শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক কর্মকর্তার বদলি ঘিরে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে চলেছে। পরিচালক পদের ওই কর্মকর্তা হাইকোর্টে রিট করেছেন, বিপরীতে দপ্তরের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়েছে। বিষয়টি গড়িয়েছে মন্ত্রিপরিষদ, মুখ্য সচিবের দপ্তর, দুদক ও একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ মহল পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, বদলি হওয়া কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে আগের পদে অফিসও করেছেন। এ নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে দপ্তরটিতে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রশাসনের জাতীয়তাবাদী প্যানেল থেকে প্রথম (সিঙ্গেল অর্ডার) পদায়ন পান ডিআইএ পরিচালক প্রফেসর কাজী কাইয়ুম। যিনি শিক্ষা ক্যাডারে প্রফেসর শিশির নামে পরিচিত। নানা অভিযোগ ওঠায় তিন মাস না যেতেই গত ২১ নভেম্বর ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয় তাকে। যথারীতি ২৫ নভেম্বর তিনি দপ্তর থেকে রিলিজ (ছাড়পত্র) নেন।
কিন্তু হঠাৎ সরকারের এ বদলির আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন শিশির। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট তার বদলি তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। সেই আদেশ নিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর ভোরে ডিআইএ-তে আসেন তিনি।
এদিকে, শিশিরের অফিস করা ঠেকাতে পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ডিআইএ। নিরাপত্তা চেয়ে ইতোমধ্যে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এছাড়া হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা ভাবা হচ্ছে।
জানতে চাইলে প্রফেসর কাজী কাইয়ুম শিশির ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের আলোকে আমি রিট করেছি। সরকারি চাকরি বিধিমালা ১৯৮২-তে বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার তিন বছর আগে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বদলি করতে পারবে না। আমার দুই বছর চাকরি আছে। সেই আইনের আলোকে আইনের আশ্রয় নিয়েছি এবং রায় পেয়েছি। যেহেতু আদালত আমার পক্ষে রায় দিয়েছেন, তাই আমি ফের যোগদান করেছি। এখন যারা আমার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আদালতে যাব।
তার এমন পদক্ষেপ নিয়ে রীতিমত ‘থ’ হয়ে গেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এমন নজির এর আগে কখনো তারা দেখেননি। সরকারে আদেশ ঠেকাতে একজন সরকারি কর্মকর্তা উচ্চ আদালতে যাওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। তার মতো সবাই যদি আদালতে যায় তাহলে কাউকে বদলি করা যাবে না।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (সরকারি কলেজ) মো. নুরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি ঢাকায় থাকতে নয়, তার পদ ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করেছেন। আমরা সেই রিটের বিরুদ্ধে আপিল করব। এটর্নি জেনারেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। সবাই যদি মন্ত্রণালয়ের বদলি আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যায়, তাহলে কাউকে তো বদলি করা যাবে না।
তিনি বলেন, তাকে সুনিদিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বদলি করা হয়েছে। এখন তিনি যদি পদ আঁকড়ে রাখতে এমন করেন তাহলে আমাদের ভিন্ন চিন্তা করতে হবে।
শিশিরের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
জানা গেছে, ডিআইএ-তে পদায়ণ পাওয়ার পর নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগের সময়ের কর্মকর্তাদের রক্ষা, আশ্রয়, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তাকে বদলি করা হয়। শিক্ষা ক্যাডার ও নিজ দপ্তরে অর্থের বিনিময়ে পদায়ন করাতে একটি বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার পর তার বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার সঙ্গে একই দপ্তরের যুগ্ম পরিচালক মো. আবু আল কায়সারের দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই মাস আগে। শেখ হাসিনার পতনের একদিন আগে ৪ আগস্ট শিক্ষাভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খুনি বলে স্লোগান দেন আওয়ামীপন্থি ২০-২২ জন কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ডিআইএ-এর কর্মকর্তা। তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা নেননি পরিচালক কাইয়ুম শিশির। অভিযোগ ওঠে কাইয়ুম শিশির মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাদের রক্ষা করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ছয়জনকে তিনি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পরিদর্শনে পাঠান। এর মধ্যে একজন কক্সবাজারে গিয়ে জনরোষে পড়েন। এ নিয়ে দপ্তরের যুগ্ম পরিচালকের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এ প্রসঙ্গে কাজী কাইয়ুম শিশির ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪ আগস্ট শুধু ডিআইএ নয়, শিক্ষাভবনের অনেকেই স্লোগান দিয়েছেন। অন্য দপ্তরগুলো কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আমি যদি ব্যবস্থা নিতাম তাহলে সমালোচনা হতো।
যুগ্ম পরিচালকের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গে বলেন, দপ্তরটি খুবই টেকনিক্যাল দপ্তর। নতুন যারা আসেন প্রথম অবস্থায় কোনো কাজ বোঝেন না। সেজন্য আমি চেয়েছিলাম পুরনো-নতুন কর্মকর্তা মিলিয়ে একটি টিম গঠন করতে। কিন্তু উনি সেটা চাননি।
শিক্ষা সচিব, ক্যাবিনেট সচিব, মুখ্য সচিবকে গোনার সময় নেই!
২১ নভেম্বর বদলি করার পর গত ২৪ নভেম্বর তার রুমে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে তার ক্ষোভের কথা জানান শিশির। সেখানে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, মন্ত্রীপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ, মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়াকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন।
এই প্রতিবেদকের হাতে সেদিনের অডিও রেকর্ড এসেছে। সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘মন্ত্রণালয়ের লোকজন মনে করছে এই পদ (পরিচালক) আমার জন্য সোনার হরিণ। আমাকে বদলি করলে আমি বেহুঁশ হয়ে যাব। সিদ্দিক জোবায়েরের বাবারও সাধ্য নাই আমাকে ময়মনসিংহে পাঠানোর। প্রয়োজনে চাকরি করব না। সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার (সচিব) কন্ট্রিবিশন কী, কোন যোগ্যতায় শিক্ষা সচিব হয়েছেন সব জানিয়ে দেবো। চাকরিই যদি না করি তাহলে কে সিদ্দিক জোবায়ের, কে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি, কে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি গোনার সময় আছে? মুখ্য সচিব সিরাজুল ইসলাম সাথী যদি মনে করেন দুই বছরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি তার জীবনের শেষ সময়, তাহলে তিনি মায়ের পেটে আছেন। ওয়ান ইলিভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে নীলফামারিতে পোস্টিং করেও তিন বছর সেখানে পাঠাতে পারেনি। এখন না গেলে বেতন আটকাবে, এসব বেতনের ধার ধারে না শিশির।’
এসব কথা বলার বিষয়টি অস্বীকার করে শিশির বলেন, তারা আমাদের সিনিয়র স্যার। তাদের ব্যাপারে আমি কেন এসব মন্তব্য করতে যাব? রেকর্ড প্রসঙ্গে বলেন, প্রয়োজনে ফরেনসিক টেস্ট করা হোক।
এলাকায় ‘নির্বাচন’ করার জন্য পরিচালকের সিল দরকার ছিল!
সেই অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, প্রফেসর শিশির কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এলাকায় নির্বাচনের পোস্টারের জন্য একটা পরিচালক পদ লেখার দরকার ছিল, সেটি হয়ে গেছে। এখন চাকরি করলে কী আর না করলে কী, আমার কী আসে যায়। আমার পরিবারও চায় না আমি চাকরি করি। তারা চায়, আমি ব্যবসায় সময় দিই। আমার ৭-৮টি রানিং ব্যবসা আছে।’
ডিআইএর সমালোচনা করে এই অধ্যাপক বলেন, আসার পর থেকে শুনতেছি এটা (ডিআইএ) চোরের জায়গা; এখানে চুরি না করলেও নাকি চোর।
অডিও রেকর্ডের এই অংশের সত্যতা পাওয়া যায় তার কথায়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১৯৯৯ সাল থেকে সরকারের অনুমোদন দিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করছি। আমি চাকরি শেষে এলাকায় নির্বাচন করব, এটাও সত্য। সেজন্য একটি পরিচালক পদ দরকার ছিল, সেটি হয়ে গেছে।
নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি
হাইকোর্টে রিট করার পর ৮ ডিসেম্বর হঠাৎ সকাল সাড়ে ৮টায় কয়েকজন লোক নিয়ে অফিসে আসেন শিশির। তখনও অন্যান্য কর্মকর্তারা আসেননি। তিনি অফিস সহকারীদের চাবি নিয়ে তার কক্ষে যান।
এ ঘটনায় নিরাপত্তা চেয়ে গত ১০ ডিসেম্বর শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়রি করেন দপ্তরটির যুগ্ম পরিচালক আবুয়াল কায়সার।
জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, গত ৮ ডিসেম্বর সাবেক পরিচালক কাইয়ুম শিশির অফিস শুরুর আগেই সকাল সাড়ে ৮টায় পরিচালকের কক্ষে জোরপূর্বক প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে বেশকিছু সময় অবস্থান করেন। অফিস সহকারীকে তিনি বলেন, আমার আবার অর্ডার হয়েছে, এখানে কাজ আছে।
এ প্রসঙ্গে শিশির বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশে আমি এখানে এসেছি। আমার আসায় যারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাদেরকে আমি হাইকোর্টে নিয়ে যাবো। তারা আদালতের আদেশ অমান্য করছেন।
দুদকের ডাকে সাড়া দেননি শিশির
দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া শিশিরকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তলব করেছিল গত ২৫ নভেম্বর। কিন্তু তাতে তিনি সাড়া দেননি।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা না থাকায় তিনি হাজির হননি জানিয়ে শিশির বলেছেন নতুন কমিশন গঠন করা হলে তিনি দুদকে যাবেন।
দুদক যেসব অভিযোগে তাকে ডেকেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ পড়েছে দুদকে। অভিযোগে বলা হয়, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে পদায়ন পাওয়ার পর কাইয়ুম বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অডিট ও তদন্তের নামে ভয়ভীতি ও নানা হয়রানির মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা ও ঘুষ গ্রহণ করেছেন। তিনি এবং তার গড়া সিন্ডিকেট এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। জনতা ব্যাংক-এর বংশাল শাখা ও ব্রাক ব্যাংক-এর মতিঝিল শাখার ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখলে তার কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ২০০৭ সাল থেকে শিক্ষা ক্যাডারে একচেটিয়া বদলি বাণিজ্য করে প্রচুর অবৈধ অর্থ অর্জন করেন শিশির। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি খাদ্য অধিদপ্তরের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাংলাদেশ পুলিশ ও ইডেন কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খাবার সরবরাহ করতেন। পরিদর্শনও নিরীক্ষা অধিপ্তরের পরিচালক হয়ে আসার পর তিনি অবৈধ অর্থ দিয়ে ঢাকার গুলশান-২ এ রোড নং-২৭ এ বিলাসবহুল ৩টি ফ্ল্যাট, উত্তরার কনকর্ড গ্রীন প্লাজায় ফ্ল্যাট ও বাড্ডা এলাকায় নিজস্ব ৪তলা বাড়ী এবং নিজ জেলা জামালপুরে অভিজাত ডুপেক্স বাড়িসহ নামে বেনামে কয়েকটি শিল্প কারখানার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, শিশিরের নামে বেনামে অসংখ্য প্লট ও জমি রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পূর্বাচল ২১ নং সেক্টরে 'চরি নামে ৬ কাঠা প্লট। ঢাকার উত্তরখানে ৯ কাঠা জমি। স্ত্রীর নামে ১০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র ও বড় ছেলের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের ২০ লক্ষ টাকা ডিপোজিট। বিলাস বহুল জীবন যাপন করা শিশিরের গাজীপুরে যৌথ মালিকানাধীন একটি রিসোর্ট রয়েছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শিশির বলেন, ‘দুদকে অভিযোগ করলেই তো প্রমাণ হয়ে যায় না আমি অপরাধী। তার জন্য প্রমাণ দরকার।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন