সাড়ে তিন বছর সংসদ সদস্য থাকাকালে আব্দুস শাহীন চাকলাদার তার নির্বাচনি এলাকা যশোর-৬ (কেশবপুর) গড়ে তুলেছিলেন ‘বিকল্প শাসনকেন্দ্র’। একটি বাড়ির একাংশ ভাড়া নিয়ে সেখান থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ছাড়াও নিয়ন্ত্রণ করা হতো দখল, নিয়োগবাণিজ্য। ছিল নেতাদের আমোদ-ফুর্তির ব্যবস্থা। এটি শাহীন চাকলাদারের রঙমহল হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ছিল। এখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল অনেকের। তখনকার শেখ পরিবারের দাপুটে নেতা ও বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সারহান নাসের তন্ময়ও আসতেন এখানে।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সংসদ সদস্য এবং তখনকার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক মারা যান ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি। এরপর অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ওই আসনে শাসক দল আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারকে। বিজয়ী হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত তিনি কেশবপুরের সংসদ সদস্য ছিলেন।
নির্বাচনের আগ দিয়ে প্রচারণাসহ অন্যান্য কাজকর্ম সারতে শাহীন চাকলাদার কেশবপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে ‘নাজমা মঞ্জিল’ নামে একটি বড় আধুনিক বাড়ির কয়েকটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। বাড়িটির মালিক স্থানীয় বিএনপিকর্মী সিরাজুল ইসলাম। তিনি একজন ব্যবসায়ী। বছরের বড় একটি সময় সিরাজুল আমেরিকায় থাকতেন।
স্থানীয়রা জানান, এখানে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার পর নির্বাচনি কাজের নামে সেখানে যাতায়াত শুরু হয় যশোর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। দিনের চেয়ে রাতে জমজমাট হয়ে উঠত বাড়িটি। চলত অনৈতিক কর্মকাণ্ড।
এদিকে নির্বাচিত হওয়ার পর শাহীন চাকলাদার মাসে দু-তিনবার যেতেন কেশবপুরে। তখন সেখানে ব্যাপক লোকের সমাগম হতো। টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ সরকারি প্রকল্প ‘ভাগবাটোয়ারা’ হতো ওই বাড়িতে বসে। প্রথমে মফিজুর রহমান নামে স্থানীয় এক নেতা, পরে যশোর সদরের একজন ইউপি চেয়ারম্যান চাকলাদারের পক্ষে এই কাজ করতেন। ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগবাণিজ্যও চূড়ান্ত হতো এখান থেকে। বাড়িটিতে বসেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করতেন চাকলাদার।
আলোচিত নাজমা মঞ্জিলের একটি ফ্ল্যাটে সপরিবারে বসবাস করতেন রবিউল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি আমার দেশকে বলেন, শাহীন চাকলাদার বাড়িটির তিনতলায় দুটি ও চারতলায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। পাঁচতলায় আরেকটি ফ্ল্যাট তিনি গায়ের জোরে দখল করে রাখেন। ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের ভাড়াও ঠিকমতো পরিশোধ করতেন না। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বাড়ির মালিক চাকলাদারের দখলে থাকা ফ্ল্যাটগুলোতে তালা ঝুলিয়ে দেন।
ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেনÑ এমন বেশ কজন জানান, চাকলাদারের দখলে থাকা ফ্ল্যাটগুলোতে অসামাজিক কার্যকলাপ হতো। আসতেন নামজাদা নেতাসহ সাধারণ কর্মী-সমর্থক এবং সন্ত্রাসীরাও। চাকলাদার অনুসারী, কেশবপুরের দলীয় নেতা, কাউন্সিলর ছাড়াও যশোর ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজনের আনাগোনা ছিল সেখানে। মেয়ে মানুষের আনাগোনাও ছিল চোখে পড়ার মতো। রাতে মদের গন্ধে আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন দরজা-জানালা খুলতে পারতেন না। প্রতিবাদও করতে পারতেন না ভয়ে। ফলে ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন ভাড়াটেদের অনেকে।
চাকলাদারের কথিত এপিএস আলমগীর সিদ্দিকী টিটো বাড়িটিতে তরুণীদের আনাগোনার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, যশোর থেকে যুব মহিলা লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আসতেন। অন্যান্য এলাকার নেতারাও আসতেন নানা কাজে।
যশোরের কয়েক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে টিটো বলেন, ‘মামার (শাহীন চাকলাদার) সঙ্গে তার বন্ধুরা আসতেন। তারা হয়তো মদ খেতেন। আশপাশে মদের বোতলও ফেলতেন তারা।’
এ প্রসঙ্গে কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘যশোর থেকে নারী কর্মীরা এসে ভিড় জমাতেন বাড়িটিতে। সেখানে মেয়ে-ছেলে, মাদকের কারবারসহ যাবতীয় অপকর্ম হতো। প্রতিবাদ করায় আমি দলীয় পদও হারাই।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাগেরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি শেখ তন্ময় একবার এসেছিলেন নাজমা মঞ্জিলে। কিছু সময় পর তিনি চলে যান। কিন্তু রাতে হঠাৎ ফিরে আসেন। কোনো এক ঝামেলার কারণে ওই নেতা রাতে বাড়িটি থেকে গুলিও ছুড়েছিলেন। এতে এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সে সময় বাড়িটির অন্যান্য ফ্ল্যাটে থাকা পরিবারগুলোও এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘শেখ তন্ময় নাজমা মঞ্জিলে রাত কাটানোর জন্য ফিরে আসার ঘটনা আমার মোটেই ভালো লাগেনি। আমি ফেসবুকে ‘অভিশপ্ত মঞ্জিলে শেখ পরিবারের এক সদস্যের রাতযাপন। কী এমন কারণ’ শিরোনামে একটি স্ট্যাটাস দিই। শাহীন চাকলাদার আমার ভাইয়ের মাধ্যমে খবর পাঠান আমি যাতে স্ট্যাটাসটি প্রত্যাহার করি। কিন্তু আমি রাজি হইনি। পরদিনই আমাকে দলীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।’