হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছে ইসি
হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করতে একযোগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদলির নির্দেশ দিয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই প্রথমবারের মতো নির্বাচনের আগে ঢালাও বদলির ঘটনা ঘটলো। ইসির নির্দেশনায় ইতোমধ্যে একজন ডিসিকে প্রত্যাহার এবং আরেকজনকে বদলি করা হয়েছে। এদিকে নির্বাচন এলাকায় সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে ইসির গঠিত নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ইতোমধ্যে অর্ধশত প্রার্থীকে শোকজও করেছে কমিটি।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রশাসনের বড় ধরনের কোনও রদবদলের পরিকল্পনা ছিল না কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের। কোথাও কেবল অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পেলে সেক্ষেত্রে বদলি ও প্রত্যাহার করা হবে— এমন অবস্থান ছিল এ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির। তবে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনাররা মাঠ প্রশাসন পরিদর্শন করে আসার পর সেই অবস্থান থেকে সরে আসে ইসি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে মতবিনিময়কালে ইউএনও এবং ওসিসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আসে। কোনও কোনও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় ইসির কাছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন পর্যায়ক্রমে সারা দেশের ইউএনও এবং ওসিদের বদলির সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে মনোনয়ন ফরম দাখিলের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও পুলিশের আইজি এবং জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন সিইসি। ওই বৈঠকের পরপরই কমিশন ওসিদের বদলির জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব এবং ইউএনওদের বদলির জন্য জনপ্রশাসন সচিবকে চিঠি দেয়। পৃথক চিঠিতে ইসি এক বছরের বেশি দায়িত্ব পালন করেছেন— এমন ইউএনও এবং ছয় মাসের বেশি দায়িত্ব পালন করেছেন— এমন ওসিদের পর্যায়ক্রমে বদলির নির্দেশনা দেয়। একইসঙ্গে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বদলির প্রস্তাব ইসিতে পাঠানোর জন্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবে তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসককে ময়মনসিংহ জেলায় দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সংসদ সচিবালয়ে সংযুক্ত এক উপসচিবকে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দুয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার ও বদলি করা হতে পারে। তাদের মধ্যে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তাও রয়েছেন। সূত্র আরও জানায়, পক্ষপাতিত্ব ও অনিয়মের অভিযোগ পেলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যেকোনও পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি ও প্রত্যাহারের নির্দেশনা অব্যাহত রাখবে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রভাবশালী সংসদ সদস্যসহ অর্ধশত প্রার্থীকে শোকজ করেছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে ইসির শোকজের মুখে পড়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ও জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও। তিনি এরইমধ্যে তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
সরকার দলের মনোনীত এক প্রার্থীর মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্যের দায়ে নরসিংদীর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর আগে তাকে আসামি করে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা থানায় মামলা করেন। নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীকের মনোনয়ন ফরম দাখিলের দিন এক কর্মীর প্রদর্শন করা অস্ত্রটির (শটগান) লাইসেন্স (নিবন্ধন) বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) নারায়ণগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল হক নড়াইল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এই চিঠি পাঠিয়েছেন। উল্লেখ্য, ওই শটগানের লাইসেন্স নড়াইল থেকে করা।
শনিবার (২ ডিসেম্বর) কয়েকজন প্রার্থীকে শোকজ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন, সিলেট-২ আসনে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী মো. ইয়াহইয়া চৌধুরী, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. মোহাম্মদ সাদিক, ঢাকা-২০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাদ্দেছ হোসেন, গাইবান্ধা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত আফরুজা বারী এবং একই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
এর আগে নির্বাচন পূর্ব সময়কালে (তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত) অনিয়ম তদন্তে গত ২৩ নভেম্বর ৩০০ নির্বাচনি এলাকার জন্য সহকারী জেলা জজ বা জেলা যুগ্ম ও দায়রা জজের সমন্বয়ে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে।
অবশ্য খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢালাওভাবে ইউএনও এবং ওসিদের বদলির বিষয়ে সব কমিশনার একমত ছিলেন না। দুই জন কমিশনার ঢালাও বদলির বিরোধিতা করেছিলেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল হবে না বলে ওই দুই কমিশনার গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন। ঢালাও রদবদলে সরকারের বড় অঙ্কের রাজস্ব ব্যয়ের বিষয়টি রয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর মন্তব্য করেছিলেন।
বদলি ও পদায়ন প্রশ্নে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘কমিশন চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, আমরা না চাইলে এখন কোনও বদলি হবে না। এছাড়া ময়মনসিংহের ডিসিকে আমরা প্রত্যাহার চেয়েছিলাম। নির্বাচন কমিশনাররা ঢাকার বাইরে সফরে গিয়ে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছেন। তার ভিত্তিতে পুলিশ ও প্রশাসনে রদবদল প্রয়োজন মনে বলে করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ কারণে রদবদলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
এর আগে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছিলেন, মাঠ প্রশাসনে বড় রদবদল করতে গেলে বিশৃঙ্খলা হবে। এর দায় কে নেবে। আর রদবদল করতে গেলে অনেক টাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত মতামত ছিল। কমিশনে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তিনি সেটাই বলতে পারেন। তিনি বলেন, ‘রদবদলের ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনও সুযোগ নেই। কারণ, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী উপজেলা বা জেলায় যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেখানে দায়িত্ব পালন করবেন।’
একযোগে ইউএনও ও ওসিদের বদলির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিষয়টি খুবই ইতিবাচক বলে তিনি মন্তব্য করেন। সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং ওসিদের বদলির সিদ্ধান্তটি খুবই ভালো উদ্যোগ। নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সহায়ক হবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। ভোটারদের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে।’
উল্লেখ্য, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী— উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের বদলি ও পদায়নে নতুন যিনি ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকায় তিনি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগের প্রজ্ঞাপনে কোনও ব্যক্তির পরিবর্তে পদের অনুকূলে নিয়োগ আদেশ জারি হওয়ায় নতুন করে আর প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজন হবে না।
ইসির তফসিল অনুযায়ী, ইতোমধ্যে বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম শুক্রবার থেকে বাছাই শুরু করেছেন। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বাছাই চলবে। এরপর রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ৫ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রতীক বরাদ্দ করবেন ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনি প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। আর ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি (রবিবার)।
এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। গত ২ নভেম্বর সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত ভোটার সংখ্যা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন। নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর হিজড়া ভোটারের সংখ্যা ৮৫২।