সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে এক সহকর্মীর সঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হাসান আলী। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার এসকেএফ টাওয়ার সামনে যেতেই একটি সংঘবদ্ধ চক্র তাকে ঘিরে ধরে। প্রথমে তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করে। এরপর তার পকেটে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় একটি ইয়াবার প্যাকেট। মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত হন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই আবু ঈসা। তাৎক্ষণিক হাসান আলীকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় শিল্পাঞ্চল থানায়। স্বজনরা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে হাসান আলীকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়েছে পুলিশ। তাদের ধারণা, অফিসের চাকরিচ্যুত দুই সাবেক সহকর্মী পুলিশের সহায়তায় এই নাটক সাজিয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ছয়টার দিকে।
আলোচিত এই ঘটনাটি নিয়ে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে তোলপাড় চলছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী ইতোমধ্যে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তেজগাঁও থানা পুলিশের একটি দল অভিযানে গিয়ে ওই ব্যক্তিকে (হাসান আলী) ধরে এনেছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে। তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে।
তবে পুলিশের ডিসি ইবনে মিজান, গ্রেফতারকারী এসআই আবু ঈসা এবং মামলার এজাহারে তথ্যের ব্যাপক গড়মিল পাওয়া গেছে। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি ইবনে মিজান অভিযানের কথা বললেও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই আবু ঈসা জানান, তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এক ব্যক্তি হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে দৌড়ে এসে তাকে ৪-৫ জন মারধর করছে বলে জানায়। পরে ওই ব্যক্তি পেছনের পকেট থেকে একটি পোটলা বের করে দেয়। সেই পোটলায় ১৯৩ পিস ইয়াবা ছিল বলে এসআই আবু ঈসা জানান। কিন্তু মামলার এজাহারে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাধারণ জনগণ একজন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক করেছে বলে জানার কথা উল্লেখ করা হয়।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসআই আবু ঈসা বলেন, লোকটাকে আমারও নিরাপরাধ মনে হয়েছে। এবং প্রাথমিক তদন্তে তার অফিসের সাবেক সহকর্মীর সঙ্গে বিরোধের তথ্যও তিনি পেয়েছেন। কিন্তু যেহেতু ইয়াবা পকেট থেকে পাওয়া গেছে এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি মামলা দায়ের করেছেন।
সেদিন এসকেএস ভবনের সামনে তার ডিউটি ছিল কিনা জানতে চাইলে এসআই আবু ঈসা জানান, সেদিন তিনি কুইক রেসপন্স টিমের সদস্য ছিলেন। কুইক রেসপন্স টিম তো থানায় থাকার কথা, জানালে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, সোর্সের মাধ্যমে খবর পেয়েছিলেন।অনুসন্ধান বলছে, ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো এই চক্রের সঙ্গে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি দলও যুক্ত রয়েছে। তেজগাঁও বিভাগের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার নির্দেশে ইয়াবা পকেটে দিয়ে এই মামলা সাজানো হয়।
আলোচিত এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার রহমান রেগনাম সেন্টার ভবনে থাকা অফিস থেকে বের হচ্ছেন হাসান। সঙ্গে দুই সহকর্মী বাশার ও ইমাম হোসেন। তিন জন এসকেএস স্কাই ভবনের ফুটপাত ধরে হেঁটে পুলিশ প্লাজার দিকে যাচ্ছিলেন। হাসান অফিস থেকে বের হওয়ার পর তার পিছু নেয় অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি। হাসান হেঁটে এসকেএস স্কাই ভবনের সামনে গেলে আচমকা চারদিক থেকে ৮-১০ জন লোক তাকে ঘিরে ধরে। এরপর কিল-ঘুষি দিতে থাকে। হালকা গড়নের এক ব্যক্তি হাসানের পকেটে একটি ছোট ‘প্যাকেট’ ঢুকিয়ে দেয়।
তবে পুলিশের দায়ের করা এজাহারে ঘটনার সময় রাত পৌনে ১২টার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই আবু ঈসা কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও হাসানের সহকর্মী ইমাম হোসেন জানান, কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেখানে হাজির হন। আবু ঈসা নামে একজন এসআই ছিলেন পোশাক পরে। পুলিশ সদস্যরা জোর করে হাসানকে গাড়িতে তুলে ফেলেন। আর সঙ্গে থাকা লোকগুলোও সটকে পড়েন। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় হাসানের পকেটে ইয়াবা পাওয়া গেছে।
এদিকে হাসানকে আটকের খবর পেয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ছুটে যান সহকর্মী ও স্বজনেরা। হাসানকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলেন স্বজনেরা। থানা পুলিশ দায় এড়িয়ে ডিসি বিষয়টি দেখছেন বলে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। হাসানের মামা সরকারি কর্মকর্তা কামরুজ্জামান মধ্যরাতে ছুটে যান ডিসির কাছে। প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে সন্দেহভাজন কিছু না মনে হওয়ায়, পরের দিন ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে হাসানকে ছেড়ে দেবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন।
স্বজনরা জানান, ঘটনার পর দিন গত সোমবার সকালে তেজগাঁও জোনের এডিসি ও এসি হাসানকে ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর মধ্যে তারা হাসানের পিসিপিআর, মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন, মোবাইল কললিস্ট, শিক্ষা-কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই করেন। তবে পুলিশ তার বিষয়ে সন্দেহজনক কোনও কিছু পায়নি বলেও স্বজনদের জানায়। এরপর হাসানকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য একটি মুচলেকাও লেখা হয়। থানার পরিদর্শক তদন্তের কক্ষে বসে সেই মুচলেকা লেখা হয়। এসআই আবু ঈসা জিম্মানামায় উল্লেখ করেন, ‘কতিপয় লোক এক ব্যক্তিকে আটক করেছে খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে হাসানকে সুস্থ অবস্থায় পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হলো।’ হাসানকে যখন পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, তখনই এসআই ঈসার কাছে একটি ফোন আসে। এরপর হাসানকে মুক্তি না দিয়ে ইয়াবার মামলা দিয়ে চালান দেওয়া হয়।
হাসানের স্বজনদের অভিযোগ, এক কক্ষে জিম্মানামা নিতে ব্যস্ত রেখে অন্য কক্ষে হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দেন তেজগাঁও বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা। আলোচিত এই বানোয়াট মামলায় নাঈম এসকেএস স্কাই বিল্ডিংয়ের একজন নিরাপত্তাকর্মীকে সাক্ষী বানানো হয়। নাইম জানান, ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ভবনের সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখেন। তবে সেখানে কী হয়েছে সেটা তিনি জানতে পারেননি। পরে ৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশের একটি দল তার কাছ থেকে সাদা কাগজে একটি সই নিয়ে যায়। তিনি নিজে ইয়াবা উদ্ধার করতে দেখেননি।
এদিকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ ওঠার পর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে হাসানের পরিবারের সদস্যদের হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি জানাজানি হলে, ভবিষ্যতে হাসানের এই মামলায় ক্ষতি হবে বলে হুমকি দেন তিনি।