১৪ ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’। দিনটি ছিল মঙ্গলবার ১৯৭১। এই দিনে অগণিত বুদ্ধিজীবীর তাজা রক্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আমাদের বিজয় পতাকা। মহান মুক্তিসংগ্রামে পাকিস্তানি হায়েনাদের ক্ষিপ্ত-লোলুপ জিহ্বার খোরাক হন দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। জাতিকে মেধাশূন্য ও নেতৃত্বহীন করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও উচ্চপদস্থ আমলারা ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে নির্মমভাবে শহীদ হন।
বাংলাপিডিয়ার তথ্যসূত্রে জানা যায়, একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী ও ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান। কবির ভাষায়—‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই....।’ (সুপ্রভাত : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান ও জ্ঞানীর মর্যাদা সর্বাধিক। ইসলাম বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। কেননা পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী হলো, ‘পড়ো! তোমার প্রভুর নামে...পাঠ করো সেই মহিমান্বিত প্রভুর নামে, যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৪)
এ কথা স্পষ্ট, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন একেকজন ‘কলম সৈনিক’। জ্ঞানই আলো। তাই ইসলামে জ্ঞানীর অবস্থান সম্মানজনক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যাকে জ্ঞানদান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে।’(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৬৯)
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগই ছিলেন শিক্ষাবিদ। ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘কল্যাণকর শিক্ষা গ্রহণকারীর জন্য (প্রাণ-প্রকৃতির) সব কিছু আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করে।’ (তিরমিজি)
অন্যদিকে প্রিয় নবী (সা.) মানুষের প্রতিভা প্রসঙ্গে বলেন, ‘সোনা ও রুপার খনির মতো মানুষও খনিতুল্য।’ (মুসলিম) আর আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও ‘জ্ঞানের খনি’।
ইসলাম শান্তি ও ন্যায়ের ধর্ম। রক্তারক্তির হঠকারিতা ইসলামে নেই, বরং শহীদের মর্যাদা অপরিসীম। দেশ, ধর্ম, শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য মহান আল্লাহর আদেশ, প্রিয় নবীর (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে আত্মোৎসর্গকারী মুমিনের মৃত্যু নেই। মহান আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহর পথে মারা যায় তোমরা তাদের মৃত বোলো না; বরং তারা ‘চিরঞ্জীব’...।” (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৫৪)
এ বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর বাণী : ‘একমাত্র শহীদরাই শাহাদাতের উচ্চ মর্যাদা দেখে আবার দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে, যাতে সে ১০ বার (অসংখ্যবার) শহীদ হতে পারে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। স্বাধীনতা মহান আল্লাহর নিয়ামত। অথচ আমরা কি ভেবে দেখেছি, স্বাধীনতা মহান আল্লাহর কত বড় নিয়ামত? বর্তমান বিশ্বে তিব্বত, হংকং, আরাকান নামে কোনো স্বাধীন দেশ নেই। তামিল, কাশ্মীর আন্দোলন, পাঞ্জাবের ‘খালিস্তান’ সংগ্রামে কম রক্ত ঝরেনি। দীর্ঘতর হয়েছিল আলজেরিয়া ও কিউবার মুক্তিসংগ্রাম। দক্ষিণ সুদান, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা এসেছে অনেক অপেক্ষা ও ত্যাগে।
রক্ত ঝরিয়েও লক্ষ্যে পৌঁছায়নি রাশিয়ার ‘চেচেন’ ও ফিলিপাইনের ‘মরো’ জাতীয়তাবাদীরা। ষাটের দশক থেকে স্বাধীনতার লড়াই করতে করতে ক্লান্ত-হতাশ ফিলিস্তিনি মুসলিম ভাইয়েরা। তাই মাতৃভূমির মুক্তির জন্য কবি শামসুর রাহমানের আহ্বান ‘...পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায় তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা)
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। Independence is a precious gift of Allah, যা ‘রক্তঋণে কেনা’। পবিত্র কোরআনের একটি সুরার নাম ফাতহ, অর্থাৎ বিজয়। এর শুরুতেই মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমায় দান করেছি সুস্পষ্ট বিজয়।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ১)
১৯৫২, ৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০, ৭১-এর কালপরিক্রমায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা, শাসনকাজে জনগণের অংশগ্রহণ তথা গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ ও জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনা। এ ক্ষেত্রে মজলুম জনগণের হাহাকারে আল-কোরআনের শাশ্বত আবেদন হলো : ‘আর তোমাদের কী হলো যে দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে যুদ্ধ করছ না—যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের অত্যাচারীদের এই জনপদ থেকে উদ্ধার করো। তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অভিভাবক পাঠাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠও।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৭৫)
তাই ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীর-উত্তম, ১৭৫ জন বীরবিক্রম এবং ৪২৫ জন বীরপ্রতীক—সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
স্বদেশ প্রেমের ঈমানি চেতনায় আমাদের কর্তব্য হলো, দেশের স্বার্থে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তোমাদের দায়িত্বশীলতার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।’ (বুখারি)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয়, নিরীহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় জুলুমের খড়্গ—তাই আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিরোধ। স্বাধীনতাসংগ্রামে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের অগ্রসৈনিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে যারা আত্মত্যাগ করেছেন, মহান আল্লাহ যেন তাদের শাহাদাতের উচ্চ মর্যাদা নসিব করেন। যারা স্বজন হারিয়ে, পঙ্গুত্ববরণ করে কষ্টে আছেন, আল্লাহপাক যেন তাদের স্বস্তি দান করেন।
যেসব বীর সন্তান জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিলেন প্রিয় স্বাধীনতা, তারা যেন সুস্থ থাকেন, দীর্ঘায়ু হন। দেশ গড়ার সংগ্রামে শহীদদের দেখানো স্বপ্নিল পথে আমরা এগিয়ে যাব—এটাই হোক মোনাজাত। বিজয় দিবসের ঊষালগ্নে নিবেদন—‘চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রুটুকু, এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই/হারানো স্মৃতির বেদনায়, একাকার করে মন রাখতে নেই....।’ (নজরুল ইসলাম বাবু) (লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর) [email protected]
বিডি প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন