শুরুটা হজরত আলী (রা.)-এর একটি অমিয় বাণী দ্বারাই শুরু করি। জ্ঞানের দরজা হিসেবে সম্মানিত মহান এই সাহাবি বলেন, একটি দেশ রসাতলে চলে গিয়েছে তার নমুনা তিনটি। প্রথমত দরিদ্ররা ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত ধনীরা কৃপণ হয়ে যায়। তৃতীয়ত অযোগ্য, মূর্খ এবং চরিত্রহীনরা রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে। আজকের আলোচনায় দরিদ্রদের ধৈর্যহারা হওয়ার প্রেক্ষাপট, কারণ এবং পরিণতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।
মানবের সমাজ গঠন এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস যে কত পুরনো তা আজ অবধি কেউ নিখুঁতভাবে বলতে পারেননি। তবে রাজ্য-রাজা-রাজধানীর যে লিখিত ইতিহাস রয়েছে, সেখানে সাত হাজার বছরের দলিল-দস্তাবেজ দেখতে পাওয়া যায়। সমাজ গঠনের ইতিহাস আরও পুরনো- আর সভ্যতার প্রথম ধাপ আগুনের আবিষ্কার, পরিবার গঠন এবং কৃষিকাজের ইতিহাস কম করে হলেও ৫০ হাজার বছরের পুরনো। আদিকালে বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে তামাম দুনিয়া শাসিত হয়েছে নারীদের দ্বারা। আধুনিক বিজ্ঞানের এ তথ্য যদিও মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের বিরোধী। তবু নারী নেতৃত্বের সেই সমাজের অনেক সংস্কৃতি আমরা আজও বহন করে চলেছি।
আর্যরা যখন ভারতে এলো তখন সমাজের কাজকর্ম ঠিকঠাকমতো চালানোর জন্য সমাজকে যে চারটি ভাগে বিভক্ত করেছিল তা আজও নামে-বেনামে দেশবিদেশে প্রায় একইভাবে চালু রয়েছে। আর্যদের সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে ছিলেন ব্রাহ্মণরা। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা ছিল রাজাদের ওপরে। কারণ রাজারা দ্বিতীয় স্তরের ক্ষত্রিয় বংশজাত হতেন। তৃতীয় স্তরের বৈশ্য বা ব্যবসায়ীরা ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন শূদ্র। আদি থেকে আজ অবধি আপনি যদি সমাজে বসবাসরত জনসংখ্যার দিকে তাকান তবে ব্রাহ্মণ-ধর্মগুরু-দার্শনিক বা পণ্ডিত, রাজা-মন্ত্রী-আমির-ওমরাহ যোদ্ধা এবং ব্যবসায়ীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগের বেশি নয়। বাকি ৯০ ভাগ মানুষই খেটে খাওয়া আমজনতা এবং এই আমজনতার ৯০ ভাগই দরিদ্র এবং অর্ধেকের বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে।
আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের ৯০ ভাগ মানুষের পেশা, দৈনন্দিন কর্ম, আহার-নিদ্রা এবং শ্রমের ওপর বাকি ১০ ভাগ মানুষের হালহকিকত নির্ভর করে। ৯০ ভাগ মানুষ যদি ঠিকমতো শ্রম দিতে পারে। তাদের স্বাস্থ্য ও মনমানসিকতা যদি স্বাভাবিক থাকে তবে একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন-সমাজের সংহতি ও শান্তি অনিবার্য। সে ক্ষেত্রে তাদের মাথার ওপরে থাকা তিনটি শ্রেণির বিত্ত-বিলাস, আরাম-আয়েশের পথে বাধা থাকে না। আর তখন কবিদের মনে নিত্যনতুন কবিতার ছন্দ ডানা মেলে কলমের কালির মাধ্যমে সাহিত্যে পরিণত হয়। শিল্পীদের গলায় নিত্যনতুন সুর খেলা করে, নৃত্যশিল্পীদের পায়ে নূপুরের ঝংকার এবং ছবিকরদের রংতুলিতে মোনালিসা- দ্য লাস্ট সাপার, গোয়ারনিকার মতো চিত্রগুলো অমরত্ব লাভ করে।
শূদ্র শ্রেণির মানুষকে কীরূপে সুখী এবং কর্মক্ষম রাখা সম্ভব তার বহু সূত্র সেই আর্যদের কল্পনাতেই রচিত হয়েছিল। শূদ্রদের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাস এবং দক্ষতা অনুযায়ী কর্ম প্রদান এবং কর্মের বিনিময়মূল্য অর্থাৎ শ্রমের মূল্যে ন্যায়নিষ্ঠতা অনুসরণ ও তদারকের ভার ছিল ক্ষত্রিয়দের ওপর। বৈশ্যরা অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা যেন শূদ্রদের ঠকাতে না পারে, সে জন্য প্রশাসনযন্ত্রের সামরিক ও বেসামরিক শাখা সদা সতর্ক এবং সদা ব্যস্ততা দেখাত।
আমজনতার ভয়ে স্বয়ং রাজা তটস্থ থাকতেন। আর মনের সুখে শূদ্ররা জানালা দরজা খোলা রেখে দিন রাত পার করত। ১৭৫৬ সালের আগে বৃহত্তর বাংলার গ্রামগঞ্জের আমজনতার ঘরে বেশির ভাগ জানালা-দরজা খোলা থাকত। চুরি-ডাকাতি-লুটপাটমুক্ত ৯০ ভাগ আমজনতার ঘাম ও শ্রম দিয়েই কুতুবমিনার, লালকেল্লা, তাজমহল ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে।
আমজনতাকে নিয়ে যখন তাদের মাথার ওপরে থাকা ১০ ভাগ মানুষ অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম করেছে ঠিক তখনই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বৈশ্যরূপী অভিজাততন্ত্রের ওপর আসমানি ও জমিনি বালামুসিবত তৈরি হয়েছে। ব্রাহ্মণদের বুদ্ধিনাশ ঘটেছে। তারা ক্ষত্রিয় অর্থাৎ রাজা-সেনাপতি আমির-ওমরাহদের শাসন করার পরিবর্তে তাদের দাসত্ববরণ করেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বেশ্যায় পরিণত হয়েছে। ফলে ক্ষত্রিয়রা লাগামহীন হয়ে নিজেদের লোভলালসা, কামনাবাসনা ইত্যাদির কাছে তাদের বিবেকবুদ্ধি, দায়িত্বকর্তব্য, লাজলজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে হিংস্র পশুর চেয়েও ভয়ংকর প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। জমির লোভে তারা অন্য রাজ্য দখল- সম্পত্তির লোভে অন্যের সম্পত্তি হরণ, নারীর লোভে রাজ্য তছনছ ইত্যাদির পাশাপাশি নিজেদের অজ্ঞানতা, জিদ, দুর্বলতা ও অক্ষমতা ঢেকে রাখার জন্য অথবা ওগুলোকে শ্রেষ্ঠত্বে পরিণত করার জন্য শহর-বন্দর-জনপদ এবং জনগণকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
ক্ষত্রিয়রা লাগামহীন হয়ে প্রথম আক্রমণ চালায় বৈশ্যদের ওপর। ব্যবসায়ীরা রাজা-উজির-সেনাপতির লালসা মেটাতে গিয়ে আমজনতার ওপর জুলুম-অত্যাচার শুরু করে। তারা প্রথমেই শ্রমের মূল্য কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত শ্রমবাজারকে তছনছ করে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিশৃঙ্খলা, অসন্তোষ এবং অস্থিরতা পয়দা করে। তারপর শ্রমিক ঠকিয়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে চুরি-ডাকাতি করে হলেও ক্ষত্রিয়দের লোভ-লালসার রসদ জোগায়। এর ফলে বৈশ্যরা আর বৈশ্য থাকে না। তারা রীতিমতো লুটেরা শ্রেণিতে পরিণত হয়।
সমাজের ঊর্ধ্বস্তরের তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কীভাবে বিপত্তি শুরু হয় তা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কখনো দেখা গিয়েছে, অযোগ্য লোক রাজাসনে বসেছে। তাকে কেন্দ্র করে কোনো এক ধড়িবাজ বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিবৃত্তিক অপকর্ম দ্বারা বিপত্তি বাধিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে রাজা নিজে পুরোহিত হওয়ার চেষ্টা করেছে এবং তার বুদ্ধিদাতা শ্রেণিকে বিনাশ করার জন্য রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করেছে। ফলে জটিল মুহূর্তে রাজাকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাকে সুপরামর্শ দেওয়ার মতো মুক্তবুদ্ধির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জ্ঞানীগুণীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। রাজার নিজের দুর্বৃত্তপনার বাইরে তার মন্ত্রী-আমলা-কামলার দুর্বৃত্তপনা যখন বেড়ে যায় তখন রাজা স্বয়ং দুর্বৃত্তদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রে শাসনব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে এবং অফিস-আদালত ও কোর্ট-কাচারিতে অন্যায়-অবিচার-জুলুম-ঘুষ দুর্নীতি ইত্যাদি ডাল-ভাতের মতো হয়ে যায়। ফলে আমজনতা পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
সাধারণ জনগণ অর্থাৎ খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগণ যখন রাষ্ট্রের ওপর কিংবা সমাজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তখন তাদের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা-অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে দরিদ্র মানুষের সাধারণ কতগুলো বৈশিষ্ট্য আলোচনা আবশ্যক। স্বাভাবিক অবস্থায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রচণ্ড দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম করতে হয়। ফলে নিজেদের মৌলিক চাহিদা বিশেষত অন্ন ও বস্ত্রের সংস্থানের বাইরে তারা তেমন কিছু চিন্তাভাবনা করে না। এই শ্রেণির মানুষ সাধারণত নিয়তিনির্ভর, বেহিসেবি, উদাসীন, আমোদপ্রিয় এবং অবসরে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদপ্রবণ হয়ে থাকে। তারা একধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং সমাজের ধনী ব্যবসায়ী, আমলা, কামলা, নেতা, রাজা-উজিরদের প্রতি সহজাত আনুগত্য প্রকাশ করে এবং সামনাসামনি হলে প্রকৃতিগতভাবে সম্মান প্রদর্শন করে।
আমজনতার উল্লেখিত সাধারণ বৈশিষ্ট্য তখনই নষ্ট হয় যখন তাদের কাজ থাকে না- পেটে ভাত থাকে না এবং হাতে অখণ্ড অবসর থাকে। এ অবস্থায় তারা নিয়তির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং নিজেদের শ্রেণি চরিত্রের বাইরে গিয়ে সমাজের অপরাপর শ্রেণি-পেশার লোকজন সম্পর্কে খোঁজ নিতে থাকে। তারা তখন ধনিক-বণিক, আমলা-রাজা-উজির-সেনাপতিদের বিত্তবৈভব, মেদ-ভুঁড়ি, পোশাক-আশাক, গাড়ি-বাড়ি, খানা-খাদ্য-আনন্দ-ফুর্তি ইত্যাদির উৎস খুঁজতে থাকে। দ্বিতীয়ত তারা যখন তাদের ঊর্ধ্বতন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মধ্যে মানবিক সত্তার শ্রেষ্ঠত্বের পরিবর্তে নিকৃষ্টতা দেখতে পায় এবং তাদের ওপর ছড়ি ঘোরানো সম্প্রদায়ের দুর্বলতা-অযোগ্যতা বুঝতে পারে তখন তারা ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে।
আমজনতা ধৈর্যহারা হয়ে পড়লে সবার আগে তারা শ্রমের চাকায় গতি কমিয়ে দেয়। কর্মের চেয়ে অলসতাকে বেশি ভালোবাসতে থাকে। ফলে তাদের চিরায়ত ও অভ্যাসগত আনুগত্য বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে রূপ নেয়। অবসরে তারা সাধারণ আনন্দ-ফুর্তি করে অথবা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে সময় পার করে। তাদের এ অভ্যাসটি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়ে যায়। ধৈর্যহারা দরিদ্র জনগোষ্ঠী কাজকর্ম ফেলে রাজার ত্রুটি খোঁজে। ব্রাহ্মণদের গালাগাল করে এবং বৈশ্যদের আক্রমণ করে তাদের বিত্ত-বিলাস তছনছ করে দেয়।
দেশের ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য কারোর হাতে থাকে না। এতক্ষণে জনযুদ্ধ বা সিভিল ওয়ার অনিবার্য হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে সিভিল ওয়ারের ফলে দুর্ভিক্ষ-মহামারির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কীভাবে দেশ-জাতির সর্বনাশ ঘটায় তা অর্থনীতিবিদরা অঙ্ক কষে মানবজাতির জন্য দলিল আকারে লিখে গেছেন। আর জনযুদ্ধ মারামারির পর কীভাবে দেশীয় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা সমূলে বিনাশ হয় এবং বিদেশি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা কীভাবে নতুন ইতিহাস রচনা করে তার ভূরি ভূরি ইতিহাস তামাম দুনিয়ার অলিগলি, দেয়াল-পাহাড়-পর্বতে কীভাবে খোদাই করা আছে, তা আমরা কমবেশি সবাই জানি।
গোলাম মাওলা রনি
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন