সিফাত মেহজাবিন
বাংলাদেশের প্রায় ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ডিস ক্যাবল লাইন, চলছে স্যাটেলাইট সংস্কৃতির রাজত্ব। সে ব্যাপারে আর নতুন করে বলার কিছু নেই। অবসর পেলে অনেকেই সময় কাটানোর জন্য টিভির রিমোট কন্ট্রোল হাতে নেয়। অতঃপর ভারতীয় চ্যানেল চালু ও বাকিটা সময় ভারতীয় চ্যানেলেই ঘুরে ঘুরে সময় কেটে যায়। বর্তমানে ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা (কলকাতা) সিরিয়ালের মূল দর্শক আমাদের দেশের নারী এবং তাদের সন্তানরা। এমনকি আজকাল অনেক পুরুষও এসব সিরিয়াল দেখছেন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কোনো কিছুইতেই আর মন বসে না। দুনিয়ার সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে একটাই কাজ, ‘সিরিয়াল দেখা’। প্রতিদিনই নতুন নতুন পর্ব আর ঘটনার চমকের কারণে নেশা হয়ে গিয়েছে সিরিয়ালের। ঢাকার পাশাপাশি মফস্বল শহরগুলো এবং গ্রামেও ভয়াবহ আকারে এই আসক্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যস্তজীবন এবং যৌথ পরিবার ভেঙে পরার ফলে টিভি যেন আমাদের আরও কাছের ও অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হয়ে উঠেছে। অভিভাবকরা শিশুদের যথেষ্ট সময় না দিলে তারা একাকিত্ব বোধ করে এবং পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ না থাকার ফলে সেই একাকীত্ব বোধ দূর করতে অগত্যা টিভিকে বেছে নেয়। আবার বাবা-মা উভয়ে যদি কর্মজীবী হন, তখন স্বভাবতই শিশু গৃহপরিচালকের কাছে বড় হয়, এবং অনেক সময় গৃহপরিচালকেরা শিশুকে ব্যস্ত রাখার জন্য টিভি দেখতে উৎসাহিত করে। ছোট শিশুরা সহজেই বিজ্ঞাপন ও কার্টুনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রায় সময় দেখা যায় টিভির রিমোটটি তাদের হাতেই থাকে এবং টিভির উপর তাদের একারই রাজত্ব চলে। কিন্তু তারা যে শুধু কার্টুন চ্যানেলেই সীমাবদ্ধ থাকছে তা কিন্তু না, বরং সুযোগ পেলেই তারা কখনো মায়েদের সাথে অথবা একা বিভিন্ন হিন্দি গানের চ্যানেল, বাংলা (কলকাতা) ও হিন্দি সিরিয়াল দেখে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বেশীর ভাগ শিশু এখন খেলাধুলা, বই পড়া, ছবি আঁকা, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা, সৃজনশীল কাজ ইত্যাদির সুযোগ কম পায় এবং টিভি দেখায় বেশি সময় ব্যয় করে। সচেতন বাবা-মায়েরা কমবেশি সবাই জানেন যে, শিশুদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক-মানসিক উন্নয়নে টিভি একটি প্রধান অন্তরায়।
ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত অনুষ্ঠানসমূহ দেখে আমাদের দেশের দর্শকদের মাঝে ইতিমধ্যে নানারকমের নৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এই লেখায় একটি ভিন্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রায় উপেক্ষিত একটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মুল বিষয়টি উপস্থাপনের আগে আসুন আমরা দেখে নেই বাংলাদেশে শিশুরা ভারতীয় জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলগুলো থেকে কি দেখছে এবং কি শিখছে।
কি দেখছে?
বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ডোরেমন (জাপানী), নিনজা হাতুড়ি (জাপানী), ওগি এন্ড কক্রজেস [Oggy and the cockroaches] (ফ্রেঞ্চ) মিস্টার বিন (ইংলিশ), পাকদাম পাকদাই (ইংলিশ), টম এন্ড জেরি (ইংলিশ), জিং এন্ড সার্ক (ইংলিশ), ডোরা (ইংলিশ), মোটু-পাতলু (হিন্দি), ক্যামন আছে (হিন্দি)। [কার্টুন নেটওয়ার্ক ও নিক টিভিতে প্রচারিত বিদেশী সব কার্টুনই হিন্দি ভাষায় ডাবিং করা। সম্প্রতি ডোরেমন এবং টম এন্ড জেরির বাংলা ডাবিং পাওয়া যাচ্ছে] এছাড়াও এখন ডিজনি-পিক্সার নির্মিত এনিমেটেড মুভিগুলো বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আকর্ষণীয় গান, মজার সংলাপ এবং হাই ডেফিনেশন এনিমেশনের কারণে শিশুসহ বড়দেরও মন জয় করে নিয়েছে। প্রায় ৯০ শতাংশ ডিজনি এনিমেটেড মুভিগুলোর প্রধান উপজীব্য বিষয়, প্রেম-ভালোবাসার গল্প। শিশুদের প্রিয় অনুষ্ঠানের তালিকায় আরও আছেঃ
ছোটা ভীম (হিন্দি ও ইংলিশ ) --- সম্পূর্ণ হিন্দু সেটিং- এ উপস্থাপিত একটি এনিমেশন, যার হিরো হচ্ছে ভীম নামের একটি ছোট্ট ছেলে। প্রারম্ভিক সঙ্গীতে বলা হয়, “না হারা হ্যায়, না হারে গা, দুনিয়া মে বাচ্চ কা এক হি হিরো, ছোটা ভীম”। যে কোন রকমের বিপদ-আপদে সে এসে সাহায্য করে এবং সকলকে বিপদমুক্ত করে। অনেক সময় বিপদমুক্ত হবার পর লোকজন তাকে নিয়ে শ্লোগানও দেয়, “Almighty Vim”! এখানে উল্লেখ করা দরকার, ভীম মহাভারতের একটি চরিত্র। পঞ্চ পাণ্ডব ভাইদের মধ্যে ভীম দ্বিতীয়। বিশাল দেহ ও প্রবল শক্তির জন্য ভীম বিখ্যাত। এখানে সেকুলারিজমের মন্ত্র খুব কৌশলে বাচ্চাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। যেমনঃ ক্রিসমাসের আগের একটা এপিসোড আছে ‘ভীম আর স্যানটাক্লজ’। সেখানে সব বাচ্চারাই মনে মনে ঠিক করে রাখে ক্রিসমাসের সময় স্যানটাক্লজ এর কাছে কি উপহার চাইবে! কারণ, স্যানটা মানুষের মনের আশা পুরন করতে পারে। ‘ইসলামিক’ টাচেরও ব্যবস্থা আছে, ‘ছোটা ভীম এবং এরাবিয়ান নাইট’। ভাবছেন নিশ্চয়ই ‘ইসলামিক কালচারের’ পজিটিভ কিছু দেখাবে। কিন্তু, সেই আশায় বালি। এই এপিসোডের ভিলেন এরাবিয়ান ড্রেস পড়া দাড়িওয়ালা মুসলিম, যে হিন্দু রাজকুমারীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চায়, এবং অবশেষে ভীমের হাতে নাজেহাল হয়ে পালায়।
লিটেল কৃষ্ণা এবং বাল কৃষ্ণা (হিন্দি ও ইংলিশ) --- হিন্দু ধর্মের আরাধ্য অবতার কৃষ্ণকে নিয়ে তৈরি এই এনিমেশন দুটি শিশুদের মধ্যে ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটা জী সিনেমায় দেখানো হয়। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতাতে কৃষ্ণের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। কৃষ্ণকে দেখানো হয়েছে, একটি ছোট ছেলে যার গায়ের রং ঘন নীল, খালি গায়ে সাধারণত হলুদ রঙের ধুতি পরা এবং মাথার মুকুটে একটি ময়ূরপুচ্ছ শোভা পায়। এখানে তাকে কখনো সম্বোধন করা হয়, “লর্ড কৃষ্ণা” আবার কখনো “Krisna, Lord of the universe”।
গড গনেশা (হিন্দি ও ইংলিশ) --- পৌরাণিক হিন্দুধর্মের জনপ্রিয়তম ও সর্বাধিক পূজিত দেবতাদের অন্যতম হচ্ছে গণেশ। হিন্দুদের সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই তার পূজা প্রচলিত। জৈন, বৌদ্ধধর্ম এমনকি ভারতের বাইরেও গণেশ আরাধনার ব্যাপক প্রচলন আছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের দিন গণেশ পূজা প্রচলিত। এছাড়াও দুর্গোৎসবে সপরিবার দেবী দুর্গার সঙ্গে গণেশও পূজিত হয়। শিশুদের জন্য তৈরি এই এনিমেশনটি গণেশকেই নিয়ে।
শ্রী রাম এবং রামায়ণ (হিন্দি ও ইংলিশ) --- বাল্মীকি রচিত রামায়ণ হিন্দুশাস্ত্রের একটি গ্রন্থ, যার আক্ষরিক অর্থ ‘রামের যাত্রা’। হিন্দু অবতার রামের জীবন-কাহিনীসহ প্রাচীন ভারতের ধর্মচেতনা এই এনিমেশন দুটিতে দেখানো হয়।
জয় হনুমান (হিন্দি ও ইংলিশ) ---সিরিজ আকারে দেখানো হয় স্টার গোল্ডে। হনুমান কৃষ্ণের পূজা করে, আবার রামের স্ত্রী সীতাকে রাবনের কাছ থেকে উদ্ধার করতে সাহায্য করে। এখানে হিন্দুদের দেবতা হনুমানের মজার মজার কাণ্ডকারখানা দেখানো হয়। সেই সাথে হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশুদেরকে।
মহাভারত (হিন্দি ও ইংলিশ) --- ব্যাসদেব রচিত মহাভারত হিন্দুশাস্ত্রের একটি অন্যতম মহাকাব্য (অপরটি রামায়ণ)। নানারকম চমক লাগানো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধসহ হিন্দু পুরাণ-এর ঘটনা সিরিজ আকারে স্টার জলসাতে দেখানো হয়। যা ইদানিং বাংলাদেশের শিশুদের খুবই আকৃষ্ট করছে এবং এই বিষয়ে তারা মোটামুটি এক্সপার্ট। সিরিয়াল ছাড়াও মহাভারতের কার্টুন এবং অ্যানিমেটেড মুভি বের হয়েছে।
ঠাকুরমার ঝুলি (বাংলা) --- DawsenTv তে এটি প্রচারিত হয়। গোটা ঠাকুরমার ঝুলিতে উল্লেখ করার মত কোন মুসলমান চরিত্র নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের উদযাপিত কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোন উল্লেখই এখানে নেই। যা আছে তার ভেতর উল্লেখযোগ্য হলঃ দরিদ্র ব্রাহ্মণের সততার গল্প, কিছু পুত্র সন্তানকামী রাজার গল্প, সাধু সন্ন্যাসীর পাঁচন খেয়ে ছোটরানীর গর্ভবতী হবার গল্প, সৎমা ও সতীনের কুটনামীর গল্প। সনাতন হিন্দু সমাজে প্রচলিত যত রকমের কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাস রয়েছে, ঠাকুরমার ঝুলিতে তার প্রত্যেকটি দিনের পর দিন বেশ পজিটিভভাবে শিশুদের সামনে দেখিয়ে যাচ্ছে।
চাঁদের বুড়ি ও ম্যাজিক ম্যান (বাংলা) --- জি বাংলা ও জি টিভিতে প্রচারিত এই কার্টুনটি শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এটি ঠাকুরমার ঝুলি এবং সেকুলার চিন্তাধারার একটি পাঁচমিশালী প্রচারণা।
বাটুল দি গ্রেট (বাংলা) --- আরেকটি জি বাংলা ও জি টিভি পরিবেশনা। বাংলায় নারায়ণ দেবনাথের লেখা জনপ্রিয় একটি কমিক।
গোপাল ভাঁড় (বাংলা) ----- গোপাল ভাঁড় মানেই হাস্য-কৌতুকের সমাহার। তার অসংখ্য কৌতুক থেকে একটি বলি,
“এক দিন বিকালে গোপাল তার বারান্দায় বসে তামাক টানছিল। এমন সময় পাশের মুসলমান পাড়ার আজাহার মোল্লার মা এসে মুখ গোমড়া করে গোপালের সামনে দাড়ালো।
গোপালঃ কি চাচী, ব্যাপার কি? মুখ শুকনো কেন?
চাচীঃ আমার খুবই বিপদ!
গোপালঃ বিপদ? কেন, কি হয়েছে?
চাচীঃ আজাহার কাল বিকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, এখনো ফেরেনি। এখন কি উপায় করি বলো তো?
গোপালঃ এ নিয়ে ভেবো না চাচী। নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যাও। তোমার বেটা আজাহার তো মোল্লা, অতএব তার দৌড় বেশি দূর হতে পারে না। তুমি বরং একবার মসজিদে গিয়ে খোঁজ নাও। কথায় বলে না, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্তই”। [এখন হো হো করে হাসতে হবে]
এইসব অনুষ্ঠানগুলোর সাথে ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়া’-র মত আছে, এইজ রেটিং বিহীন বহুল জনপ্রিয় ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা (কলকাতা) সিরিয়াল-সম্ভার!
কি শিখছে?
অর্ধনগ্ন ও অশ্লীল বিজ্ঞাপনে ভরপুর ভারতের টিভি চ্যানেলসমুহ হিন্দু প্রধান দেশের হওয়ায় এর মূল বিষয়বস্তু হলো হিন্দুদের ধর্মীয় কালচার। সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক যুগের অসুস্থ সেকুলার ধ্যান-ধারণা। অপরদিকে কাগজে-কলমে হলেও বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। হিন্দি সিরিয়াল যাই প্রচার করুক না কেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে হিন্দু তো বটেই, মুসলমানদের মন ও মস্তিস্কে গ্রথিত করা। হিন্দি ও বাংলা সিরিয়ালগুলো শুরু হয় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোসহ ব্যাকগ্রাউন্ডে হিন্দু শ্লোক বা ধর্মসংগীত দিয়ে। আবহসঙ্গীতে থাকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য, পূজার সঙ্গীত ইত্যাদি। আনুমানিক ২০-২৫ মিনিটের একটি কাহিনীবিহীন সিরিয়ালে অন্ততপক্ষে ১৫ মিনিট বিভিন্ন ধরনের পূজা-অর্চনার ‘আকর্ষণীয়’ কর্মকাণ্ডসহ হরেকরকম মূর্তির চেহারার সামনে ক্যামেরা ধরে থাকে।
শিশুদের উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, শিশুরা টিভিতে যা দেখে তাই সত্য বলে মনে করে। আর সেই দেখা ও শেখা যদি হয় অভিভাবকের অবর্তমানে তাহলে তো সোনায় সোহাগা! হিন্দু ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে তৈরি শিশুতোষ কার্টুন, এনিমেশন এবং সিরিয়ালগুলো থেকে একটি মুসলিম পরিবারের শিশু কি শিখতে পারে, সেটা বোধহয় আর বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নাই। শুধু অল্পকিছু উদাহরণ দেই।
বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় যাত্রাকালের দোয়ার পরিবর্তে “দুর্গা, দুর্গা” বলতে হয়। যে কোন বিপদে আল্লাহ্র স্মরণ না করে বরং বলতে হবে “হে ঠাকুর, রক্ষা কর” অথবা “দেবী মা, তোমার এই সন্তানকে কৃপা কর”। জিনের ক্ষতিকর (তাদের ভাষায় ভুত-প্রেত-শাকচুন্নি-পেত্নী-ডাকিণী-ব্রম্যদৈত্য) প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে আয়াতুল কুরসি বা তিন কুল পরার কোন প্রয়োজন নাই। বরং ‘ভুত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম-লক্ষন সাথে আছে, করবে আমায় কি?’ বললেই চলবে! আর অবস্থা বেশী বেগতিক হলে জটাধারী গেরুয়া ধুতি পরা তান্ত্রিক বা সাধু-সন্ন্যাসীকে ডাকতে হবে। সে এসে নাচানাচি করে অবোধ্য ভাষায় কিছু মন্ত্রপাঠ করলেই মুশকিল আসান হবে। হিন্দু দেবী-দেবতারা সুপারম্যানকেও হার মানায়। তাদের খুশী করতে লাড্ডু ও ফল নিয়ে তাদের সামনে ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ বলে নাচগান করলেই তারা বেজায় খুশী হয়ে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় ‘বর’ দেয়। করিম মিয়া বা রহিম শেখ নামে অতি দুর্লভ কিছু মুসলিম চরিত্র যাও বা দেখা যায়, তারা সাধারণত গরীব ব্রাহ্মণকে ভিটামাটি ছাড়ানোর চেষ্টায় থাকে, অথবা ‘অবুঝ’ হিন্দুকে দ্বিতীয় বিয়ে করার ‘কুপরামর্শ’ দেয়! এককথায়, ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে পরিবেশিত অনুষ্ঠানগুলো হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদ প্রচার ও প্রসারের মাধ্যম, তথা মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারযন্ত্রের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার।
মুসলিম শিশুদের অন্তরে শিরক ও কুফর বীজ বপনে এই অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে এক একটা মাস্টারপিস। শিরক হচ্ছে আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করা আর কুফর হচ্ছে সত্য জানার পরও আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। আল্লাহর কাছে শিরক হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপরাধ। বান্দার অন্যান্য গুনাহ ইচ্ছা করলে তিনি ক্ষমা করে দিবেন কিন্তু তিনি (আল্লাহ) কাফের ও শিরককারীদের কখনও ক্ষমা করবেন না। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে শরীক করে, এ ছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে সে সুদূর পথভ্রষ্টতায় নিপতিত হয়েছে”। [৪:১১৬] ছেলের প্রতি লুকমান (আঃ) এর প্রথম নসিহত ছিল, “… হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করোনা, নিশ্চয়ই আল্লাহ্র সাথে শরীক করা মহা অন্যায়” [৩১:১৩]। আর এখনকার ‘মুসলিম’ বাবা-মায়েরা নিস্পাপ সন্তানের জীবনটাই শুরু করে এইসব ঈমান ধ্বংসকারী অনুষ্ঠান দেখিয়ে! একটি কার্টুন যে শিশুর ওপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারে তা হয়তো আপনি বুঝতে পারছেন না কিংবা বোঝার চেষ্টাও করছেন না। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলঃ কার্টুন দিলে আপনার শিশুটি শান্ত হয়ে থাকছে, তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে, আপনাকে অযথা বিরক্ত করছে না, কান্নাকাটি করছে না, ইত্যাদি। বিষয়টিকে ‘মুসলিম’ বাবা-মা তেমন পাত্তা না দিলেও, এই অনুষ্ঠানগুলো মূলত আমাদের কোমলমতি সন্তানদের ঈমান ধ্বংস করছে। দিনের পর দিন এইসব বিষাক্ত মতবাদ আমাদের অনুভুতিকে অবশ করে ফেলছে। এর ফলে, এসব অনুষ্ঠানে দেখানো শিরকগুলো আমাদের কাছে সাধারন মনে হচ্ছে; বরং মূর্তিপূজার প্রতি, শিরকের প্রতি মুসলমানদের যে সহজাত ঘৃণা থাকা উচিত, তা এখন উধাও হয়ে গিয়েছে! এ সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, “আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি খুব সুন্দর আকৃতিতে আর সেই মানুষ কর্মের কারণে অবক্ষয়ের/ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে যায়”। [৯৫:৪-৫] হিন্দু ধর্মের অনেক কিছুই মুসলমানরা অজ্ঞতাবশত নিজেদের মধ্যে আত্মীকরণ করে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, আমাদের চলনে-বলনে, আচার-আচরনে, উৎসব-অনুষ্ঠানে হিন্দুধর্মের প্রভাব দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। একজন মা তার সন্তানের সবচেয়ে প্রথম শিক্ষক। দুঃখের বিষয়, সেই মায়ের সাথে তাদের শিশুরা এসব দেখছে এবং মা ও সন্তান উভয়ই অনুকরণ করছে।
আল্লাহতালা শেষ দিবস সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন, “নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও হৃদয় সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে”। [১৭:৩৬] যেসব বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে অজ্ঞতাবশত অথবা জেনেশুনে এইসব শিরক ও কুফরে ভরপুর অনুষ্ঠানগুলো দিনের পর দিন নির্দ্বিধায় দেখাচ্ছেন, তারা মনে রাখবেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল; তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এককথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে’। [ সহিহ বুখারী]
হে মুসলিম বাবা-মা, একদিন জবাবদিহির জন্য মহান আল্লাহতালার সামনে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে! আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম বাবা-মায়েদের সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করুন, দ্বীনের পথে থেকে নিজ সন্তানদের দ্বীনের পথে রাখার তৌফিক দান করুন।
[এই নোটটি লেখার সুবিধার্থে তাসনীম তাবাসসুম, শুকনো পাতা, সাফওয়ানা জেরিন এবং সময় মারমা তাদের মুল্যবান সময় ব্যয় করে বর্তমানে বাচ্চাদের কাছে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর নাম সংগ্রহ করে দিয়েছেন। আমি তাদের সকলের কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ]
ফেসবুক থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন