Image description
বিদ্যুৎ জ্বালানি সহজ শুধু দাম বাড়ানো
দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ে। আর এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। দিনে দিনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করার সঙ্গে এই খাতের জন্যও সংকটও ডেকে আনছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ে সহজে। কিন্তু এসব পণ্যের ব্যয় সংকোচন বা বিকল্প কোনো উপায়ে দাম নিয়ন্ত্রণে পথ খোঁজা হচ্ছে না। উপরন্তু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে সরকার নিজেই নির্বাহী আদেশে দাম ঠিক করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যয় সংকোচন ও অনিয়ম বন্ধ করলে দাম না বাড়িয়েও মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, দাম নিয়ন্ত্রণের তো উদ্যোগ নেই। ব্যয় সংকোচন হয় না। এখন যে প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয় তাতে দুর্নীতি বেশি থাকে। অবচয় বেশি হয়। তাতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এজন্য দফায় দফায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ছে। যার চাপটা মানুষের ওপর পড়ে। তিনি বলেন, অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে দাম বাড়াতে হয়। অথচ এগুলো দূরীকরণে নজর কম। এদিকে নজর দেয়া জরুরি। তিনি আরও বলেন, ম্যানেজমেন্ট ভালো হলে এরকম দুর্নীতি হয় না। প্রয়োজন দক্ষ প্রশাসন। তাতে মানুষ কিছুটা সুফল পেলেও পেতে পারে। ওদিকে এর আগে জ্বালানির দাম বাড়ানোর বিকল্প হিসেবে বিইআরসি’র গণশুনানিতে বিশেষজ্ঞরা অনেক পথ দেখিয়েছেন। তারা নিজেদের প্রস্তাবও দিয়েছেন। তারা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধি না করে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে সুশাসন এবং ভালো ব্যবস্থাপনা যুক্ত করতে পারলে দাম না বাড়িয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো। বলা হচ্ছে- ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ যে বিপুল অর্থ দিতে হয়েছে এর প্রভাবেই এখন নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছে। মাসের পর মাস বসে থাকা কেন্দ্রকে এই ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। এখনো কিছু কেন্দ্র এই সুবিধা পাচ্ছে। বসে থাকা কেন্দ্রের এই কমানোর উদ্যোগ আগে থেকেই নিতে পারতো বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু নেয়নি। কারণ এসব কেন্দ্র পরিচালনায় অনেক প্রভাবশালী জড়িত। এ ছাড়া চুরি সিস্টেম লস কমিয়ে আনা এবং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করলে, খেলাপি বিল আদায়ের উদ্যোগ নিয়ে এই খাতের আরও উন্নয়ন করা যেতো বলে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের লাভ বাড়াতে মরিয়া। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হোক সেটা হয়তো কেউ কেউ চায় না। কারণ তা হলে লুটপাট ও চুরির সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের সাশ্রয় এবং চুরি ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করেছিল গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগ। এর ব্যবহারকারীরা সুফল পেলেও মিটার স্থাপনের প্রকল্প খুব একটা এগোচ্ছে না। এর কারণ প্রি-পেইড মিটার হলে চুরি আর লুটপাটের সুযোগ আর থাকবে না। ব্যয় কমানো ও সাশ্রয়ের এমন নানা সুযোগ থাকার পরও শুধু শুধু দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো এবং লাভ করার কৌশলের কারণে দাম বাড়ানোই এখন একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠেছে জ্বালানি খাতের জন্য। আর এই প্রবণতা দিনে দিনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করার সঙ্গে এই খাতের জন্যও সংকটও ডেকে আনছে বলে তারা মনে করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আগে তো বিইআরসি গণশুনানি করে মোটামুটি একটা দাম নির্ধারণ করে দিতো। মানুষ কিছুটা হলেও সুফল পেতো। এখন তো তাও নেই। সরকার নিজেই দাম ঠিক করে দিচ্ছে। আর এর চাপ মানুষের ওপর পড়ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো শীতেও চালিয়েছে। অথচ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে মনোযোগ কম। কিন্তু বার বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষ চাপে পড়ছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে আলোচ্য খাতকে যথার্থই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিল। যে কারণে তৎকালীন ৫ সহস্র মেগাওয়াটেরও কম উৎপাদন সক্ষমতা ক্ষমতাসীন দলের টানা তিন মেয়াদ শেষে বর্তমানে ২৯ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের মূল্যও বৃদ্ধি হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৭৫ পয়সা হতে বেড়ে ৮ টাকা ২৪ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। এখন যদি আরও ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে সাধারণ ভোক্তাগণ যাবে কোথায়? কনজ্যুমারস এসোসিশেন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পেলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও হ্রাস পাবে। কারণ, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি পেলে তার প্রতিক্রিয়া সকল পণ্য ও সেবায় পড়বে। ফলস্বরূপ প্রান্তিক মানুষেরই নাভিশ্বাস অবস্থা তৈরি হবে। গ্রাহক পর্যায়ের বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরিবর্তে অদক্ষতা, দুর্নীতি, লোডশেডিং ও অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে নজর দিতে হবে। বিশেষত বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ হ্রাস করতে পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সাশ্রয়ী হবে এবং গ্রাহকের বোঝার উপর শাকের আঁটি চাপাতে হবে না বলে তিনি মনে করেন। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, বিদ্যুতের নতুন দাম মার্চ মাস থেকে কার্যকর হবে। গ্যাসের দামও বাড়ছে। তবে বাসাবাড়ির গ্রাহক ও শিল্প পর্যায়ে গ্যাসের দাম এখন বাড়বে না। শুধু যে গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সেই গ্যাসের দাম বাড়ছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে তেলের অ্যাডজাস্টমেন্ট শুরু হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন থেকে বলা যায় যে, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ভর্তুকি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মূল্য সমন্বয়ে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা হলো আগামী তিন বছর আমরা এটাকে সমন্বয় করবো। যাতে সহনীয় পর্যায়ে থেকে সমন্বয়টা হয়, সেটার একটা ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। এ বছর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি আসবে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, জ্বালানির ক্ষেত্রে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি আসবে। এগুলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমরা সমন্বয়ে যাবো। এরইমধ্যে আমরা কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে এসেছি। ডিজেল থেকে বেরিয়ে এসেছি।