আউয়াল কমিশনের বিদায়ঘণ্টা বাজছে
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের এক মাস আজ। সংস্কারের অংশ হিসেবে এ সময়ের মধ্যে সরকারি-স্বায়ত্তশাসিত অনেক প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগ-পরিবর্তন এলেও নির্বাচন কমিশনে (ইসি) সেই ছোঁয়া লাগেনি। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের পদত্যাগ নিয়ে গুঞ্জন ছিল। এবার পুরো কমিশনের বিদায় ঘণ্টা বাজছে। গতকাল বুধবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে সিইসিসহ পুরো কমিশন অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করে পদত্যাগের ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। সূত্রের খবর, আজ বৃহস্পতিবার পুরো আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি গণমাধ্যমকে বলেন, কাল (বৃহস্পতিবার) জানাব।
ইসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল আলম জানিয়েছেন, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার (আজ) দুপুর ১২টায় নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করবে। জানা গেছে, গত কয়েক দিন পদত্যাগের খবরের মধ্যে এ সৌজন্য বিনিময় অনুষ্ঠান থেকে বর্তমান কমিশনের সরে যাওয়ার ঘোষণা আসতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসির একান্ত সচিব মো. রিয়াজ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে এ সৌজন্য বিনিময়ে পুরো কমিশন উপস্থিত থাকবেন। স্যার (সিইসি) সব বিষয় তুলে ধরবেন।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এরই মধ্যে সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। আন্দোলনের মুখে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া আইনাঙ্গনের অনেকে পদত্যাগ করেছেন। পুলিশ, প্রশাসনসহ সবখানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও পদত্যাগ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের পদত্যাগের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বারবার। এই সময়ের মধ্যে গত এক মাস প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনাররা অফিস করেন। এর মধ্যে অবশ্য দুই দিন তারা জরুরি সভাও করেছেন; তিনটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছেন।
জানা গেছে, গতকাল বুধবার সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন। সেখানেই পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে গণমাধ্যম ডেকে পদত্যাগের কারণসহ সার্বিক বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়ে সবাই একমত হন।
নির্বাচন ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ‘পদত্যাগের’ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, কাল (বৃহস্পতিবার) জানাব।
পদত্যাগ কবে করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, বৃহস্পতিবার (আজ) বিস্তারিত জানাব। যা বলার বৃহস্পতিবার ১২টায় এক সংবাদ সম্মেলনে সবকিছু জানানো হবে।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কবে দেখা করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে যাব। জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় নির্বাচন কমিশন। পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছিল বর্তমান কমিশন। জানা গেছে, প্রথমে রাষ্ট্রপতি সাক্ষাতের সময় দিলেও পরে তা বাতিল করা হয়। এদিকে কোনো পক্ষের সাড়া না পেয়ে বিরাজমান পরিস্থিতিতে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ‘বিপ্লব ও ফরমান : সরকার ও সংবিধান’ শিরোনামে কলাম লেখেন। ওই কলাম লিখার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, আলোচনার জন্য কাউকে তিনি পাচ্ছেন না। তাই নির্বাচন কমিশন যে ‘সাংবিধানিক সংকটে’ পড়েছে, সেটা পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছেন তিনি।
ছাত্র-জনতার ‘বিপ্লবের’ পর নির্বাচন কমিশন কীভাবে সংকটে পড়েছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, নির্বাচন কমিশন হয়তো অচিরেই বিগত হবে। কিন্তু এতে করে সংকটের নিরসন হবে না।
এদিকে পুরো কমিশনের পদত্যাগসহ নির্বাচন কমিশন সংস্কারের দাবিতে ইসি সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছে ‘নাগরিক সমাজ’। গতকাল বুধবার বেলা ১১টার দিকে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে তারা এই বিক্ষোভ করে ‘১৭ বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত নাগরিক সমাজ’ এর ব্যানারে। এ সময় বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন সেøাগান দেন। তবে মূল গেট বন্ধ করে দেওয়ায় তারা নির্বাচন কমিশনের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। বিক্ষোভে নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের পাশাপাশি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম নুরুল হুদা ও রকিব উদ্দিন আহমেদের বিচারও দাবি করা হয়।
২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশের ত্রয়োদশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক আমলা হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন এই কমিশন, যাদের পরিচালনায় ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়। দেশের অন্যতম প্রধান বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ইসিতে নিবন্ধিত বেশির ভাগ দল হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনকে মেনে নেয়নি। ইসির সংলাপের আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এই কমিশনের আমলে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র দলগুলো এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেওয়া, বিতর্কিত বিভিন্ন সংস্থাকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া, আইনে নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব দেওয়া, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মত পাল্টানোসহ কমিশনের নানা কর্মকা- নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।