Image description

অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভিআইপি চলাচলের সুবিধা করে দিতে রাস্তায় সাধারণ মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা বা কোনো অনুষ্ঠানে ভিআইপিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে উপস্থিত বাকি অতিথিদের বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলার মতো ঘটনাগুলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে একেবারেই নিয়মিত বিষয়।

ভিআইপিদের জন্য কম খরচে গাড়ি-বাড়ির সুবিধা দেয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে আলাদা সুবিধা রাখা, নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা রাখার মতো বিভিন্ন রীতি নিয়ে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলে নানা সময়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

সম্প্রতি একই ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কয়েকজনও।

খনন কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়া উপদেষ্টাদের লাল গালিচায় নামা এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার নেয়ার পর উপদেষ্টার পেছনে একজন অধ্যাপকের দাঁড়িয়ে থাকার ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।

ড. মুহম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পর শুরুর দিকে তার গাড়িবহর রাস্তায় চলাচলের সময় জনসাধারণের যাতায়াতে বাধা দেয়া হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার গাড়িবহরের ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার ছবি আর খবরও সেসময় প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা চলাচলের সময় বরাবরের মতোই রাস্তা আটকে দেয়া হয় সাধারণের জন্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে এতদিন ধরে চলমান প্রথা, রীতিনীতি সংস্কার করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু উপদেষ্টাদের কয়েকজনের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে প্রশ্ন উঠছে, উপদেষ্টারা কি চিরাচরিত প্রথাগত সেই ভিআইপি সংস্কৃতিই কার্যত ফিরিয়ে আনছেন?

সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন ভিআইপি সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমাজ থেকে কখনোই পুরোপুরি চলে যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সামিনা লুৎফার মতে, বর্তমান সরকারের সদস্যরা গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সরকার বলে তাদের কাছ থেকে মানুষের আশা বেশি।

"তারা (অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা) যেই যুগের অবসান ঘটানোর জন্য ক্ষমতায় গেছেন, সেই যুগের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করবেন – অন্তত ছোট ছোট করে হলেও তাদের কাজে প্রমাণ চাচ্ছি," বলছিলেন সামিনা লুৎফা।

"তবে আমরা এখনো তাদের চেষ্টার যথেষ্ট ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না।"

ভিআইপিদের চলাচলের সময় জনসাধারণের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়ায় ঢাকায় প্রায়ই দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ভিআইপিদের চলাচলের সময় জনসাধারণের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়ায় ঢাকায় প্রায়ই দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়

'লাল গালিচা'য় উঠে খননকাজের সমালোচনা

রবিবার মিরপুরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি খাল খনন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে যান অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টা।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ছিলেন সেখানে।

অনুষ্ঠান উদ্বোধনের সময় তারা পানিতে ভাসমান একটি এক্সকাভেটরে ওঠেন।

উপদেষ্টাদের এক্সকাভেটরে ওঠার পথটিতে বিছানো ছিল লাল গালিচা। আর এই লাল গালিচা থাকা নিয়েই তৈরি হয় সমালোচনা।

অনুষ্ঠান উদ্বোধন শেষে উপদেষ্টারা যখন উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন, তখন একজন সাংবাদিক লাল গালিচা থাকার কারণ জানতে চান। উপস্থিত উপদেষ্টারা তাৎক্ষণিকভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।

তবে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ পরবর্তীতে তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাল গালিচা থাকার কারণ তুলে ধরে একটি পোস্ট দেন। ওই পোস্টে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি বিবৃতিও সংযুক্ত করেন।

সিটি কর্পোরেশন তাদের বিবৃতিতে জানায় যে এটি 'আনুষ্ঠানিক লাল গালিচা নয়, বরং নিরাপত্তার স্বার্থে রাখা একটি ব্যবস্থা।'

এক্সকাভেটরটি অস্থায়ী পন্টুনে রাখা থাকায় এবং সেখানে ওঠার রাস্তা 'অনেক ঢালু ও কাদামাটির' হওয়ায় ও এক্সক্যাভেটরের 'ফ্লোর পিচ্ছিল' থাকার কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে 'লাল রঙয়ের কার্পেট সদৃশ ম্যাট' ব্যবহার করা হয়েছে বলে উঠে আসে ডিএনসিসির বিবৃতিতে।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ব্যক্তিগত প্রেস সচিব মাহফুজ আলম জানান, কার্পেটের রং লাল হওয়ার কারণে ঘটনাস্থলেই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ডিএনসিসির কর্মকর্তাদের কাছে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

তবে ডিএনসিসি বিবৃতি দিয়ে বা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিষয়টি ঘিরে সমালোচনা ও ট্রল কমছে না।

এ বিষয়ে আসিফ মাহমুদ, রেজওয়ানা হাসান ও আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাদের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বাংলা একাডেমির বার্ষিক পুরস্কার পাওয়া লেখকদের সাথে উপদেষ্টাদের একটি ছবি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হয়েছে

ছবির উৎস,পিআইডি

ছবির ক্যাপশান,বাংলা একাডেমির বার্ষিক পুরস্কার পাওয়া লেখকদের সাথে উপদেষ্টাদের একটি ছবি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হয়েছে

পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানের ছবি নিয়ে বিতর্ক

পহেলা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বার্ষিক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে পুরস্কার পাওয়া লেখকদের সাথে উপদেষ্টাদের একটি ছবি নিয়ে বেশ সমালোচনা তৈরি হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

ছবিতে পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তিদের চেয়ারে বসে থাকা উপদেষ্টাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, যে বিষয়টি ভালোভাবে নেননি অনেকে।

ছবিতে দেখা যায় যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক সলিমুল্লাহ খান পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী তার সামনে বসে আছেন, যে বিষয়টি মূলত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে ছবিতে কোনো অসঙ্গতি না থাকলেও দাঁড়িয়ে থাকা একজন সিনিয়র শিক্ষক ও লেখকের সাথে উপদেষ্টা মি. ফারুকীর চেয়ারে বসা ছবিটি বাংলাদেশের 'সামাজিক রীতিবিরুদ্ধ' ও উপদেষ্টাদের 'ক্ষমতার প্রদর্শন' বলে অভিযোগ ওঠে সামাজিক মাধ্যমে।

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান রবিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় ওই ঘটনার সমালোচনা করে বলেন, "যারা পুরস্কার পেয়েছে তারা পেছনে দাঁড়িয়েছে, লোকজন আমাকে বলেছে আপনারা পুরস্কার নিলেন কেন। পুরস্কার নেয়ার পরই তো বেইজ্জতটা করলো!"

মি. খান ওই অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন যে অনুষ্ঠানে সামনের চেয়ারে যারা বসেছে 'তারা ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বসেছে।'

সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মি. ফারুকী তার ফেসবুক পেজে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে পোস্ট করেন যে, "গ্রুপ ফটো সেশনের রেয়াজ এ বছরের একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান থেকে আর রাখা হবে না।"

আন্দোলনের মুখে পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দায়িত্ব নেন

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,আন্দোলনের মুখে পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা দায়িত্ব নেন

প্রধান উপদেষ্টার চলাচলে 'ভিআইপি প্রটোকল' প্রসঙ্গ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেয়ার পর শুরুর দিকে চলাচলের ক্ষেত্রে ভিআইপি প্রটোকল নিলেও তার গাড়িবহরের জন্য জনসাধারণের চলাচল বন্ধ করা হতো না। তবে বর্তমানে তার গাড়িবহর চলাচলের সময় বন্ধ করে দেয়া হয় রাস্তায় যান চলাচল।

আবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনের সড়ক রাতে জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকে।

দেশের সড়ক পরিস্থিতি সংক্রান্ত ফেসবুক গ্রুপগুলোতে এই নিয়মকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলের রেওয়াজ বলে উল্লেখ করে সমালোচনা করতে দেখা গেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে প্রতি রাতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের তিন পাশের রাস্তা সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেয়া হতো।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র তালেবুর রহমান অবশ্য জানান, রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসার সামনের রাস্তা রাতে জনসাধারণের চলাচলের জন্য বন্ধ থাকে না।

আর ভিআইপি প্রটোকল সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি জানান, ভিআইপিদের নিরাপত্তা দেয়া সংক্রান্ত বিধি মেনেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে পুলিশ।

তালেবুর রহমান বলেন, "ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সুনির্দিষ্ট বিধি রয়েছে। সেই বিধি অনুসারেই নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। কারো জন্য বেশি কিছু করা হয়নি।"

'আরেকবার প্রতারণার শিকার হতে চাই না'

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীলরা তাদের কার্যক্রমের দ্বারা এখন পর্যন্ত মানুষের আশা পূরণ করতে পারেননি।

সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সামিনা লুৎফা বলছিলেন, "এই সরকারের অনেকে আগের সরকার বিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় ছিলেন এবং আগের সরকারের অনেক দমন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তারা আগের সরকারের ভিআইপি সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে পারবেন এবং আগের ফর্মুলা না মেনে পুরনো রীতি ভাঙতে পারবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।"

তিনি বলছিলেন বর্তমান সরকারের কাছ থেকে 'তড়িৎ পদক্ষেপ' আশা করা হলেও তারা তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

"বাংলাদেশের মানুষ এতবার রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে প্রতারিত হয়েছে যে আমরা এখন অল্পতেই ভয় পাই। আমরা আরেকবার প্রতারণার শিকার হতে চাই না, এটা তাদের মনে রাখা প্রয়োজন।"