প্রথম আলো, যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত একটি লাইভ টকশোতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচক হিসেবে আমিও ছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে সেখানে ট্রাম্প জেতায় ইরান ভয় পাচ্ছে, এমন একটা কথা উঠলো। হ্যাঁ, ভয়ের একটা কারণ থাকতে পারে। বিবিসির খবর অনুযায়ী ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করেছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র সরকার একজন আফগানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে ট্রাম্পকে হত্যার। একই সাথে বলা হয়েছে, ইরানি পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
জিও-পলিটিক্সের ক্রিটিক্যাল পার্টটা এখানেই। অনেকে আশা করছেন, ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন, সুতরাং ইসরায়েলি আগ্রাসন তথা যুদ্ধ বন্ধ হবে। এদিকে ইসরায়েলের মূল প্রতিপক্ষ জানি আমরা ইরানকে। ইরান যুদ্ধে হামাস ও হিজবুল্লাহকে অস্ত্র দিচ্ছে ইসরায়েলকে মোকাবিলার জন্য। হিসেব মতো ইরান ফিলিস্তিনের মিত্রপক্ষ। ওদিকে ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করার কথা বলেছেন, সে হিসেবে ট্রাম্পও ফিলিস্তিনের মিত্রপক্ষ। তাহলে ইরান ট্রাম্পকে হত্যা করতে চাইবে কেন?
ইরান ইসরায়েলকে মোকাবিলার জন্য অস্ত্র দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারত ইরানের নিকটতম বন্ধু। অর্থনীতি, জিও-পলিটিক্সেও একে অপরের সম্পূরক ইরান ও ভারত। অথচ ভারত ইসরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে যুদ্ধের জন্য। ভারতীয় সমরাস্ত্র ভর্তি জাহাজ স্পেন আটক করায় তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার আবার ট্রাম্পের বন্ধু। এদিকে ট্রাম্প আবার মিত্রপক্ষ ফিলিস্তিনের। হিসেব মিলে কি?
যারা জিও-পলিটিক্স সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা এটুকু বোঝেন যে, সম্পর্কের রসায়নজনিত সমীকরণ এক কথায় মেলানো সহজ নয়। কিন্তু আমাদের সাউথ এশিয়ায় আবার সহজেই সমীকরণ মেলানো হয়, এমনকি ট্রাম্পের জয়ের জন্য পূজাও করা হয়। যদিও এসব সমীকরণের বেশিরভাগই ভুল, তবু কেউ কেউ ভুলের মাঝেই এক ধরনের তৃপ্তি খুঁজে পান। উদাহরণ হিসেবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরই বাংলাদেশের পতিত ক্ষমতাসীনরা আবার পুনর্বাসিত হবে এমন একটি সমীকরণ চালু রয়েছে।
বিশেষ করে ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এমন উল্টোপাল্টা ধারণা প্রচার করছে বেশ জোরেশোরেই। রিপাবলিক টিভি নামে একটা উদ্ভট টেলিভিশন চ্যানেল তো সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। তারা ট্রাম্প জেতার পরই প্রচার করেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছেন। সম্ভবত এটা গোয়েবলসের ধারণা থেকে উদ্ভূত প্রোপাগান্ডা। একটা মিথ্যা একশবার বললে, মানুষ বিভ্রান্ত হবে। জিও-পলিটিক্স না বোঝা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এতে বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং তাদের টার্গেট করেই সম্ভবত সীমান্তের ওপার থেকে এসব করা হচ্ছে। তবে মুশকিল হলো আমাদের ইন্টেলেকচুয়ালদের নিয়ে। মুশকিলটা কী, তা বোঝাতে একটা গল্প বলি।
স্বর্গে প্রচুর তেল ব্যবসায়ীর সমাগম। সংখ্যাধিক্যের কারণে স্বর্গ প্রায় নরকে রূপ নিয়েছে। এক তেল ব্যবসায়ী চিন্তা করলেন, এভাবে স্বর্গবাস সম্ভব নয়। স্বর্গ মানেই সুখ-শান্তি অপার। সেই ব্যবসায়ী ভাবলেন, ব্যবসায়ীদের তো লাভের কথা শুনলে হুঁশ থাকে না। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ছড়িয়ে দিলেন নরকে এবার প্রচুর তেল পাওয়া গেছে, তা থেকে বিশাল অঙ্কের লাভ করা সম্ভব। আর যায় কোথা সব ব্যবসায়ী হুমড়ি খেয়ে পড়লেন নরকে। স্বর্গে একা আরামে থাকেন সেই বুদ্ধিমান তেল ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্যবসায়ী তো, মন খুত খুত করে। ভাবেন, এত ব্যবসায়ী যে নরকে গেলো, নিশ্চয়ই সেখানে লাভের কিছু আছে। নিজেই ভুলে গেলেন, তিনি খোদ প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছিলেন তেল প্রাপ্তির ব্যাপারে। শেষ পরিণতিতে নিজেও নরকে গেলেন লাভের আশায়। স্বর্গ খালি রইলো। ঈশ্বর বললেন, স্বর্গ তেল ব্যবসায়ীদের উপযুক্ত নয়। এই তেলকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ও ভাবতে পারেন। আমাদের কথিত ইন্টেলেকচুয়ালদের অবস্থাও তাই। তারাও ভুলে যান ওপারের রিপাবলিক টেলিভিশনের সরবরাহকৃত এবং তাদের দ্বারা ছড়ানো তথ্যগুলো স্রেফ প্রোপাগান্ডা। তারা বুঝতে পারেন না প্রোপাগান্ডিস্টদেরজন্য এ দেশটা উপযুক্ত নয়।
যাকগে, কথা হচ্ছিল অভিবাসন নীতি নিয়ে। বলেছিলাম যুক্তরাষ্ট্র খোদ অভিবাসীদের দেশ। সেখানের ভূমিপুত্রদের তাড়িয়েই বাইরে থেকে আসা মানুষ দখল নিয়েছিল ভূখণ্ডটির। তারাই গড়ে তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। সুতরাং অভিবাসী হয়ে অভিবাসীদের বিরুদ্ধ অবস্থানে দাঁড়ানোটা অনেকটাই নীতিবিরুদ্ধ। হ্যাঁ, অপরাধের কথা উঠতে পারে। সাথে প্রশ্নও উঠতে পারে, অভিবাসীরাই কি শুধু অপরাধ করে। তাহলে হারলেম এর কথা বলি। সেখানের বসবাসরতরা এত অপরাধ প্রবণ কেন, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গরা। তবে কি তারা নিপীড়িত। এই কথা বলতে গেলেই হোয়াইট সুপ্রিমেসির কথা উঠে আসে। সাদারাই শ্রেষ্ঠ, এটা বেশিরভাগ রিপাবলিকান মনে করেন। পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা নিয়ে সারাবিশ্বের সমালোচনা থেকেই বোঝা গিয়েছিলো আমেরিকানদের একটা শ্রেণির মধ্যে সুপ্রিমেসি কত প্রবলভাবে জায়গা করে নিয়েছে। হোয়াইট সুপ্রিমেসিকে স্রেফ বর্ণবাদ বললে ভুল বলা হবে। এরমধ্যে রয়েছে নারীর প্রতি অবজ্ঞা, পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করা, ধর্মান্ধতা, অভিজাততন্ত্র সবমিলিয়েই ভয়াবহ এই হোয়াইট সুপ্রিমেসি। আর যারা এই হোয়াইট সুপ্রিমেসিকে মনেপ্রাণে ধারণ করে তাদের সবাই প্রায় রাজনীতিতে রিপাবলিকান। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সুপ্রিমিস্টদের সংখ্যা কম।
এবার রিপাবলিকানদের ভূমিধ্বসের জয়ের পেছনে সুপ্রিমেসির তত্ত্বও প্রবলভাবে কাজ করেছে। অভিবাসী নিয়ে যে কথা বলেন ট্রাম্প তাও মূলত বৈশ্বিক কারণে ধোপে টেকে না। বিশ্বের মোড়ল হতে চাইলে, তাকে মানবিক হতে হবে। ভাবতে হবে যারা আমেরিকায় অবৈধভাবে আসতে চান, তারা চান মূলত উন্নত জীবনের আশায়। তারা সবাই অপরাধী নন। তাদের সিংহভাগই অসহায় মানুষ। কিউবা নিয়ে অনেকে বড় বড় কথা বলেন, বিশেষ করে বামপন্থীরা। কিন্তু কিউবার জনগণকে যদি যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে বোধহয় কিউবা জনশূন্য হয়ে পড়তো। একই অবস্থা মেক্সিকোর। দুটো দেশের জীবনযাত্রার মান ভয়াবহ রকম খারাপ। সুতরাং তারা সীমান্ত পেরুতে চাইবেই। আর তা মূলত সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় এবং জীবন বাঁচাতে। মোড়ল হতে চাইলে আমেরিকাকে এটুকু মানতেই হবে।
সহজ ভাষায় বলি, আমাদের মতন গরীব দেশেও মোড়ল হতে চাইলে জনগণের জন্য দুয়ার উন্মুক্ত রাখতে হয়। আর যদি মোড়লপনা ছাড়তে চায় আমেরিকা, ফিনল্যান্ডের মতন সুখী দেশের তকমা নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে চায়, তাহলে অভিবাসী প্রশ্নে ট্রাম্পের আলাপ ঠিক আছে। আর না হলে, অভিবাসী প্রশ্নে উদার হতেই হবে।
অভিবাসী নিয়ে দুটো আলাপ ওঠে বৈধ এবং অবৈধ। বৈধ যারা আসে তাদের নিয়ে আসে আমেরিকা এবং তারা মেধাবী। তাদের মেধাকে কাজে লাগাতেই মূলত নিয়ে আসা হয়। দেশেও তাদের মূলত ভালো জীবন কাটানোর কথা। সুতরাং তাদের নামের আগে অভিবাসী শব্দটি উপযুক্ত নয়। অভিবাসন শব্দটির সাথে উপায়হীনতা যুক্ত থাকে। কেবলমাত্র যাপিত জীবনে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেই মানুষ অভিবাসী হতে চায়।
জিও-পলিটিক্সের কথা বলছিলাম এবং যা বলছিলাম তার সবই জিও-পলিটিক্সের সাথে যুক্ত। জিও-পলিটিক্সই পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে। জিও-পলিটিক্সের প্রভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই, তেমনি জিও-পলিটিক্স একমুহূর্তে বদলে যাবে এমন চিন্তা করাও বাতুলতা। নির্বাচনের পর ট্রাম্পের সাথে জেলেনস্কির আলাপ অন্তত সেই কথা বলে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। গণমাধ্যম জানিয়েছে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে বলেছেন, তিনি ইউক্রেনকে সমর্থন করবেন। এদিকে ফোনে যুক্ত হওয়ান ইলন মাস্কও জেলেনস্কিকে জানিয়েছেন, তিনি ইউক্রেনে স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট সহায়তা অব্যাহত রাখবেন। অথচ ট্রাম্পের জয়ের পর অনেকে তার উল্টোটা ভেবেছিলেন। অবশ্য তারা সবসময়ই ‘উল্টো বুঝলিরে রাম’ পজিশনে থাকেন। আমাদের দেশেও উল্টো বোঝা মানুষের অভাব নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন