স্বতন্ত্র ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত কী করবে আওয়ামী লীগ?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল হয়েছে ৭৪৭টি। এর মধ্যে ৪৫০ জনের বেশি শুধু আওয়ামী লীগেরই। মোট প্রার্থীর এক চতুর্থাংশই স্বতন্ত্র। প্রতি আসনে গড়ে প্রার্থী হয়েছেন ৯ জন। এখন পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে হিসাব তাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়াইটা মূলত আওয়ামী লীগের। সার্বিক এ চিত্র নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ক্ষমতাসীন দলটি।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক কেন্দ্রীয় নেতা মানবজমিনকে জানান, ডামি প্রার্থী রাখার কৌশল মূলত ম্লান হয়ে পড়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চাপে। এ নিয়ে দলের উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কারণ সারা দেশের নির্বাচনী আসনগুলো থেকে দলীয় প্রার্থীদের অভিযোগ আসছে কেন্দ্রে। দলের হাইকমান্ড বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। এজন্য আপাতত দুটি কৌশলকে অবলম্বন করে এগোনো হচ্ছে।
এগুলো হচ্ছে-যারা নৌকা প্রতীক পেয়েছেন তাদেরকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নিজের নির্বাচনী এলাকায় দলীয় বিভেদ মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিতে। যারা আওয়ামী লীগ করে স্বতন্ত্র পদে দাঁড়িয়েছে তাদেরকে আপসের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করতে হবে। অন্য কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক শক্তি প্রয়োগ করবে। এর অংশ হিসেবে প্রথমে দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হবে। সে নোটিশের জবাব মনোপুত না হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে। এজন্য আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম-সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হবে। দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বার্তা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ঢালাওভাবে সবাই স্বতন্ত্র নির্বাচন করবে বিষয়টা এমন নয়। ১৬ তারিখ পর্যন্ত দলীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, এই কয়দিনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে কাজ করবে আওয়ামী লীগ। আসন বুঝে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নির্বাচনকে উৎসবমুখর ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন করতেই মূলত আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশল গ্রহণ করে। কারণ দলটির হাইকমান্ড মনে করে-স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই এবার নির্বাচনে ভোট আনার ক্ষেত্রে প্রধান বাহনে পরিণত হবে। তারাই যেন অধিকসংখ্যক ভোটার ভোট কেন্দ্রে আসে সেজন্য চেষ্টা করবে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন না আওয়ামী লীগের মনোনয়ন তালিকায় বাদ পড়া বর্তমান মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাদের কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের মুখে পড়তে পারেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে শিগগিরই এমন ঘোষণা দেয়া হবে।
বিএনপিসহ অনেক দল অংশ না নেয়ায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক দেখা দেয়। এবার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন চায় দলটি। গণভবনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এমন আভাস দেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। বিশেষ করে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ যেন নির্বাচিত হতে না পারে’ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যকে দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী হতে অনুপ্রেরণার জায়গা হিসেবে দেখেন নৌকা বঞ্চিতরা। এরপরই বিপত্তি বাধে। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে নৌকা বঞ্চিত মনোনয়নপ্রত্যাশীরা স্বতন্ত্র পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে থাকেন নানা মাধ্যমে। এ নিয়ে কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হক শামীমের সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগ নেতা খালেদ শওকত আলীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়েছে। দুপক্ষ থেকেই বিপুল পরিমাণ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় উভয় পক্ষের আহত হয়েছেন ৫ জন। এবার নির্বাচনে একটি স্বতন্ত্র বিপ্লব হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। কারণ প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে আওয়ামী লীগের বিকল্প প্রার্থী আছে এবং তারা নির্বাচনে শক্ত লড়াই করবেন সেটি নিশ্চিত। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এতসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী কখনো নির্বাচন করেনি।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, তিনশ’ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে তার সবগুলোতেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। যারা এলাকায় পরিচিত, জনপ্রিয় এবং দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিলেন। যে ৪৫০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তাদের মধ্যে সংসদ সদস্য আছেন ৬৩ জন। ফলে এই সংসদ সদস্যরা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এলাকায় আলাদা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। তাদের একটি আলাদা অবস্থান হবে। অন্যদিকে যারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ছিলেন তারাও এবারের নির্বাচনের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এসব বিষয় মাথায় রেখেই দুই কৌশলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করবে বলে জহানিেেছ আওয়ামী লীগের নেতারা। আগামী ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় থাকবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের। দলটির নেতারা মনে করছেন, সাংগঠনিক উপায়ে এ সময়ের মধ্যে দলের স্বতন্ত্র প্রার্র্থীর সংখ্যা ভারসাম্যপূর্ণ পর্যায়ে আনা হবে।