ভিন্ন বেশে মাদকের ব্যবসা
সম্প্রতি চট্টগ্রামের পাহাড়ি মাদকচক্রের শতাধিক ব্যবসায়ীর তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তারা ভিন্ন বেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করছে। মাদকদ্রব্যের বাহকরা খাওয়া খরচ ও যাতায়াত ভাড়াসহ পাচ্ছে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। ডিবি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডিবি জানায়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে হাতিরঝিল থানাধীন পেয়ারাবাগ ও বড় মগবাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদকচক্রের অন্যতম সদস্য ডিপু চাকমাসহ আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার অপর দুজন হলেন আপেল বডুয়া ও মোমিন হাওলাদার। তাঁদের কাছ থেকে ১৬ হাজার পিস ইয়াবা, তিনটি মোবাইল ফোনসেট, একটি ব্যাকপ্যাকসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।
ডিপু চাকমা বৌদ্ধ পুরোহিতের বেশে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করে আসছিলেন।
তিনি খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলার আদর্শ বৌদ্ধ বিহারের প্রধান পুরোহিত।
আপেল বড়ুয়া শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী। তিনিও বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশে মাদক ব্যবসা করে আসছিলেন। ডিপু চাকমার অন্যতম সহযোগী তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যে তাঁদের আস্তানা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ডিবির লালবাগ বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক) মশিউর রহমান বলেন, ডিপুর সঙ্গে মিয়ানমারসহ বাংলাদেশের কোন কোন ইয়াবা ব্যবসায়ীর সম্পর্ক রয়েছে, বিস্তারিত জানতে তদন্ত চলছে। তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশে আরো যাঁরা মাদক ব্যবসা করছেন, তাঁদের বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে।
যেভাবে সক্রিয় পাহাড়িচক্র
ডিপু চাকমার দেওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ডিবি জানায়, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে কেউ সন্দেহ করবে না, এই সুযোগটাকে মাদক ব্যবসার কাজে লাগান তিনি। ভিক্ষুর বেশে তিনি কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান থেকে ইয়াবা বহন করে ঢাকায় নিয়ে আসতেন।
ডিবি সূত্র জানায়, এই চক্রে শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশধারী রয়েছেন অনেক। তাঁরা নিয়মিত হাজার হাজার পিস ইয়াবা ঢাকায় এনে সহযোগী মোমিন হাওলাদারের কাছে পৌঁছে দিতেন। পরে এগুলো বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় পাঠানো হতো।
গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে ঢাকায় ইয়াবা এনে বিক্রি করছিলেন। সম্প্রতি ডিবির কাছে তথ্য ছিল, মগবাজারে পার্বত্য অঞ্চল থেকে মাদকদ্রব্যের চালান আসছে। এর ওপর ভিত্তি করে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে যা জানিয়েছেন ডিপু
ডিবি সূত্র জানায়, ডিপু ২০১৫ রাঙামাটি রাজবিহার পালি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে পালি শাস্ত্রে পাঁচ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি দীক্ষা নেন পুরোহিত হওয়ার। পরেন কঠিন চীবর ও গেরুয়া বসন। বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন শেষে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন বৌদ্ধ বিহারের প্রধান হিসেবে এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। পরে যান খাগড়াছড়ি জেলা সদরে। সেখান থেকে বদলি হয়ে সর্বশেষ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানাধীন আদর্শ বৌদ্ধ বিহারের প্রধান হিসেবে দুই বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
২০১৬ সালে ভারতের মিজোরামের বৌদ্ধ ভক্তবৃন্দের আমন্ত্রণে রাঙামাটির বরকল-হরিণা সীমান্ত হয়ে বিএসএফের অনুমতি নিয়ে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই ভারতে যান তিনি। সেখানে ১২ দিন অবস্থান করে একই পথে একইভাবে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৯ সালে খাগড়াছড়ির পানছড়ির সীমান্ত দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যান তিনি। সেখানে আট দিন অবস্থান করে একই পথে একই কায়দায় দেশে ফিরে আসেন।
ডিবির তথ্য মতে, খাগড়াছড়ি জেলা সদরে থাকাকালে মোবাইল ব্রাউজিং করতে করতে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হন ডিপু। এক পর্যায়ে সর্বস্বান্ত হয়ে ইয়াবা ব্যবসায় নামেন। এরপর একটি চক্র গড়ে তোলেন তিনি।
ঢাকায় সক্রিয় পাঁচ হাজার মাদক ব্যবসায়ী
ঢাকায় বর্তমানে এলাকাভিত্তিক প্রায় পাঁচ হাজার মাদক কারবারি রয়েছেন। ২০২১ সালে যা ছিল সাড়ে তিন হাজার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
এসব মাদক ব্যবসায়ীর বেশির ভাগ ইয়াবা কারবারে যুক্ত। তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে প্রতিদিন বিক্রি হয় ১৫ লাখ ইয়াবা। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব তথ্য জানা গেছে বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
এর আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে বেশি বেচাকেনা হয় ইয়াবা। প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি হয়। রাজধানীতে সর্বাধিক ইয়াবা বেচাকেনা হয় মোহাম্মদপুর ও পল্লবীর জেনেভা ক্যাম্পে।
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ২০২৩ সালে সারা দেশে ৯৭ হাজার ২৪১টি মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ২০ হাজার ২৮৭ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে মাদকসংক্রান্ত ৮২ হাজার ৫০৭টি মামলা বিচারাধীন।