বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের পুলিশের সেবামান নিয়ে সূচক তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (আইপিএসএ)। বিশ্বের ১২৫ দেশের পুলিশ সেবার মান নিয়ে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড পুলিশ ইনডেক্স-২০২৩-এ বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থান ১০০তম।
গত দেড় দশকে পুলিশে নতুন নিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে বাহিনীটির জন্য বরাদ্দ বেড়েছে ৪৩৩ শতাংশের বেশি। ২০০৯-১০ অর্থবছরে পুলিশের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার কিছু বেশি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ১৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বিপুল বিনিয়োগ ও জনবল বৃদ্ধির পরও দক্ষতা ও সেবার মান বাড়েনি পুলিশের। উল্টো গত দেড় দশকে পুলিশের নানা কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিপীড়নমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে বারবার। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত পেশাদার বাহিনীগুলোর মধ্যে ক্রমেই অবনমন হয়েছে পুলিশের অবস্থানের।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের পুলিশের সেবামান নিয়ে সূচক তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (আইপিএসএ)। বিশ্বের ১২৫ দেশের পুলিশ সেবার মান নিয়ে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড পুলিশ ইনডেক্স-২০২৩-এ বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থান ১০০তম। সেবামানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ছাড়া আর কোনো দেশের পুলিশ বাহিনী এত পিছিয়ে নেই।
এ সূচক তৈরির জন্য সক্ষমতা, অনুসৃত প্রক্রিয়া, জনমানসে কর্মপ্রক্রিয়ার বৈধতা ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে ১২৫ দেশের পুলিশের সেবামানকে মূল্যায়ন করে আইপিএসএ। এর মধ্যে সক্ষমতার হিসাব করা হয় পুলিশের জনবল, অবকাঠামো, বন্দিশালার সক্ষমতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় মূল্যায়নের ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের সূচক মান দশমিক ২৩। প্রক্রিয়াগত মূল্যায়নের মধ্যে হিসাবে নেয়া হয় পুলিশের কাছে অপরাধের অভিযোগ সামনে আসার হার, কার্যকারিতার মতো বিষয়গুলোকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশের সূচক মান দশমিক ১৫। জনমানসে পুলিশি কার্যক্রমের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে এ মান দশমিক ৪০। আর পুলিশি কার্যক্রমের ফলাফল ও সমাজে এর প্রভাবের দিক থেকে বাংলাদেশ পুলিশের সূচক মান দশমিক ৬৪। সব মিলিয়ে সেবামানে ১২৫ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে ১০০তম স্থানে থাকা বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক সূচক মান দশমিক ৩৬।
দক্ষিণ এশিয়ায় এদিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে নেপাল। দেশটির অবস্থান ৬০। ভারত ও পাকিস্তানের পুলিশ এ তালিকায় যথাক্রমে ৭৬ ও ৮০তম অবস্থানে। আর সামগ্রিক তালিকায় শীর্ষ পাঁচ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও নেদারল্যান্ডসের পুলিশ।
মূলত জনমুখী একটি পেশাদার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী হয়ে উঠতে না পারার কারণেই পুলিশ এ তালিকায় পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত দেড় দশকে পুলিশে জনবল, সুযোগ-সুবিধা ও কাঠামোগত উন্নয়ন হলেও তা বাহিনীটিকে জনমুখী করে তুলতে পারেনি। কারণ এ সময় জনগণের কল্যাণের চেয়ে পুলিশকে ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করার প্রয়াস নিতেই দেখা গেছে বেশি।
অতীতে পুলিশ পেশাদার বাহিনী হয়ে উঠতে না পারার পেছনে বরাবরই জনবল সংকট, বাজেটস্বল্পতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বিগত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৩) এ ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এ সময়ে পুলিশে ৮৩ হাজার ৭০টি পদ সংযোজন করা হয়। ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয় উচ্চ পর্যায়ের ১৭৮টি পদ। এজন্য শিল্পাঞ্চল পুলিশ, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) নামে পৃথক তিনটি ইউনিটও চালু করা হয়।
জননিরাপত্তা বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে পুলিশের মোট সদস্যসংখ্যা ২ লাখ ১৩ হাজারের বেশি। পুলিশ সদস্যদের পোশাকসামগ্রী প্রাপ্যতা বর্ধিত করে ৭১টি আইটেম সংযোজন করা হয়েছে। পুলিশের অধীনের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের জন্য কেনা হয়েছে দুটি হেলিকপ্টার। আরো দুটি হেলিকপ্টার কেনার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গত ১৫ বছরে যুগোপযোগী উন্নতমানের ৪ হাজার ৭০টি বিভিন্ন প্রকার যানবাহন ও জলযান কেনা হয়েছে।
এ সময়ে পুলিশে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে অস্ত্র ও গোলাবারুদে। আগে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে পুলিশকে দেয়া হয়েছে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চায়নিজ রাইফেল। এছাড়া এ সময় এসএমজিসহ অত্যাধুনিক অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ যুক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশের জন্য মন্ত্রণালয় ইচ্ছেমতো যা চেয়েছে সরকার তা-ই দিয়েছে। এ কারণে পুলিশের পেছনে বরাদ্দ বাড়লেও আক্ষরিক অর্থে সেবার মানে পরিবর্তন আসেনি। পুলিশের সবচেয়ে বড় সমস্যা জবাবদিহিতা না থাকা। একজন পুলিশ সদস্য চরম দুর্বৃত্তায়নের পরও পুরস্কৃত হচ্ছেন। কারণ তিনি বাহিনীতে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে নেই। এমন এক পরিস্থিতি যে পুলিশকে সব দেয়া হয়েছে। আর বলা হচ্ছে তুমি সরকারের জন্য কাজ করবে, রাষ্ট্রের কল্যাণে নয়। পুলিশের সেবার মান বাড়াতে হলে সবার আগে জবাবদিহিতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পদোন্নতি ও পদায়নের জায়গাগুলোয় শতভাগ স্বচ্ছতা আনতে হবে। তাহলেই পুলিশের সেবার মান উন্নীত করা যাবে।’
বর্তমানে পরিবর্তন ও সংস্কারের দাবি উঠছে বাহিনীর অভ্যন্তরেও। বাংলাদেশ পুলিশে তিন স্তরে চার ক্যাটাগরিতে সদস্য নিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে বিসিএস বাদে রয়েছে দুটি স্তর। তিন স্তরের এ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের প্রস্তাব দিচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। এর পরিবর্তে এক স্তরে নিয়োগ পদ্ধতি চালুর পক্ষে মতামত আসছে। একই সঙ্গে দাবি উঠছে পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক দল বা নেতার কার্যালয়ে যাতায়াত বন্ধেরও। পুলিশ সংস্কারসংক্রান্ত মতামত জানিয়ে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের পাঠানো চিঠিতে এমন সর্বমোট ২৪টি পরামর্শ উঠে এসেছে।
এর আগে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও পুলিশে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে আওয়ামী লীগ সরকার তা আর বাস্তবায়ন করেনি। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতের সরকারগুলো পুলিশ বাহিনীকে তাদের লেজুড়বৃত্তির জন্য উৎসাহিত কিংবা বাধ্য করেছে। এ রাজনৈতিক কারণেই বিভিন্ন সময় পুলিশের বিরুদ্ধে নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ এসেছে। সে জায়গা থেকে সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশকে বের করে আনতে হলে নিয়োগপ্রক্রিয়াসহ আরো অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশকে কঠোর জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হবে। তবেই বাংলাদেশ পুলিশের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে। আর সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুলিশের একটি কমিশন গঠন করে দিতে হবে। তাহলে পুলিশের জবাবদিহিতার জায়গাটা স্বচ্ছ থাকবে। আর পুলিশের নিয়োগে এক স্তরের প্রথা এখন অনেক দেশেই ব্যবহার হচ্ছে। আমাদের এখানে সেটা একবারে করা না গেলেও অন্তত দুই স্তরের নিয়োগ প্রথা চালু করা এখন সময়ের দাবি। তাহলে মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ ও পদোন্নতি-পদায়ন নিশ্চিত করা যাবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুলিশে আমরা এখন তাগাদা অনুভব করছি সংস্কারের। এটি পুলিশের সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে অবশ্যই পুলিশি সেবা, সক্ষমতা ও ইতিবাচক ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সূচিত হবে। এ সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুলিশের প্যারাডাইম শিফট”হবে। আক্ষরিক অর্থে সামগ্রিকভাবেই এ সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন