থামেনি চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী রোগীর স্রোত। প্রতি বছর ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করাতে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশি রোগীরা। কূটনৈতিক উত্তেজনায় গুরুতর রোগী ছাড়া ভিসা দিচ্ছে না ভারত। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর আলোচনা চলছে দেশজুড়ে।
এ ব্যাপারে গত রবিবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেছেন, ‘দেশের চিকিৎসকদের মান নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু রোগ শনাক্তে ডায়াগনস্টিক টেস্ট রিপোর্টের ক্ষেত্রেও সে মান ধরে রাখতে হবে। একটা টেস্ট কেন তিন জায়গায় মানুষ করাবে! মানুষকে মানসম্মত সেবা দিতে পারলে তারা আর বিদেশে যাবে না। চিকিৎসা ব্যবসা নয়। শুধু সরকারকে বললে হবে না, সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসায় সমন্বয়হীনতা রয়েছে, জনবল, যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। কোথাও জনবল আছে যন্ত্র নেই, আবার কোথাও যন্ত্র আছে জনবল নেই। ক্যান্সার চিকিৎসায় আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। যেখানে হাত দিচ্ছি সেখানেই সমস্যা।’ ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৫ লাখের মতো রোগী ভারত যায়। স্বাস্থ্যসেবা নিতে তাদের প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। গত বছর জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানা যায়, একক দেশ হিসেবে ভারতেই ক্রেডিট কার্ডে সবচেয়ে বেশি খরচ করে বাংলাদেশিরা। বস্তুত দেশের বাইরে ক্রেডিট কার্ডে মোট খরচের চার ভাগের এক ভাগ হয় ভারতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশিরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ৭৩ কোটি টাকা খরচ করেছিল। মার্চে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৩ কোটি টাকা। এর বড় একটি অংশ খরচ হয়েছে চিকিৎসা খাতে। চিকিৎসার জন্য যাওয়ার সময় রোগীরা খরচ মেটাতে ডলার, ইউরো কিনছে। এতে চাপ বাড়ছে ডলার, ইউরোর বাজারেও। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেছেন, ‘দেশের মানুষ নানা কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে মানসিক আস্থার সংকট অন্যতম। আবার ১৬ কোটি মানুষের জন্য যত ভালো মানের হাসপাতাল থাকার কথা, তা সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে নেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেকে প্রতিবেশী দেশে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশে মানুষ বেড়াতেও যায়। আবার অনেকে চিকিৎসাও করিয়ে আসে। একসঙ্গে দুই কাজ হয়। আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রযুক্তির উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। কাজেই রোগীরা বিদেশমুখী হয়। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত হলে তবেই এ বিদেশযাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব।’ ভারত-বাংলাদেশের চলমান কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে একেবারে গুরুতর রোগী ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশিকে মেডিকেল ভিসা দিচ্ছে না ভারত। ক্যান্সার, কিডনি, হৃদরোগ, লিভারের ক্ষতজনিত সমস্যার মতো ১২ ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে ভারতে যায়। ভিসা না পাওয়ার কারণে বিপাকে পড়েছে এ রোগীরা। চিকিৎসার জন্য ভারতের বিকল্প হিসেবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে অনেক বাংলাদেশি রোগী। তবে অনেকেরই এ দেশগুলোয় চিকিৎসার খরচ ও ভ্রমণ ব্যয় বহন করার সামর্থ্য নেই।
জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। একই চিকিৎসা বাংলাদেশে করতে যে ব্যয় হয়, তা করতে ভারতে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে তিন থেকে ১০ গুণ বেশি। তবে হাসপাতালের বিল, কেবিন খরচসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচাপাতি হিসাব করলে খরচ প্রায় কাছাকাছি হয়ে আসে; যার কারণে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর প্রতি অনীহা বেড়েই চলেছে দিনদিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘দেশে সেবা নিয়ে রোগীরা সন্তুষ্ট হলে তারা বিদেশমুখী হবে না। এতে দেশে অবকাঠামো গড়ে উঠবে। সরকারের দিক থেকে আলোচনা প্রয়োজন; একই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোও মান বাড়ানোর এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন