Image description
নিউমার্কেট-এলিফ্যান্ট রোডের ৫৭ মার্কেট

রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোড ও নিউমার্কেট এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় ৫৭টি মার্কেট। এসব বিপণিবিতানসহ ওই এলাকায় ১১ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব দোকান ও মার্কেট থেকে প্রতি মাসে বিভিন্ন সেবা খাত ও সার্ভিস চার্জের নামে ৪৫-৫০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। পরিবর্তিত আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই বড় অঙ্কের অর্থের ভাগ পেতে মার্কেটগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে মাঠে নেমেছে দেশের কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। ভয়ভীতি দেখিয়ে ও হামলা করে ইতিমধ্যে বেশির ভাগ মার্কেট নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তারা।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই নিউমার্কেট ও নিউ এলিফ্যান্ট রোড এলাকার মার্কেট নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের অনুসারীরা। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রথমেই বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানে তালা দেওয়া শুরু হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মার্কেট পরিচালনা কমিটির নেতাদের ফোনে বা তলব করে হুমকি দেওয়া হতে থাকে। এতে আতঙ্কিত হয়ে নেতাদের অনেকে মার্কেটে যাওয়াই বন্ধ করে দেন। এরপর সন্ত্রাসীরা একে একে বিভিন্ন মার্কেট তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং নিজেদের পছন্দের লোক বসায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে মার্কেট পরিচালনা কমিটির নেতাদের ভয় দেখিয়ে লিখিত অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এলাকার ৫৭টি মার্কেটের পরিচালনা কমিটিতেই হয় সন্ত্রাসীরা নিজেদের লোক বসিয়েছে, না হয় আগের কমিটি গোপনে আপস করে টিকে আছে।

কেস স্টাডি গাউসুল আজম মার্কেট

মোতালেব মিয়াসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী ২০০০ সালের শেষ দিকে নীলক্ষেতের গাউসুল আজম সুপার মার্কেট নামের বিপণিবিতানটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে সেখানে ৮৪২টি দোকান রয়েছে। বর্তমান কমিটির সভাপতি মোতালেব মিয়া এবং সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান বাবুল। বাবুল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মার্কেটটিতে তালা দেয়। পরে আইন- শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপে সে তালা খোলা হলেও ঘটনা শেষ হয়নি। এরপর থেকে মোতালেব ও বাবুলকে অপরিচিত ব্যক্তিরা হুমকি দিতে থাকে। আতঙ্কে বাবুল আর মার্কেটে ফেরেননি। মোতালেব হুমকির মধ্যেই নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেন সরদারের মধ্যস্থতায় মার্কেটে যান। এরপরও বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি পেতে থাকায় বিএনপির তরুণ প্রজন্মের এক শীর্ষ নেতার দ্বারস্থ হন মোতালেব মিয়া। মোতালেব মিয়া জানিয়েছেন, গত সেপ্টেম্বরে তিনি রাজধানীর বাংলামোটরে বিএনপির ওই নেতার অফিসে যান। নেতা তাঁর সঙ্গে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে মোতালেবের পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল ও সুইডেন আসলাম। মোতালেব মিয়ার দাবি, তাঁর কোনো কথা না শুনেই বিএনপির নেতা বলেন, ‘কামালকে সাধারণ সম্পাদক করে মার্কেট চালান।’ তিনি মোতালেবকে আর কথা বলতে দেননি।

বিএনপির ওই নেতার সুপারিশ করা কামাল হলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক কামাল হোসেন। পিচ্চি হেলালের ঘনিষ্ঠ কামাল একসময় ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের নেতা ছিলেন।

সেদিনের ঘটনার বিষয়ে মোতালেব মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি বিএনপির নেতার কাছে সমাধানের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে পিচ্চি হেলাল ও সুইডেন আসলামকে দেখে ভয় পেয়ে যান। এদিকে বিএনপির নেতার সমর্থন পেয়ে কামাল হোসেন লোকজন নিয়ে গাউসুল আজম সুপার মার্কেট দখলে নিয়ে নিজেকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করেন। আগের সাধারণ সম্পাদক বাবুলকে হুমকি দিয়ে এ মর্মে লিখিত নিয়ে নেন তিনি।

এ বিষয়ে বদিউজ্জামান বাবুল বলেন, ক্রমাগত হুমকির মুখে তিনি মার্কেটে আসা বন্ধ করেন এবং সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি নেন।

কামাল হোসেন এখন নিয়মিত মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির অফিসে বসেন। এই মার্কেট থেকে প্রতি মাসে অবৈধ দোকানভাড়া, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, মার্কেটের কর্মীসহ বিভিন্ন খাতে অন্তত ৫০ লাখ টাকা তোলা হয়। এসব বাবদ কিছু অর্থ পরিশোধ করে বাকিটা নিজেদের পকেটে রাখে মার্কেট পরিচালনা কমিটি।

কামাল হোসেনকে মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক মেনে নিয়েই সভাপতি মোতালেব মিয়া আবার মার্কেটে যাওয়া শুরু করেন। এ অবস্থায় গত ১৮ ডিসেম্বর মার্কেটে তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এ ঘটনায় থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে তিনি কামাল হোসেনকে অভিযুক্ত করেন। তবে কামাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি হামলা করেননি; বরং মোতালেব মিয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করছেন খবর পেয়ে হাজারীবাগের কিছু ছেলে এসে তাঁকে ধরেছিল। তিনি খবর পেয়ে এসে মোতালেবকে উদ্ধার করেন।

দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে ইমন

এলাকার সব মার্কেটের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সদস্যরা জানিয়েছেন, দখলে এগিয়ে রয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন। অন্যদিকে ইমামুল হাসান হেলাল (পিচ্চি হেলাল), সুইডেন আসলাম এবং কয়েক সন্ত্রাসী জোট বেঁধে আরেকটি বলয় সৃষ্টি করেছে। তবে ইমনের প্রভাবের সঙ্গে তারা পেরে উঠছে না। ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট এলাকার ছাত্রদল ও যুবদলের প্রভাবশালী নেতারা ইমনের সঙ্গে রয়েছেন। কয়েকটি মার্কেট পরিচালনা কমিটির নেতা ও পুলিশের সূত্র বলেছে, নিয়ন্ত্রণ দখলের পর মার্কেটগুলোর পরিচালনা কমিটির সামনে রাখা হচ্ছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। নেপথ্যে থাকছে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।

পিচ্চি হেলালের ভাই ওয়াহেদুল হাসান দীপু এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি। ১০ জানুয়ারি রাতে মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের সামনে হামলার শিকার হন দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির মাল্টিপ্ল্যান শাখার যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেসামুল হক। দীপু এ ঘটনায় করা হত্যাচেষ্টা মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে আসামি করেছেন।

ওয়াহেদুল হাসান দীপু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ক্রমাগত চাঁদা দাবি করে আসছিল একটি চক্র। সেপ্টেম্বরে একদিন আমার অফিসে মুন্না, এ কে এম চঞ্চল ও খোকন নামের কয়েকজন আসে। তারা এসে ‘ক্যাপ্টেন কথা বলবে’ বলে একটি ফোন ধরিয়ে দেয় আমাকে। ওপাশ থেকে আমাকে বলা হয়, ‘ওরা যেভাবে বলে, সেভাবে মার্কেট চালাও।’ আমি ফোন রাখার পর ওই লোকদের কাছে ‘ক্যাপ্টেন’ কে জানতে চাই। তারা বলে, ‘ইমন ভাই’।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটে পিচ্চি হেলালের আপন ভাই থাকায় এখনো এটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি ইমন। তবে নিউমার্কেটসহ গাউছিয়া, চাঁদনী চক, ইস্টার্ন মল্লিকা, চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন তিনি। মার্কেটসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইমনের সঙ্গে পিচ্চি হেলালের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

নিউ এলিফ্যান্ট রোডে পিচ্চি হেলালের ভাই দীপুর ওপর হামলার ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসাইন ওরফে মিথুনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁকে ছাড়িয়ে নিতে নিউমার্কেট থানায় হামলা চালায় অনুসারীরা। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির আজকের পত্রিকাকে বলেন, মিথুনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

ব্যবস্থা নেওয়ার প্রত্যয় পুলিশের

বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, মার্কেটের নিয়ন্ত্রণের লড়াই নিয়ে যতগুলো অভিযোগ পুলিশের কাছে এসেছে, সব কটির বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু লোক নীরবে আঁতাতও করছে, সেখানে তো পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে সবকিছু পুলিশের নজরদারিতে আছে। ছোট সন্ত্রাসী, বড় সন্ত্রাসী কিংবা শীর্ষ সন্ত্রাসী—যে-ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।’