বাড়তি দামে কয়লা, অতিরিক্ত খরচ ৯১৬ কোটি টাকা
দেশের কয়লাভিত্তিক বৃহৎ ও ব্যয়বহুল কক্সবাজারের মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বাড়তি দাম দিয়ে কয়লা কেনার অভিযোগ উঠেছে। এতে সরকারের অতিরিক্ত ৯১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় হতে যাচ্ছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের কাজ পেয়েছে মেঘনা গ্রুপ। মেঘনা গ্রুপের কোম্পানি ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এবং ভারতের আদিত্য বিড়লা গ্লোবাল ট্রেডিং কোম্পানি পিটিই (সিঙ্গাপুরের রেজিস্টার্ড) এর কনসোর্টিয়ামকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এ প্রতিষ্ঠানকে বাজার মূল্যের চেয়ে বাড়তি দরে কয়লা কেনার কার্যাদেশ দেওয়ায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের জন্য প্রস্তাবিত কয়লা অবশ্যই আইসিআই-৩ গ্রেডের হওয়ার শর্ত রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ান কয়লা সূচক (আইসিআই) প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮ অক্টোবর, আইসিআই-৩ গ্রেড কয়লার বাজার মূল্য ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৭৩ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার এবং দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির (টিইসি) হিসাব অনুযায়ী প্রতি টন কয়লার পরিবহন খরচ ১০ দশমিক ৮০ মার্কিন ডলার। সে হিসেবে পরিবহন খরচসহ গত ১৮ অক্টোবর প্রতি টন কয়লার মূল্য ছিল ৮৪ দশমিক ০৫ মার্কিন ডলার। কিন্তু মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (সিপিজিসিবিএল) আগের মতোই দুর্নীতির সুযোগ রেখে প্রতি টন কয়লা ১০৫ দশমিক ৮৭ মার্কিন ডলার হারে আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের অনুকূলে এনওএ জারি করেছে। যা প্রতি টন কয়লার বর্তমান মূল্যের চেয়ে ২১ দশমিক ৮২ মার্কিন ডলার বেশি ধরা হয়েছে। এই হিসাবে ৩৫ লাখ টন কয়লা কিনতে সরকারের খরচ হবে ৯১৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নাজমুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কয়লার দাম নির্ধারণের বিষয়টি এত সহজ হিসাব না। এর সঙ্গে যানবাহন খরচ আছে। দরপত্রের মূল্যেই কয়লার এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ওটিএম (উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি) করে আসছে, ডিপিএম (সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি) করে আসে নাই।’ জানা যায়, গত ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিন বছরের জন্য ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন কয়লা সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রটি কয়লা ক্রয় সম্পর্কিত হওয়ায় মূল দরপত্রের টেকনিক্যাল ক্রাইটেরিয়া অংশে ‘কয়লা’ আমদানির অভিজ্ঞতার শর্ত উল্লেখ ছিল। কিন্তু মেঘনা গ্রুপ ও ভারতের আদিত্য বিড়লা গ্রুপের কনসোর্টিয়ামকে বেআইনি সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দরপত্রের টেকনিক্যাল ক্রাইটেরিয়া অংশে পরপর চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে ‘কয়লা আমদানির অভিজ্ঞতার’ শর্তটি পরিবর্তন করে ‘কয়লা অথবা লোহা, সার, কেমিক্যাল, সিমেন্ট, খাদ্য শস্য আমদানির অভিজ্ঞতা’ কে যোগ্যতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এদিকে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামসহ চারটি প্রতিষ্ঠান উক্ত দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। তার মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই ‘টেকনিক্যালি নন-রেস্পন্সিভ’ হিসেবে বাদ দিয়ে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতের আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামকে গত ১ মে টেকনিক্যালি রেস্পন্সিভ ঘোষণা করা হয়। এরপর গত ৮ মে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাবটি খুলে দেখে তারা প্রতি টন কয়লার সরবরাহ মূল্য ১০৮ দশমিক ৮৭ মার্কিন ডলারের প্রস্তাব করেছে। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তবটি মূল্যায়ন করে জানায়, ‘উক্ত দর সিগ্নিফিক্যান্টলি হাই (উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ) বিধায় ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন কয়লা সরবরাহের একটি দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির জন্য গ্রহণযোগ্য নয়’ এবং প্রস্তাবিত দর গ্রহণযোগ্য নয় বলে সিদ্ধান্ত প্রদান করে। পরবর্তীতে সিপিজিসিবিএল কর্তৃপক্ষ আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের অনুকূলে এনওএ ইস্যু না করায় প্রতিষ্ঠানটি গত ১ জুলাই এবং ৮ জুলাই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি মালা ২০০৮ এর বিধি ৫৭(৫) এবং ৫৭(৭) অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু সিপিজিসিবিএল বা মন্ত্রণালয় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের অভিযোগ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অতঃপর আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়াম পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ৫৭(১০) অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিভিউ প্যানেলে কোনো আপিল বা হাই কোর্টে কোন রিট মামলাও দায়ের করেনি। আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের আর্থিক প্রস্তাব খারিজ হওয়ার পর তারা কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামের দরপত্র বা প্রস্তাব বিবেচনা করার আর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত ১৭ অক্টোবর সিপিজিসিবিএল সম্পূর্ণই বেআইনিভাবে আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়ামকে ৩৫ লাখ টন কয়লা ১০৫ দশমিক ৮৭ মার্কিন ডলার দরে সরবরাহের কার্যাদেশ প্রদান করে। কয়লা ক্রয় দরপত্র বিষয়ে সিপিজিসিবিএল বোর্ড এবং মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম এবং দুর্নীতি ও চক্রান্তমূলক কার্যক্রম বিষয়ে ইতোমধ্যে দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা আমদানি অত্যন্ত জরুরি, এ বিবেচনায় মন্ত্রণালয় এবং সিপিজিসিবিএলের কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি করে অবৈধভাবে আদিত্য বিড়লা কনসোর্টিয়াম বরাবরে এনওএ প্রদান করেছে। যদিও জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি কয়লা ক্রয়ের মাধ্যমে সাময়িক চাহিদা পূরণ করার বিষয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে (ধারা ৬৮ এবং বিধি ৭৪)। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডে প্রতিরোধের লক্ষ্যে এবং দেশকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হতে রক্ষা করার লক্ষ্যে কয়লা কেনার জন্য প্রদত্ত এনওএ বাতিল করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন