ যেন না জানে, মাও যেন জানে না কোনোভাবে। রাতে যাদু দেখাবে বললে আনন্দে আটখান হয়ে যান সরলা।
নদের চান্দের আলাদা ঘর। এক সময় রাত গভীর হলো। নদের চান্দ একটি মাটির পেয়ালায় পানি নিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলেন। তারপর সরলাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমি মন্ত্রপড়ে কুমির হয়ে যাব। কিন্তু পেয়ালায় রাখা মন্ত্রপড়া পানি গায়ে ছিটিয়ে দিলে আবার মানুষ হয়ে যেতে পারব।
এই আমি কুমির হচ্ছি বলে নদের চান্দ বিছানায় কাঁথার নিচে শুয়ে পড়লেন। এদিকে কৌতূহলী সরলা দাঁড়িয়ে আছেন পাশেই, চেয়ে আছেন তার দিকে। কোন সময় কুমির হবে, কেমন করে হবে। হঠাৎ কাঁথার নিচ থেকে বেরিয়ে পড়লো তার দেহ। নদের চান্দ কুমির হয়ে গেলেন।
ঘরের মধ্যে কুমির দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলেন সরলা। তিনি দেখেন একটা তাজা কুমির তারই বিছানায়। সোজা হয়ে লেজ নাড়ছে। সরলার আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়ে গেছে। ভুলে গেছেন সব কথা। ভুলে গেলেন তার স্বামী নদের চান্দকে। ভুলে গেলেন পেয়ালায় রাখা পানি কুমিরের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়ার কথা। বরং ভয়ে তিনি চিৎকার দিয়ে পালিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
কিন্তু কী হলো! দৌড়ে পালাতে গিয়ে পায়ের ধাক্কায় পড়ে গেল পেয়ালায় রাখা মন্ত্রপুত পানি। ভয়ের পর ভয়ে পেয়ে বসল সরলাকে। তিনি কাউকে বলতে পারছেন না, তার প্রাণপ্রিয় স্বামী মন্ত্রবলে কুমির হয়ে গেছেন। কিন্তু তার আবার মানুষরূপে ফিরিয়ে আনার উপায়ও নেই তার কাছে। আকাশ বাতাস কাপিয়ে কাঁদতে থাকেন সরলা। সারাবাড়িতেই কান্নার রোল পড়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
কুমিরের বেশে নদের চাঁদ মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকেন। অন্যদিকে সরলার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু ফেলতে থাকেন নদের চান্দ। কিন্তু কী হবে! সরলাও নিরুপায়। এভাবে বাড়ির উঠোনে পড়ে থেকে তিন দিন পর নদের চান্দ কুমির হয়েই মধুমতির পানিতে নেমে পড়লেন।
পরে এক মাস পনেরো দিন পর কামরুপ কামাক্ষা থেকে নদের চাঁদের সেই মহিলা মন্ত্রককে খবর দিয়ে আনা হলো। গ্রামের সবাইকে নিয়ে তিনি গেলেন মধুমতি নদীর পাড়ে সেই ঘাটে, যে ঘাট নিয়ে নদের চান্দ নেমে গেছেন মধুমতি নদীতে। সেখানে দাঁড়িয়ে মহিলা মন্ত্রক ডাক দিলেন, নদে! নদে!! ও নদে!!!
কিন্তু একী হলো! নদের চান্দ কুমির মুখে একটি ইলিশ মাছ নিয়ে ভেসে উঠলেন। তখন তার মহিলা মন্ত্রক জানালেন, নদের চান্দকে আর মানুষ হিসেবে ফিরে পাওয়া যাবে না। কারণ তিনি মাছ ভক্ষণ করে ফেলেছেন। কোনোভাবেই আর সম্ভব নয় জানিয়ে নৌকাযোগে কামরুপ কামাক্ষায় ফিরে গেলেন তিনি।
এদিকে নদের চান্দের নতুন বউ সরলা সারাদিন নদীর পারে বসে থাকেন। স্বামী শোকে পাগল প্রায়। ঘাটে বসে থেকে থেকে একদিন সরলা মধুমতি নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করলেন। আর কুমির নদের চান্দ স্ত্রীর মরদেহ পানির মধ্যে থেকে তুলে এনে উপরে ভেসে উঠলেন।
খবর পেয়ে নদের চান্দের মা ঘাটে এসে দাঁড়ালেন। নদে নদে বলে আর্তনাদ করে ডাকতে লাগলেন তিনি। স্ত্রী সরলার লাশ মুখে করে মাঝ নদী থেকে নদে ছুটে এলেন মায়ের কাছে। তারপর তার পায়ের কাছে সরলার মৃতদেহ রেখে নদীতেই ফিরে গিয়ে আবার ডুব দিলেন নদে। এরপর আর কখনো নদের চান্দ কুমির ভেসে উঠেননি ওপরে। লোকে বলে, সরলার আত্মহত্যার বেদনায় কুমির নদের চান্দও একদিন আত্মহত্যা করেছিলেন।
মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার মানুষের মুখে মুখে এ কিংবদন্তি আজও শোনা যায়। মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে সামান্য দূরে পূর্ব দিকে মধুমতীর তীরে নদের চাঁদ ঘাট নামে একটি ঘাটও রয়েছে। এককালে এই ঘাটে স্টিমার ভিড়তো।
কুমির নদের চাঁদকে নিয়ে গ্রাম্য কবির গান শোনা যায়। একজন কবির ধূয়া গানে আছে-
‘শুনবে পাঁচুড়িয়া গার এক খবর নদের চাঁদ হইছে কুমির ও তার মায় হইছে পাগল/কামরুপ যাইয়ে নদের চান মন্ত্রর শিক্ষা নেয় ও তার মায়ের কাছে নাহি কয়/সরলা বলছি বলছি পতি ধরি তোমার পায় তুমি যদি হও কুমির আমি নয়নে দেখতাম তাই/আমার মাথার কিরা লাগে যদি তোমায় ছেড়ে যাই।
নদের চান জল পড়ে কুমির হইলো সরলা দেখে অমনি দৌড় দিলো/দৌড়ে যেতে কালে জল ঢেলে পাইলো/ নদের চাঁদ মাথায় হাত দিয়ে কানতে লাগলো/বিধি বুঝি এবার বাম হইলো/এমন সময় মা জননী কোন খানে রইলো।
শুনবে বেয়াকুব নদে কেন শুনলি কথা তোর মা যানে/
কোটে মাথা নদের চান বাবা গেলি কোথা অধম হাকিম চান কয়/
নদের চাঁদের কপালে এই ছিল/এমন কুমির তোরে কিবা শিখা।
মাগুরায় প্রচলিত এ কিংবদন্তি সম্পর্কে ইতিহাস গবেষক সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি বলেন, নদের চান্দ কুমিরের গল্পের শুরু কবে থেকে তার সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। তবে মধুমতি নদীর তীরে ‘নদের চান্দ ঘাট’ নামে একটি ঘাট পরিচিত অনেক আগে থেকেই।
তিনি জানান, এই কিংবদন্তি বা নদের চান্দের গল্প রয়েছে লোকের মুখে মুখে। এই কিংবদন্তি নিয়ে ১৯৯৮ সালে খুলনা বেতারে একটি নাটকও প্রচার হয়েছে। পরে ২০০২ সালে এটি ঢাকা বেতার থেকেও প্রচার করা হয়।
মাগুরা অঞ্চলের এই কিংবদন্তি এখনো মানুষের মুখে মুখে। এই ঘটনার সত্যতা পাওয়া না গেলেও মহম্মদপুরে পাচুড়িয়া গ্রামে এখনো রয়েছে সেই জেলেপাড়া। এখনো আছে মধুমতি নদীর তীরে নদের চান্দের ঘাট।