Image description
এস আলমের অনিয়মের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অসহায়ঃ ইসলামী ধারার ৮ ব্যাংক থেকে ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা
দেশের ব্যাংকিং খাত শক্তভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছিল। এ কারণে ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার পর বিশ্বের অনেক দেশের ব্যাংকিং খাত সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের সমস্যাকবলিত ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। ওই সময় দেশের একটি ব্যাংকও বন্ধ হয়নি, বরং অর্থনীতিকে সুসংহত করতে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ব্যাংকিং খাত দুর্বল হতে থাকে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় একসাথে ডজন খানেকের বেশি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকের মতো বড় কয়েকটি ঋণকেলেঙ্কারিতে তখন দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর পরেও কিছু ব্যাংকের শক্তিশালী ভিত্তি থাকায় সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ দেশের ব্যাংকিং খাত এলোমেলো হয়ে পড়ে ২০১৭ সালে বহুল আলোচিত সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলমের আবির্ভাবে। দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে একে একে দেশের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো দখল করতে থাকে। কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পানির মতো ব্যাংক থেকে নামে বেনামে টাকা বের করতে থাকে এই গ্রুপটি। এসব ঋণ পরিশোধ করাতো দূরের কথা বছর শেষে ন্যূনতম মুনাফাও পরিশোধ করা হয়নি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের সাথে ভাগবাটোয়ারার সম্পর্ক গড়ে উঠায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অসহায় হয়ে পড়ে এস আলমের অনিয়মের কাছে। তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থা নেয়ার সাহস ছিল না। বরং নীতিসহায়তা দিয়ে অনেক সময় তার লুটপাটের সহায়তা করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এভাবে ইসলামী ধারার ৮টি ব্যাংক থেকে দেড় লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণ বের করে নেয়া হয়। ইসলামী ধারার বাইরে অন্য ব্যাংক থেকেও আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়। ফলে একসময় শক্তভিত্তির ওপর গড়ে উঠা এসব ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। এস আলমের মালিকানায় থাকা বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখন গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না। এস আলমের নামটি যেন দেশের অর্থনীতিতে ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে দেখা দিয়েছে। অনেকটা আক্ষেপ করে গতকাল নয়া দিগন্তের কাছে কথাগুলো বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এস আলম যেভাবে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে টাকা লুটপাট করেছে তা সঠিকভাবে তদন্ত করা হলে ব্যাংক কেলেঙ্কারির দিক থেকে বিশ্বের এক নম্বরে অবস্থান করবে বাংলাদেশ। তিনি মনে করেন, দ্রুত এস আলমের কাছ থেকে তার মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলো উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু বেশির ভাগ টাকাই পাচার করা হয়েছে তাই এসব টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে থাকা তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ব্যাংক থেকে লুটপাট করা গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে তার এসব লুটপাটের সহযোগী ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, মিফতা উদ্দিন, এএমডি জে কিউ এম হাবিবুল্লাহ, ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীসহ যারাই জড়িত রয়েছেন তাদেরকেই আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ দিকে এক সময়ে অধরা আলোচিত এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৯১টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব হিসাব তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের আয়কর বিভাগের রাজধানীর কর অঞ্চল-১৫ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত চিঠি সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ২০০ এর প্রদত্ত ক্ষমতাবলে করদাতার নামে অথবা যৌথ নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সব ধরনের ব্যাংক হিসাব ও ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এস আলমের (সাইফুল আলম) স্ত্রী ফারজানা পারভীন, মা চেমন আরা বেগম এবং ভাই আবদুল্লাহ হাসানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের বাবা-মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে বা বোনের যৌথ নামে অথবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবের তথ্যও তলব করা হয়েছে। এর মানে, এস আলমসহ তার পুরো পরিবারের সদস্যদের যাবতীয় ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে এনবিআর। এ ছাড়া তাদের নামে থাকা ক্রেডিট কার্ডের তথ্যও চাওয়া হয়েছে। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর ও ডাক বিভাগের কাছে থাকা হিসাবের তথ্য চেয়েছে কর অঞ্চল-১৫। এ দিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ পর্যন্ত যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে দেখা যায়, শুধু ইসলামী ধারার ৮টি ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ নামে-বেনামে দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ইসলামী ব্যাংক ৫০ হাজার কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে স্যোসাল ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকেও কিছু ঋণ নেয়া হয়েছে। তবে নয়া দিগন্তের কাছে যেসব নথি রয়েছে তাতে এস আলমের ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব ঋণের বেশির ভাগই জামানত নেই। কিছু ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে, তবে তা ঋণের তুলনায় যৎসামান্য। যেমন, ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে, তার বিপরীতে ১০০ কোটি টাকার একটি পে-অর্ডার জামানত হিসেবে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এসব ঋণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণে পরিণত হয়েছে। কোম্পানিগুলো যদি দেউলিয়া হয়ে যায়, তাহলে ব্যাংক তাদের বিনিয়োগ আদায় করতে পারবে না। ব্যাংকের নগদ টাকার প্রবাহ কমে যাবে। সেক্ষেত্রে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যাংক মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য সহায়ক জামানতবিহীন বিনিয়োগসমূহ যে ঝুঁকি তৈরি করে তা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপককে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্যাংক যেসব ঋণ দেয় তা আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীরা যাতে ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। ব্যাংকগুলো যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য যাদের কষ্ট, শ্রম ও মেধা দিয়ে এসব ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের কাছে এসব ব্যাংকের মালিকানা ফেরত দিতে হবে। আর তা হলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিতে গভর্নরকে চিঠি বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের হাত থেকে ইসলামী ব্যাংককে রক্ষা করতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছেন ব্যাংকের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বরাবর চিঠি দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি ব্যাংকের সাবেক পরিচালকদের একটি অংশ ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার জন্যও দাবি জানিয়েছে। অন্য দিকে ভুয়া ও জামানতবিহীন লোনের সাথে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে আন্দোলন করছেন কর্মরত কর্মকর্তারা। গভর্নরকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে আপনি এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। ব্যাংকটির বোর্ড অব ডিরেক্টরস ও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে তহবিল লুটপাট চলেছে। কিছু চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তব অবস্থা এর চেয়েও ভয়াবহ। দীর্ঘ দিন এই লুটপাটের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং ব্যাংকটির প্রতি গণমানুষের আস্থার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার, সব স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ রক্ষা, তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন ৪৭ ধারা মোতাবেক ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি সহানুভূতিশীল বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অথবা প্রয়োজনে সাবেক পরিচালকদের সমন্বয়ে বোর্ড পুনর্গঠনের জন্য ব্যবস্থা দিতে আপনার আশু পদক্ষেপ কামনা করছি।