সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে নির্মিত হয়েছে মেঘনাঘাট যৌথ জ্বালানি (কম্বাইন্ড সাইকেল) নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র। জাপানভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি জাপানস এনার্জি ফর এ নিউ এরা (জেরা) অর্থায়নে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরীক্ষামূলক উৎপাদনের কার্যক্রমও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। জ্বালানিসাশ্রয়ী এ কেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৫ টাকা ৮৪ পয়সা দরে কেনার জন্য পিডিবির সাথে ২২ বছরের চুক্তিও করা হয়েছিল। কিন্তু গ্যাসের অভাবে এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাষ্ট্র জাপানের বিনিয়োগ। জেরা মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড ডিসেম্বরের মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে মন্ত্রণালয় পিডিবি এবং পেট্রোবাংলার কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের সাথে জেরার আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের কাছ থেকে গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কেন্দ্রটি ২২ বছর পিডিবিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ পিডিবির কাছে বিক্রি করবে জেরা ৭ দশমিক ৩১২৩ সেন্ট বা ৫ টাকা ৮৪ পয়সা দরে বিক্রি করবে। এই কেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার পর উৎপাদিত ৪০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ পিজিসিবির মেঘনাঘাট সাব-স্টেশন হয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের শক্তিশালী বন্ধু জাপানের অর্থায়নে বাংলাদেশ বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে নানাভাবে অবদান রাখছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অত্যাধুনিক সুবিধা, সবচেয়ে দক্ষ টারবাইন এবং কম শুল্কসহ জেরা মেঘনাঘাট প্রকল্প বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার জন্য একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে একই সময়ে গড়ে ওঠা সামিট ও ইউনিকের দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে। অথচ সব রকমের প্রস্তুতি থাকার পরও অদৃশ্য কারণে জাপানের বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি। জানা গেছে, মেঘনাঘাটে সামিট মেঘনাঘাট-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল এবং ইউনিক মেঘনাঘাট বিদ্যুৎকেন্দ্র চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে জেরা বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি। ফলে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় তারা বাণিজ্যিক উৎপাদনে (সিওডি) যেতে পারছে না। কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে না পারলেও জেরাকে গুনতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ঋণের কিস্তি। সম্প্রতি জেরার পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গ্যাস সরবরাহ করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সাথে দেন দরবার করেও জেরার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশে জাপানিজ বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগে তারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। তারা বলছেন, শিগগির কেন্দ্রটি চালু করতে চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা প্রয়োজন।
প্রায় ৩৫ একর জমির ওপর ২০১৯ সালে মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড প্রকল্পের কাজ শুরু করে। জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) থেকে প্রধান সরঞ্জাম ক্রয় এবং স্যামসাং সিঅ্যান্ডটি করপোরেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট এবং নির্মাণ চুক্তির ভিত্তিতে প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হলেও সরকারের গ্যাসলাইন সঞ্চালন লাইন চালু করতে ধাপে ধাপে বিলম্বের মুখে পড়ে। সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় জেরা নিজ খরচে শাখা পাইপলাইন বসাতে বাধ্য হয়। নানা ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে প্রকল্পটিতে আট মাস আগে পরীক্ষামূলক উৎপাদন চালু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ অক্টোবর বাণিজ্যিক অপারেশন অর্জনের জন্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে সপ্তাহব্যাপী পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন রেকর্ড করা হয়। তিতাসের প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করে পরীক্ষামূলক উৎপাদনের শেষদিন ১০০-১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবাহ করা হয়, যা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন রেকর্ড করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চম দিনে ৫৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ৯০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ রেকর্ড করা হয়। গত আট মাসে বিভিন্ন মাত্রায় এখানে তিতাসের গ্যাস ব্যবহার করা হয়। ইতোমধ্যে জেরা তিতাসের সব বিল পরিশোধও করেছে।
উল্লেখ্য, জেরা জাপানের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দেশে বর্তমান প্রায় ৬১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে জাপানের বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ এবং ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশে ১৩ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে জেরা। জেরা তাদের অধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি ১৫টি দেশে এলএনজি সরবরাহ করছে।
জেরা মেঘনা ঘাট পাওয়ার লিমিটিডের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবে যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই প্রকল্পটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, অত্যন্ত কর্মদক্ষ টার্বাইন এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে বাংলাদেশের জাতীয় পাওয়ার গ্রিডে যুক্ত হবে। আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে এই কেন্দ্রটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন