ইউক্রেনে রাশিয়ার অগ্রসরতা থমকে গেছে। তাদের অপরিমেয় সম্পদ ও লোক ক্ষয় হচ্ছে। এই হতাশা থেকে ভাড়াটে সেনা দল ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোসিন রাশিয়ার অর্থনীতিকে পুরোপুরি যুদ্ধের অর্থনীতিতে রূপান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রিগোসিন বলেছেন, ক্রেমলিনের এখন যোদ্ধা জোগাড়ের নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হবে। সামরিক শাসন জারি করতে হবে এবং দেশের গোলাবারুদ উৎপাদন প্রচেষ্টায় ‘সম্ভাব্য সবাইকে’ জোর করে কাজে লাগাতে হবে। নতুন সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ আমাদের অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমাদের শুধুই যুদ্ধের জন্য কাজ করতে হবে।
প্রিগোসিনের এ বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সম্প্রচারমাধ্যম আরটির প্রধান মার্গারিটা সিমোনিয়ানের বক্তব্যে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রভাবশালী এই সমর্থক সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমাদের লোকজন তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন এবং প্রতিদিনই তাঁদের রক্ত ঝরছে। আমরা এখানে ঘরের মধ্যে বসে আছি। আমাদের সামরিক শিল্প যদি ঠিকঠাক না চলে, তাহলে আমাদের সবাইকে কাজে হাত লাগাতে হবে। সবাইকে জিজ্ঞাসা করুন, আমরা কি আমাদের কাজ শেষে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে সময় দিতে পারি না?’
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ভূখণ্ড নিজেদের আওতায় নেওয়ার পর থেকেই রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের কঠোর অর্থনৈতিক শাস্তির কারণে একটা কাটছাঁটের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
এরই মধ্যে ভ্লাদিমির পুতিন যে ঝটিকা, বিশেষ সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা এঁটেছিলেন, তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। সেই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
দ্য ইকোনমিস্টের হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, সামরিক খাতে এক বছরে রাশিয়ার ব্যয় হচ্ছে ৫ ট্রিলিয়ন রুবল (৬০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার)। এটা দেশটির জিডিপির ৩ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে দ্য ইকোনমিস্ট এটিকে ‘ক্ষুদ্র অঙ্ক’ বলেছে। যদিও জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেসন্সের (জিডিএপি) হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, বছরে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় ৯০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির জিডিপির ৫ শতাংশ।
রাশিয়ার আমদানির উৎস সংকুচিত হয়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাজারে অনেক পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। সাধারণ রুশ নাগরিকেরা, যুদ্ধক্ষেত্রে যাঁরা তাঁদের স্বজনদের হারাচ্ছেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত তাঁদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে তুলনামূলকভাবে শান্ত রয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে সংঘাত যত তীব্র হবে, ততই অর্থনীতিকে যুদ্ধের অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অনেক সংকট একসঙ্গে এসে হাজির হবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ভাবে আঘাত করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে দেশটি বাধার মুখে পড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা ও বিদেশি পণ্য আর সহজলভ্য নয়। অস্ত্র তৈরির উপকরণ ও গোলাবারুদ তৈরির উপাদান ঘাটতিতে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে টান ধরেছে।
এ কারণে ক্রেমলিন এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে যে তাদের যেকোনো একটি বিকল্প বেছে নিতে হবে। এক, যুদ্ধে সর্বাত্মক ঝাঁপিয়ে পড়া, যাতে করে একটা নিষ্পত্তিতে আসা যায়। অথবা দুই. পাল্টাপাল্টি আঘাতের যুদ্ধ চলিয়ে যাওয়া। পরেরটির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের আশা শেষ করে দেবে, কেননা দেশে দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আন্তর্জাতিক সমর্থন নড়বড়ে হয়ে যাবে।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী মন্ত্রী জেমস হেপ্পির হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৯০০ ট্যাংক, ৩ হাজার ৩০০ সাঁজোয়া যান, ৭৩টি নৌকা, কয়েক শ মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজ, ৭৮টি হেলিকপ্টার, ৫৫০ টিউব আর্টিলারি সিস্টেম, ১৯০টি রকেট আর্টিলারি সিস্টেম ও ৮টি নৌযান খুইয়েছে।
রাশিয়ার সামরিক শিল্পকে এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, উচ্চ প্রযুক্তির নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম অস্ত্র উৎপাদন। কেননা, এ ধরনের অস্ত্রের জন্য যে প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেটা অন্য দেশ থেকে আনতে হয়।
নিষেধাজ্ঞার কারণে এ ধরনের প্রযুক্তি মস্কোর হাতে আসছে না। কিংবা যা আসছে, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। রাশিয়ার সেনাবাহিনী যেসব উচ্চ প্রযুক্তির বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম ব্যবহার করে, সেগুলোর উৎপাদন হয় যুক্তরাষ্ট্রে।
এ কারণে নিজ দেশে তৈরি নিম্নমানের বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হচ্ছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে। যুদ্ধে উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্রে ব্যবহারে সে কারণেই মিতব্যয়ী রাশিয়া। কিন্তু প্রথাগত যেসব গোলাবারুদের ওপর রাশিয়াকে নির্ভর করতে হচ্ছে, সেগুলোর মজুতও কমে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের হিসাব হলো, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ছয় হাজারের বেশি সামরিক সরঞ্জাম প্রতিস্থাপনের সক্ষমতা কমে গেছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি করতে না পারায় উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ কারণে ট্যাংক, উড়োজাহাজের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে অনুযায়ী, রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের সহসভাপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ ২০২৩ সালে ১ হাজার ৫০০ ট্যাংক উৎপাদনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। রুশ গণমাধ্যম তাসে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ড্রোনের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা বলেছেন মেদভেদেভ।
রাশিয়ার সরকার অস্ত্র উৎপাদকদের বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে। ব্যাংকগুলোকেও বড় ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। দেশটির সরকারি নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিনিশড ধাতব পণ্যের’ উৎপাদন ২০ শতাংশ বেড়েছে।
জানুয়ারি মাসের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার বেশ কয়েকটি অস্ত্র কারখানায় তিন শিফটে উৎপাদন চলছে। কর্মীদের আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে।
একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে যে অর্থনীতিকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না করে সামরিক উৎপাদনে অর্থের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জনগণের বড় অংশের সমর্থন উঠে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে এ বছরে রাশিয়ার অর্থনীতি শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ (যুক্তরাজ্যে প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি হবে। এই পূর্বাভাস বলছে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে জ্বালানি বাণিজ্য থেকে বড় অঙ্কের আয় করে চলেছে রাশিয়া।
কিন্তু এর মধ্যে রাশিয়ার আমদানির উৎস সংকুচিত হয়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে বাজারে অনেক পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
সাধারণ রুশ নাগরিকেরা, যুদ্ধক্ষেত্রে যাঁরা তাঁদের স্বজনদের হারাচ্ছেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত তাঁদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে তুলনামূলকভাবে শান্ত রয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে সংঘাত যত তীব্র হবে, ততই অর্থনীতিকে যুদ্ধের অর্থনীতিতে রূপান্তর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অনেক সংকট একসঙ্গে এসে হাজির হবে।
লেখা:ক্রিস্টফ ব্লুথ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন