Image description
ভাঙা যাচ্ছে না ক্ষুধার চক্র
খরচ বল্গাহীন। দু-তিন বছর হয়ে গেল আয়ে তেমন বর্ধন নেই। বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়াশোনা, বাজার-সদাই, চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে এখন আর পারছেন না গাড়িচালক মাহবুবুর রহমান। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালিয়ে মাস ফুরালে মাইনে পান ১৫ হাজার। সেই টাকায় আর মেলে না যোগ-বিয়োগ। গলির মুদি দোকানের বাকির ফর্দ দিন দিন লম্বাই হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দামের ধাক্কায় মাছ-মাংস খাওয়া একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। ভরসা এখন ডাল, ভর্তা আর সবজিতে। জলবায়ু পরিবর্তন, উৎপাদন কমে যাওয়া, নিত্যপণ্যের উচ্চদরের কারণে ক্রয়ক্ষমতা হারানো, অনিরাপদ খাদ্যের আগ্রাসনসহ নানা কারণে মানুষ চাহিদামতো খাবার খেতে পারছে না। এতে একদিকে দেখা দিচ্ছে পুষ্টির অভাব, অন্যদিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষমতায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বিপর্যয় দেখা দেবে বলে শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এবারের ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীপ্রধান পরিবার ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। এতে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারের খাবার ও চিকিৎসা আরও কঠিন করে তুলেছে। অপুষ্টি দূরীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সামগ্রিক কৌশল দরকার। জলবায়ু সহনশীলতা এবং লিঙ্গ সমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপুষ্টির হার কমানো এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য উন্নয়ন-সহযোগী, বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এদিকে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে এ বছরও মাঝারি মাত্রার ক্ষুধায় আক্রান্ত বাংলাদেশ। দেশের বহু মানুষ পুষ্টিকর ও প্রয়োজনীয় খাবার পান না, তা জানতে গবেষণার প্রয়োজন নেই। পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত মানুষের তালিকাটা বেশ লম্বা। তাদেরই একজন রহিমা বেগম। রাজধানীর খাদ্য ভবনের সামনে এসেছেন ন্যায্যমূল্যে চাল-আটা কিনতে। বললেন, ‘বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে আমার পরিবারের কেউই পরিতৃপ্তি নিয়ে পেটপুরে খেতে পারে না। শেষ কবে দুধ খেয়েছি, মনে নেই। গরুর মাংস তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি গত কোরবানি ঈদে।’ ফকিরাপুলের সালমা রহমান ও গীতা রানীর কথাতেও একই সুর। তারা জানান, সংসারে ফলমূল খুব কমই খাওয়া হয়। বেশির ভাগ সময় ভাত খান। পুষ্টিকর খাবার বলতে কী বোঝায়, তা নিজেরাও জানেন না। বাংলাদেশ এখনও মাঝারি মাত্রার ক্ষুধায় আক্রান্ত গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২৪-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ উপলক্ষে ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশ এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের যৌথ আয়োজনে ‘ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশের পথে: বাধা এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন করা হয়। ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশ ও কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষুধা মোকাবিলায় বাংলাদেশে অগ্রগতি হলেও এখানে এখনও বিরাজ করছে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধা। ১৯ দশমিক ৪ স্কোর পেয়ে বাংলাদেশ ১২৭ দেশের মধ্যে আছে ৮৪তম স্থানে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্কোর ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো থাকলেও নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষুধা নিরসনে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২-এর প্রকৃত ক্ষুধামুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে এখনও অনেক দূরে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে এখনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষ খাবারের তীব্র সংকটে থাকে। এ বছরের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ৪। এটা মাঝারি মাত্রার ক্ষুধার নির্দেশক। ২০১৬ সালের চেয়ে ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঘটলেও এ স্কোর অপুষ্টিসহ সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা নির্দেশ করে। মূলত চারটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ক্ষুধা সূচকের স্কোর নির্ধারিত হয়েছে। সেগুলো হলো অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। পাঁচ বছরের নিচের শিশুর ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ খর্বকায়। পাঁচ বছরের নিচের শিশুর ১১ শতাংশ শারীরিকভাবে দুর্বল। পাঁচ বছর বয়সের আগে প্রায় ৩ শতাংশ শিশু মারা যায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং খাদ্য ব্যবস্থা রূপান্তরের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে লিঙ্গ ন্যায্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি অর্জন করতে হলে ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আইনি অধিকার, আনুষ্ঠানিক শর্তাবলি এবং অনানুষ্ঠানিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, যা প্রায়ই পরিবার ও সমাজে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, অনিরাপদ কৃষিচর্চার ফলে আমরা নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে পারছি না। এতে পুষ্টি নিরাপত্তাও নিশ্চিত হচ্ছে না। মাছসহ বাংলাদেশে যে ধরনের প্রাকৃতিক খাদ্য বৈচিত্র্য আছে, তা রক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। এ ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তায় নারীর লোকজ জ্ঞানকেও গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, শস্য উৎপাদনে কীটনাশক ও হার্বিসাইড ব্যবহারের ফলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ব্যাধি বেড়েই চলছে। বাইরে থেকে খাদ্য আমদানির বিরোধিতা করে উপদেষ্টা বলেন, মানুষ যদি নিজের খাবার নিজে উৎপাদন করতে পারে, তাহলেই বলা যাবে আমরা ক্ষুধা মেটাতে পারছি। পুষ্টি চাহিদা মেটাতে হিমশিম আগস্টে দেশের কম আয়ের প্রায় ৩৮ শতাংশ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছিল বলে জানিয়েছিল বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকায়ন পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক ডব্লিউএফপির আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, গত আগস্টে প্রতি ১০টি পরিবারের মধ্যে ছয়টি পরিবার পর্যাপ্ত খাবার খেতে পারেনি। পরিস্থিতি এখনও বদলায়নি, গত নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ হয়েছে, যা চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বেশির ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তা মোকাবিলায় কৌশল নিয়েছে উল্লেখ করে ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতি ১০ জনের সাতজন জমানো টাকা খরচ করেছে বা বিক্রি করেছে সম্পত্তি। খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি হওয়া অনেক পরিবার হয় ঋণ করেছে বা সঞ্চয় থেকে খরচ করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবার মতো অন্য প্রয়োজনীয় খরচের সুযোগ কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি) নিতে হয়, তাতে প্রতি মাসে খরচ হওয়ার কথা ১ হাজার ৮০০ টাকা। সরকারিভাবে এটিকেই ফুড পভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ডব্লিউএফপির গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক হিসাব বলছে, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার নিতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু খরচ করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার নিতে একজন মানুষের খরচ হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। এদিকে খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে উৎপাদনও। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, তিন মাসের ব্যবধানে মাংস উৎপাদন বা ভোগ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত জুলাইয়ে দেশে মাংস উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ২৫ হাজার টন। আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পটভূমিতে মাংস উৎপাদন নেমে এসেছিল ৬ লাখ ৪১ হাজার টনে। সেপ্টেম্বরে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত ছিল। সেই মাসে মাংস উৎপাদন হয়েছিল ৬ লাখ ৩৯ হাজার টন। সর্বশেষ অক্টোবরেও মাংস উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ৬ লাখ টন। বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন মিশেল ক্রেজা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে দরিদ্রসহ অন্যান্য বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে আরও অগ্রাধিকার দিয়ে সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পঙ্কজ কুমার বলেন, বাংলাদেশ ক্ষুধা কমাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে; তবে ২০২৪ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখনও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ক্ষুধার চক্রকে ভাঙতে আমরা কমিউনিটিভিত্তিক সমাধান, অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা এবং জলবায়ু সহনশীলতার শক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর মনীষ কুমার আগরওয়াল বলেন, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির কারণে সাধারণত নারী ও কন্যাশিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা আবহাওয়ার চরম অবস্থা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবেও বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। লিঙ্গ নিরপেক্ষতাকে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। খাদ্য অধিকার আন্দোলনের মহাসচিব মো. মহসিন আলী বলেন, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা বিদেশে চাল রপ্তানি করছি, এ ধরনের বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে অধিক খাদ্য ফলানো কিংবা বেশি আমদানি করলেই ক্ষুধা সমস্যার সমাধান হবে না। খাদ্য কেনায় নাগরিকদের সামর্থ্য বাড়ানোর ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, সমস্যা সমাধানে খোলাবাজারে বিক্রি ও টিসিবির ভর্তুকি দেওয়া খাবারে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সুবিধাভোগীর তালিকা যাচাই-বাছাই করা উচিত। আগের সরকার যে তালিকা তৈরি করেছিল, তা ছিল রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অনেক সচ্ছল ব্যক্তি ভাতার তালিকায় নিজের নাম তুলেছেন। কেউ কেউ ঘুষ দিয়েও তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আমরা প্রকৃত উপকারভোগীর তালিকা করছি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে।