দ্বীপ জেলা ভোলার সবচেয়ে বড় উপজেলা চরফ্যাশন। উপজেলা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে নজরুলনগর ইউনিয়নের ‘শারেকখালি’ গ্রাম। ওই গ্রামে ভোলা-৪ আসনের চারবারের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব অন্যের জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন খামারবাড়ি। ছেলের নামে নাম দেওয়া হয়েছে মেসার্স জেনিক ফিশারিজ খামারবাড়ি।
২০০৯ সালে ১৪ একর জমিতে ওই খামারবাড়ি গড়ে তোলেন জ্যাকব। নেপথ্যে কালো টাকা সাদা করার কৌশল। ওই খামারবাড়ির পাশেই আরেক ছেলের নামে অন্যের জমিতে গড়ে তুলেছেন মেসার্স জেনিন অ্যাগ্রোফার্ম। অবকাশ যাপনের জন্য খামারবাড়িতে গড়েছেন রিসোর্ট।
যেখানে হেলিপ্যাডের ব্যবস্থাও রয়েছে। রাজধানী থেকে হেলিকপ্টারে জ্যাকব প্রায়ই ওই রিসোর্টে এসে রাত যাপন করতেন। সঙ্গে আসতেন সরকারের মন্ত্রী-আমলারাও। শারেকখালি গ্রামে যেখানে খামারবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানে ওই এলাকার দেড় শতাধিক মানুষের অন্তত ৫০ একর জমি রয়েছে।
পুরো খামারবাড়ি সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
শারেকখালি গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী হাওলাদারসহ তাঁর ১৬১ জন ওয়ারিশের প্রায় ৭৭ একর জমি রয়েছে ওই খামারবাড়িতে। ওই জমি নিয়ে বিরোধে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এই সুযোগে ২০০৯ সালে জ্যাকব প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই চর কুকরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসেম মহাজনের সহায়তায় ওই জমির ১৪ একর দখল করেন।
২০১৪ সালে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আরো প্রায় ৫০ একর জমি দখল করে চারপাশে গড়ে তোলেন সীমানাপ্রাচীর।
এবার জমি দখলের নেতৃত্ব দেন চেয়ারম্যান হাসেম মহাজনসহ চরকলমির চেয়ারম্যান কাওসার মাস্টার ও চরকলমি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন। সেখানে বারেক শিকদারসহ সাতজনের ৯ একর জমিজুড়ে ছিল টিনশেড ঘর। জ্যাকব অবরুদ্ধ পরিবারগুলোকে বলেছিলেন, জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার সময় টাকা দেবেন। কিন্তু সেই টাকা তিনি আর দেননি।
সরেজমিনে গত ২৪ ও ২৫ অক্টোবর ওই খামারবাড়ি পরিদর্শনে গেলে খামারবাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বারেক শিকদার এই প্রতিবেদককে সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে তাঁর জমির অবস্থান দেখান। ক্ষোভ প্রকাশ করে বারেক বলেন, ‘আমাদের বাড়িছাড়া করে এই জমি দখল করেছেন জ্যাকব। সেই থেকে আমরা ভাড়া বাসায় থাকছি।’
খামারবাড়ির ভেতরে সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে ইউসুফ আলী হাওলাদারের। পেশায় কৃষক ইউসুফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জ্যাকবের খামারবাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে আমাদের প্রায় ৪২ একর জমি রয়েছে। আর জ্যাকবের অ্যাগ্রোফার্মে রয়েছে দুই একর, গরুর ঘাসের খামারে আছে আরো প্রায় সাড়ে তিন একর জমি। এই জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে।
মামলার ১৬১ জন বাদীর মধ্যে মাত্র পাঁচজনের সোলে (মামলা প্রত্যাহার) নিয়ে জ্যাকব এই জমি দখল করেছেন। সোলে প্রত্যাহারের জন্য একজন অংশীদার আমির ফরাজি ভোলায় মামলা করতে গেলে জ্যাকব বাহিনী আদালত চত্বরেই তাঁকে মারধর করে। এ ঘটনার পর ভয়ে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান।
খামারের আড়ালে রিসোর্ট
খামারবাড়ির ভেতরে রয়েছে ১৮টি পুকুর। এর মধ্যে ১৬টি পুকুর ১২ লাখ টাকায় জ্যাকব একজনকে ইজারা দিয়েছেন। সাজানো খামারবাড়ির শেষ প্রান্তে রিসোর্ট। খামারে প্রবেশদ্বারের পাশে রয়েছে হেলিপ্যাড। ভেতরে সুইমিংপুল, রেস্টুরেন্ট, কটেজ গড়ে তোলা হয়েছে।
খামারবাড়ি রিসোর্টের পরিচালক কামাল উদ্দিন সৈকত বলেন, শুরুতে খামারবাড়িটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে এখন প্রবেশ মূল্য ৫০০ টাকা। কর্টেজে থাকতে দিনপ্রতি দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। তবে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে খামারবাড়িতে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ রয়েছে।
খামারবাড়ির পশ্চিম পাশে মেসার্স জেনিন অ্যাগ্রোফার্ম। এই ফার্মে সরকারি জমির একটি অংশও দখল করেছেন জ্যাকব। ফার্মে ২৫০টি গরু ও শতাধিক ভেড়া ছিল। বর্তমানে সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আরো যত সম্পদ
জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরে জ্যাকবের ১২ তলা আলিশান বাড়ি রয়েছে। যেখানে রয়েছে ৪৮টি ফ্ল্যাট। এই বাড়ি নির্মাণে খরচ করেছেন ১০ কোটি টাকা। স্ত্রী নীলিমা জ্যাকব বসবাস করেন রাজধানীর একটি বনেদি এলাকার আলিশান ফ্ল্যাটে। যার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা। এ ছাড়া ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট, যার মূল্য ৯ কোটি টাকা। ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুরে গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি। নরসিংদীতে শ্বশুরালয়ে ৪৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন জেনিক ফিসারিজ নামে বিশাল খামার।
সেখানেও ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে কানাডায় ছোট ভাই বাবুর কাছে জ্যাকব পাচার করেছেন ৩০০ কোটি টাকা। মেজো ভাই জাহিদুল ইসলাম সৌরভের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় ৫০০ কোটি টাকা পাচার করে গড়ে তুলেছেন বিশাল বাড়ি। ৩০০ কোটি টাকায় মালয়েশিয়ায় কিনেছেন একটি মার্কেট।
৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জ্যাকব মধুমতী ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন। ওই ব্যাংকে তাঁর ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় ১৭টি ইটভাটায় অংশীদার তিনি। জানা গেছে, এর বাইরে জ্যাকব চরকুকরি, চরপাতিলা, চরকলমি ও চরফ্যাশন শহরে দখল করেছেন ৫০০ বিঘা জমি। চরকলমির খামারবাড়ির প্রায় ৩৪ একর জমির নামজারি করেছেন ছেলেদের নামে। এ ছাড়া চর নাংলায় এক দাগে জ্যাকবের রয়েছে ২০০ একর জমি।
নামের কাঙাল
আইফেল টাওয়ারের আদলে চরফ্যাশনে ১৮ তলা (২২৫ ফুট) সমান উঁচু টাওয়ার নির্মাণ করেছেন জ্যাকব। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এই টাওয়ারের নামকরণ করেন ‘জ্যাকব টাওয়ার’। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জ্যাকব টাওয়ারের উদ্বোধন করেন। এর বাইরে চরফ্যাশনে তাঁর পরিবারের নামে রয়েছে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। সরকারি টাকায় গড়ে তোলা এসব প্রতিষ্ঠান তাঁর মা-বাবা, স্ত্রীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
১৫ বছরে আয় বেড়েছে ১৭০ গুণ
২০০৮ সালে পৈতৃক সূত্রে জ্যাকবের পাওয়া ফ্ল্যাট ও বাড়ি ছাড়া আর কোনো স্থাবর সম্পদ ছিল না। এখন ওই ফ্ল্যাট-বাড়ির সঙ্গে তাঁর আরো প্রায় ১৫ কোটি টাকার সম্পদ বেড়েছে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে জ্যাকবের স্ত্রীও পিছিয়ে নেই। একই সময় নীলিমা জ্যাকবের সম্পদ বেড়েছে সোয়া তিন কোটি টাকার বেশি।
২০০৮ সালে জ্যাকবের বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ টাকা। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে ১৫ বছরে তাঁর আয় বেড়েছে ১৭০ গুণের বেশি। ২০০৮ ও ২০১২ সালে নীলিমা জ্যাকবের কোনো আয় ছিল না। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নীলিমার আয় দাঁড়ায় ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে তাঁর আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ টাকায়।
১৫ বছর আগে জ্যাকবের অস্থাবর সম্পদ বলতে ২১ লাখ টাকা ছিল। বর্তমানে তাঁর কাছে ১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে তাঁর অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৭৬ গুণের বেশি। তিন মেয়াদে সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালনের পর আগের ফ্ল্যাট-বাড়ি ছাড়াও ১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ বেড়েছে।
পাঁচ বছর আগে তাঁর কোটি টাকা মূল্যের ১৭ একর কৃষিজমি ছিল। বর্তমানে কৃষিজমি বেড়ে হয়েছে ৩০ একর। তবে দাম দেখিয়েছেন এক কোটি ২৬ লাখ টাকা। কৃষিজমি ১৩ একর বাড়লেও দাম বেড়েছে মাত্র ২৫ লাখ টাকা। আরো আছে মাছের খামার, কৃষি খামার ও রিসোর্ট।
২০১৮ সালে স্ত্রীর নামে এক কোটি টাকা মূল্যের এক একর অকৃষিজমি ছিল। বর্তমানে স্ত্রীর নামে অকৃষিজমি দুই একর হলেও মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ২৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া পাঁচ বছরে স্ত্রীর নামে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের নতুন ফ্ল্যাট হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর বর্তমানে জ্যাকব জেলে থাকায় এসব বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন