Image description
 

আবুল কালাম আজাদ রেলওয়ের লোকোমাস্টার (ট্রেনচালক)। পাশাপাশি তিনি একজন কবি। সব সময়ই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলেন। ফেসবুকে ‘অসৎ অফিসার’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতাটি ভাইরাল হয়। এই কবিতার কারণেই তাঁর চাকরিজীবেন নেমে আসে দুর্ভোগ।

রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের এই চালকের বিরুদ্ধে ৩০ লিটার তেল চুরির অভিযোগ এনে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তাঁকে এক ‘অপরাধে’ ছয়টি শাস্তি দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। এই ছয় শাস্তি হচ্ছে, চালক থেকে সহকারী চালক পদে নামিয়ে দেওয়া, ১২১ দিন সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা, এ সময় সকাল-বিকেল দুইবার পাকশীতে বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলীর (ডিএমই) দপ্তরে হাজিরা দিতে বাধ্য করা, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি চার বছরের জন্য স্থগিত করা, ১৩তম গ্রেড থেকে ১৬তম গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া এবং খুলনা লোকোশেড থেকে পার্বতীপুর লোকোশেডে বদলি করা।

এরপর শুরু হয় আবুল কালামের মানবেতর জীবন। চিকিৎসার অভাবে ওই বছর ডিসেম্বরে তাঁর মা মারা যান। তখন তাঁর মেয়ে খুলনা নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। অর্থাভাবে মেয়েকে আর ওই বিদ্যালয়ে পড়াতে পারেননি। ভর্তি করেন একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ে। ছেলে পড়ত পঞ্চম শ্রেণিতে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছেলেকে ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর সামর্থ্য না থাকায় পরে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন।

এরপরেও আবুল কালাম হাল ছাড়েননি। ‘মিথ্যা অভিযোগে’ এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে দাবি করে ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন (মামলা নম্বর ৬৭/২০২৩)। দুই বছর পর আদালতে রায় দিয়েছেন, ‘তিনি তেল চুরি করেননি; বরং রেলওয়ের তেল সঞ্চয় করেছেন। তাঁকে পুরস্কারের পরিবর্তে উল্টো ‘সাজানো’ অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আদালত তাঁর শাস্তি প্রত্যাহার করে প্রতিকারের নির্দেশ দিয়েছেন।

আবুল কালাম আজাদ ২৮ জানুয়ারি এই রায়ের কপি হাতে পেয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঈশ্বরদী লোকোশেডে ট্রাইব্যুনালে রায়ের কপি জমা দিয়েছেন।

আবুল কালাম আজাদ রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বাসিন্দা। তাঁর বিরুদ্ধে তেল চুরির কথা উল্লেখ করে যে কথিত অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটি ছিল ২০২২ সালের ৩ আগস্টের ঘটনা। তখন তিনি খুলনা লোকোশেডে কর্মরত ছিলেন। ওই দিন তিনি যে ট্রেনটি চালিয়েছিলেন, সেটি ছিল তেলবাহী। যশোরের চেঙ্গুটিয়া স্টেশন পার হওয়ার সময় ইঞ্জিন থেকে সাদা বস্তাসদৃশ বস্তু চলন্ত ট্রেন থেকে পড়তে দেখেন বলে ট্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য গৌতম কুমার ও কর্মরত গার্ড বিশ্বজিৎ কুমার অভিযোগ করেছিলেন। ওই বস্তাসদৃশ বস্তুতে করে তেল চুরি করে ফেলা হয়েছিল—এই ছিল অভিযোগ। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনই আবুল কালাম আজাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং তদন্ত শেষে ৪ ডিসেম্বর তাঁকে একসঙ্গে ছয়টি শাস্তি প্রদান করা হয়।

অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন পার্বতীপুর লোকোশেডের ফুয়েল ইনচার্জ গোলাম মোস্তফা। বর্তমানে পাকশীতে সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলী পদে কর্মরত রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা ২০২২ সালের ৮ আগস্ট বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (ডিএমই) আশীষ কুমার মণ্ডলের দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাতে দেখানো হয়, ওই দিন চালক আবুল কালাম আজাদের লোকোমোটিভে (ইঞ্জিনে) ৩০ লিটার তেল ঘাটতি পাওয়া যায়।

আবুল কালাম আজাদ গত বছরের ৬ আগস্ট ডিএমই আশীষ কুমার মণ্ডলসহ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খুলনায় প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ৩০ লিটার তেল চুরির যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, ট্রাইব্যুনালে তা প্রমাণিত হয়নি। বরং রায়ে বলা হয়, ‘আবুল কালাম আজাদ ওই দিন রেলের ১৬ লিটার তেল সঞ্চয় করেছেন। শুধু তা–ই নয়, ওই আগস্ট মাসে তিনি মোট ৩০ লিটার তেল সঞ্চয় করেছেন। এ ছাড়া বস্তাসহ তেল ফেলে দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়নি। আদালত তাঁর শাস্তিকে ‘সাম্যতাহীন দণ্ড’ এবং বাস্তবতার নিরিখে অভিযোগের তুলনায় প্রদত্ত শাস্তি ‘আধিক্যের দোষে দুষ্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন।

খুলনা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্য (জ্যেষ্ঠ জেলা জজ) মো. আব্দুল মান্নান গত বছরের ৩১ জুলাই এই রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে, রেলওয়ের কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের একজন সেবক। শাস্তি প্রদানের আগে অবশ্যই তাঁকে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা উচিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে তা না করায় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। রায়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে আবেদনকারীকে যে চূড়ান্ত আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা বেআইনি মর্মে বাতিল করা হলো। তিনি এখনো চাকরিতে স্ব-স্কেলে বহাল আছেন গণ্য করে বকেয়া বেতন ভাতাদি, জ্যেষ্ঠতাসহ অন্যান্য সুযোগ–সুবিধাদি রায়ের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রদানের জন্য প্রতিপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া গেল।’

আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে দুই ব্যক্তি, ট্রেনের সেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য গৌতম কুমার ও কর্মরত গার্ড বিশ্বজিৎ কুমার সেদিন অবস্থান করছিলেন ট্রেনের শেষ বগির গার্ড ব্রেকে (গার্ডদের বিশ্রামের বগি)। ট্রেনটি ছিল তেলবাহী। এতে মোট বগি ছিল ২৯টি। এই ২৯ বগির শেষ মাথা থেকে সামনের ইঞ্জিন পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্ব। ফলে সেখান থেকে কিছুতেই সামনের ইঞ্জিন থেকে কিছু পড়ার দৃশ্য দেখা সম্ভব নয় এবং যথারীতি ওই দিনের গার্ড রিপোর্টেও অভিযোগকারী গার্ড বিশ্বজিৎ কুমার ইঞ্জিন থেকে বস্তা পড়তে দেখার বিষয়ে কোনো কিছুই উল্লেখ করেননি। নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে গার্ড রিপোর্টে তা উল্লেখ করার কথা।

আবুল কালাম জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেন সংকেত খাতা অনুযায়ী অভিযোগে উল্লেখিত সময়ের আধা ঘণ্টা আগেই ট্রেনটি ওই স্টেশন ছেড়ে আসে। বাস্তবে চেঙ্গুটিয়া একটি বন্ধ স্টেশন। সেখানে কোনো ট্রেন দাঁড়ায় না। এ ছাড়া অভিযোগে বলা হয়েছে যে ননভ্যাকুয়াম ট্রেন বলে এটি চেঙ্গুটিয়া স্টেশনে থামানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে কৃষক মো. মুছা নামের এক সাক্ষী বলেছেন, ট্রেন থামিয়ে বস্তা নামানো হয়েছে।

আবুল কালাম আজাদ নিজেকে নির্দোষ হিসেবে বিভিন্ন প্রমাণ নিয়ে দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কেউ তাঁর কথা শোনেননি। আবুল কালাম বলেন, তিনি একজন কবি, তাঁর দুটি কবিতার বইও বেরিয়েছে। ফেসবুকে ‘অসৎ অফিসার’ নামে কবিতা লেখার চার-পাঁচ মাস পরেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ আনা হয়। তিনি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্যই মামলা করেছিলেন, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো কর্মচারী এই ধরনের নিপীড়নের শিকার না হন।

আবুল কালাম আজাদের লেখ কবিতার লাইনগুলো ছিল ‘অসৎ অফিসার যারা/ ঘুষ খায় তারা।/ চাকরির নামে খায় যে ঘুষ/ মরার পরে হয় যে হুঁশ।/ তেলী মাথায় ঢালে তেল/ শুকনা মাথায় ভাঙে বেল।/ হায় রে অসৎ অফিসার বুঝে না/ আল্লাহকে ভয় করে না।/ ঘুষের টাকা দেয় যারা/ অসৎ অফিসারদের প্রিয় হয় তারা।/ ঘুষ দিলে ন্যায়/ না দিলে অন্যায়।/ এটাই হলো অর্থনীতি/ অসৎ অফিসারদের মূলনীতি।’

আজ দুপুরে এ ব্যাপারে পাকশী বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (ডিএমই) আশীষ কুমার মণ্ডলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি এখনো রায়ের কপি হাতে পাননি। ঈশ্বরদী লোকোশেডে জমা দিলে পরে তিনি পাবেন। আদালতের রায়ে নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।