Image description

ফেনীর মুহুরী সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পে অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হয়েছে লুটপাট। এ যেন পুকুর নয়, সাগরচুরির গল্প। নিজ দেশে দেউলিয়া জার্মানির একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে এ প্রকল্পের ঋণের কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়ে পালিয়েছে। এর ফলে কৃষকের কাজে আসছে না ৫৫০ কোটি টাকার এ প্রকল্প।

এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ৫৬২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেও কৃষকরা বলছেন কোনো কাজেই আসছে না। মাঠে অবকাঠামো থাকলেও স্কিমগুলো অকেজো হয়ে আছে। গত আগস্টের বন্যাকে দায়ী করছেন কর্তৃপক্ষ। পানির অভাবে মাঠ এখন শুকিয়ে চৌচির। কৃষকরা আবাদ করতে পারছে না ধানসহ অন্যান্য ফসল।

প্রকল্পের তথ্য মতে, বৈদ্যুতিক পাম্পের সাহায্যে প্রিপেইড মিটার ব্যবস্থায় ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের মাধ্যমে খাল থেকে জমিতে সেচের পানি সরবরাহ পদ্ধতি চালু করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ফেনীতে মুহুরী সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মাঝে করোনার কারণে বছর দুয়েক কাজ বন্ধ থাকে। ২০২৪ সালের জুনে কাজ শেষ হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির ৫৬২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা অর্থায়নে এ প্রকল্পের ৯টি প্যাকেজের মাধ্যমে এ প্রকল্পে কাজ করে। ফেনী জেলার পাঁচটি উপজেলা ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৬ ও ৭ নম্বর প্যাকেজের প্রাক্কলিত মূল্যের ১৩ শতাংশ বেশি মূল্যে প্রায় ১৫৭ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার কাজ পান জার্মানির লুডভিগ ফাইফার হোচ-উন্ড টিফবাউ জিএমবিএইচ অ্যান্ড কোম্পানি কেজি নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

ফেনীর মুহুরী সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের ৫৩৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ভূগর্ভস্থ পাইপলাইনের ৮৫০টি স্কিমের মধ্যে হস্তান্তর হয়েছে ৩৩৭টি স্কিম। এর মধ্যে চালু হয়েছে মাত্র ২৬৮টি। যেগুলো চালু হয়েছে সেগুলোর সিংহভাগই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রকল্পের ৬ ও ৭ নম্বর প্যাকেজে ফেনীর পাঁচটি উপজেলা ও চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এ পর্যন্ত সেচ সুবিধা পেয়েছে মাত্র ৩ হাজার হেক্টর।

প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী এক নম্বর গ্রেডের ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন নম্বর গ্রেডের ইট দিয়ে গাঁথুনি ও কংক্রিট দিয়ে ঢালাই কাজ করা হয়। কিছু জায়গায় ছাদ ঢালাইয়ের কাজে পাথরের পরিবর্তে নিম্নমানের কংক্রিট দিয়ে ঢালাই কাজ সম্পন্ন করা হয়। ভিটি বালূ দিয়ে প্লাস্টার, গাঁথুনি এমনকি ঢালাইয়ের কাজও করেছেন তারা। কোথাও সিলেকশন বালির ব্যবহার হয়নি। নিম্নমানের ইউপিভিসি পাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। ভ‚গর্ভস্থ পাইপের দুই পাশে ও নিচে ৬ ইঞ্চি ওপরে ১২ ইঞ্চি বালি দেওয়ার কথা। মাঠে ড্যামেজ পাইপ ও ওয়েস্টেজ পাইপের টুকরা আগুনে পুড়িয়ে জোড়াতালি দিয়ে স্কিম নির্মাণের ঘটনাও রয়েছে।

স্কিমের নির্ধারিত দৈর্ঘ্যের কম পাইপ স্থাপন করে বাড়তি দৈর্ঘ্য দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়। যার কারণে পানির ওভার ফ্লো হচ্ছে এবং স্কিমের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ডিস্ট্রিবিউশন বক্সে অন্তত ৬০ শতাংশ রড কম ব্যবহার করে ১০০ শতাংশ রডের বিল উত্তোলন করেছে। যেকোনো একটি ডিস্ট্রিবিউশন বক্স চেক করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ছাদে কার্যাদেশের চেয়ে ৫০ শতাংশ রড কম ব্যবহার করেছে- যা প্রকল্পের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে।  নির্মাণকাজে কার্যাদেশ অনুযায়ী রড ব্যবহার না করে নিম্নমানের স্ক্র্যাপ রড, বাংলা রড ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ তদারকির কথা থাকলেও তা হয়নি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পের ৬ ও ৭ নম্বর প্যাকেজের আওতায় ১৫৭ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার মধ্যে ১৩৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার পর সরকারের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের জামানতের পরিমাণও প্রায় ১৬ কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সবশেষ জমা বিলের প্রায় ১৭ কোটি টাকা দেওয়া হলে সরকারের কাছে অবশিষ্ট থাকবে প্রায় ছয় কোটি টাকা। যা জামানতেরও কম।

সরেজমিনে দেখা যায়, অবকাঠামোর অস্তিত্ব ঠিক থাকলেও পানি সরবরাহের অধিকাংশ স্কিমই অকেজো। কোথাও বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার নেই আবার কোথাও নেই মিটার। ফেনী সদর উপজেলার কালিদহে কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছে- উঠছে না পানি।

আফসার উদ্দিন নামের এক কৃষক বলেন, স্কিম চলবে কিভাবে বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটারই নেই। কয়দিন পর পর চুরি হয়ে যায়। এই কৃষক জানান, ট্রান্সমিটার চুরির ঘটনায় স্থানীয়দের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনও জড়িত রয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা বলছেন এ প্রকল্পটিতে চলেছে লুটপাট। পুকুর নয়, সাগরচুরি হয়েছে। কৃষকের স্বার্থে কথা বললেও হয়েছে উল্টোটা। কৃষক তেলের পাম্পে পানি তুলে সেচ দিলেও যে খরচ হয় এই প্রি-পেইড মিটার ব্যবস্থায় খরচ ধরা হয়েছে তার চেয়েও বেশি।

আজগর উদ্দিন নামের সোনাগাজীর আমিরাবাদের এক কৃষক বলেন, আগে তেল দিয়ে পাম্পের মাধ্যমে যেভাবে পানি তোলা হতো। কথা ছিলো সেই খরচ থেকে এই পদ্ধতিতে খরচ কমবে। কিন্তু সেটা না হয়ে হচ্ছে উল্টোটা। পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশন বলছে কৃষক এই পর্যন্ত প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না তারা। ৮শ’র অধিক পাম্পের বেশির ভাগ অকেজো। কর্তৃপক্ষ কাজ না করে বন্যার অজুহাত সামনে এনেছেন। অপরদিকে কৃষি কর্মকর্তারা বলছে দ্রুত সেচ ব্যবস্থা সচল করতে না পারলে প্রভাব পড়বে আবাদে।

মুহুরী সেচ প্রকল্প পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাইন উদ্দিন কামরান বলেন, কাগজে-কলমে ৮'শর বেশি পাম্প থাকলেও তিন শতাধিকের বেশি পাম্প কখোনোই চালু ছিল না। কর্তৃপক্ষ আগস্টের বন্যাকে ক্ষতির জন্য দায়ী করলেও প্রকল্পে লুটপাটের কারণেই এমন দশা।

ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ ইউনিয়নের আলোকদিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কাসেম বলেন, জমিতে ট্রাক্টর ও পাওয়ার ট্রলি দিয়ে চাষের পর ভূগর্ভস্থ পানি লাইনে নিম্নমানের পাইপ ব্যবহারের কারণে অধিকাংশ জায়গায় দেবে গেছে। ফলে সঠিকভাবে পানি প্রবাহ হচ্ছে না। অনেক জায়গায় পাইপ ভেঙে যাওয়ায় পানি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে না।

নুরনবী বলেন, সিমেন্টের পাইপে কোনো রড বা জালি ব্যবহার না করায় পাইপ ফিটিংয়ের সময় অনেক পাইপ ভেঙে গেছে। তা ছাড়া শুকনো মৌসুমে খালে পানি থাকে না। খাল থেকে পানি উত্তোলন করে দেওয়ার এ স্কিমে কৃষকের কোনো উপকারে আসবে না। গভীর নলকূপ হলে কৃষক কিছুটা হলেও সুফল পেত।

একই গ্রামের স্কিম ম্যানেজার আবদুল মতিন বলেন, কৃষকের দেওয়া টাকায় বৈদ্যুতিক প্রিপেইড মিটারে টাকা ঢুকিয়ে কৃষকদের প্রাপ্য পানি তিনি তাদের দিতে পারছেন না। ফলে কৃষকরা তাকে টাকা দিচ্ছেন না। এভাবে বেশি দিন স্কিম চালানো সম্ভব নয়। চালু হওয়া ৮১টি স্কিমের বিষয়ে এমন অভিযোগ কৃষকদের।

কালিদহ এলাকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু তৈয়ব বলেন, আগস্ট মাসের বন্যায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। সরকারিভাবে সার, বীজ ও প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, পানির অভাবে অনেক কৃষক সবজিসহ ধান চাষাবাদ করতে পারছেন না। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন কৃষকরা।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, চলতি বছরের আগস্টসহ কয়েক দফার বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রকল্পটি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদ শাহরিয়ার বলেন, প্রকল্পের কাজ শেষে কিছু স্কিম চালু হয়েছিল। কৃষক সুফলও পেতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু, আগস্ট মাসের বন্যা পুরো প্রক্রিয়াকে এলোমেলো করে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। সেসব মেরামত করে চালুর চেষ্টা চলছে।

ফেনীতে কৃষিখাতের উন্নয়নে ৫৬২ কোটি টাকা বরাদ্দে মুহুরী সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পে (আইএমইপি) অনিয়মের অভিযোগ করেছেন এরশাদ আলী নামে এক ব্যক্তি। অনিয়ম নিয়ে তার লিখিত অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত বছরের জানুয়ারিতে তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মাহফুজা আক্তারকে আহ্বায়ক করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন- একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব যতন মার্মা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন।