জুলাই অভ্যুত্থানে সারা দেশে ঝরে গেছে বহু তরুণ-তাজা প্রাণ। শেখ হাসিনা সরকার আন্দোলন দমনে পথে নামিয়েছিল পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীকে। তারা বেছে নিয়েছিল নির্মম পন্থা। এই আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছয়জনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তাঁদের মা–বাবা ও ভাই–বোনেরা।
অভ্যুত্থানের প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও শহীদদের স্বজনদের চোখ এখনো ভিজে আছে অশ্রুতে। এখনো তাঁদের শোক ও বেদনার উপশম হয়নি। আজ সোমবার বিকেলে প্রিয়জনদের কথা বলতে গিয়ে তাঁরা নিজেরা কাঁদলেন, কাঁদালেন অপর বক্তা ও শ্রোতাদেরও।
প্রথম আলোর আয়োজনে ২৪ জানুয়ারি থেকে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় শুরু হওয়া জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনীতে আজ সোমবার ছিল শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মান জানানো ও আলোচনার আয়োজন। সেখানেই ছয় শহীদের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন স্বজনহারা এই ব্যক্তিরা। তাঁদের অশ্রুর সঙ্গে মিলে গেল সমাগতদের অশ্রুধারা। তাতে নিদারুণ এক বেদনাবিধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। তাঁরা বলেছেন, সব শহীদের খুনিদের যেন বিচার হয়। দেশে যেন বাক্স্বাধীনতা থাকে, গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আর যেন কোনো স্বৈরাচার ফিরে না আসে—এটাই তাঁদের চাওয়া।
প্রদর্শনীতে আলোকচিত্র, প্রথম আলো পত্রিকার বিভিন্ন পাতা, অভ্যুত্থান নিয়ে বিশেষ রচনা, সাক্ষাৎকার, কবিতা এসবের ডিজিটাল প্রিন্ট, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর ব্যবহৃত গুলির খোসা, প্রামাণ্যচিত্র, শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে শিল্পী শহীদ কবীরের শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রক্রিয়ার ভিডিও, এমন অনেক নিদর্শন রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ছয় শহীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীর বিশেষ উপস্থাপনা। আজ তাঁদের স্বজনেরা এসেছিলেন প্রদর্শনীতে।
শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে পীরগঞ্জ থেকে তিনি সন্ধ্যা নাগাদ যখন রংপুরে আসেন, তখন পুলিশ তাঁকে লাশ দেখতে দিচ্ছিল না। লাশ গুম করে রেখেছিল।
ভাইয়ের লাশ নিয়ে এর চেয়েও ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ার কথা বললেন শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বড় বোন সাবরিনা আফরোজ। মোহাম্মদপুরে তাঁদের বাসার সামনের সড়কেই ১৯ জুলাই পুলিশ গুলি করেছিল সৈকতকে। কিন্তু তাঁর লাশ বাড়িতে আনা যাচ্ছিল না। বাড়ির সামনে অনেক পুলিশ মোতায়েন ছিল। তারা লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ছাত্ররা সৈকতের লাশ আল-মারকাজুলে গোসল দিয়ে ফ্রিজিংভ্যানে করে সারা রাত সেখানে রেখেছিলেন। সেই রাতে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তাঁদের বাড়িতে। মা–বাবা তাঁদের একমাত্র ছেলে এবং তাঁরা দুই বোন ভাই হারানোর শোকে প্রায় পাগলপারা অবস্থা। কিন্তু লাশের কাছে কেউ যেতে পারছিলেন না।
শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের মা জারতাজ পারভিন বলছিলেন আরও ভীতিকর অভিজ্ঞতার কথা। পুলিশ লাশ দিচ্ছিল না। গুলিতে মারা গেছে, এ কথা বলা হবে না—এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা আহনাফের লাশ নিয়ে আসেন। দাফন করার সময় বলা হয়েছে, নিউমোনিয়ায় মারা গেছে।
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর মা শাহানা চৌধুরী ছেলে শহীদ হওয়ার পরে আজই প্রথম বাড়ির বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। তবে তিনি কোনো কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। ছেলের স্মৃতিময় নিদর্শনগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুগ্ধর বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান বলেন, মুগ্ধর এই জিনিসগুলো সামনাসামনি দেখলে সহ্য করা যায় না। তিনি বলেন, যে উদ্দেশ্যে এই তরুণেরা জীবন দিয়ে গেলেন, তা যেন বাস্তবায়িত হয়।
শহীদ নাঈমা সুলতানার মা আইনুন নাহার বলেন, ঘরের বারান্দায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মেয়ে মারা গেছে। এর পর থেকে তাঁর ছোট ছেলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ‘গুলি আসল, গুলি আসল’ বলে রাতে ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে ওঠে। তিনি নিজেও রাতে ঘুমাতে পারেন না। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এখন তাঁকে দুবেলা ওষুধ খেতে হয়।
শিশু জাবির ইব্রাহীমের বাবা কবির হোসেন ছেলের শহীদ হওয়ার মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়ে বলেন, একাত্তরের শহীদেরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর চব্বিশের শহীদেরা জীবন দিয়েছেন সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য। তাঁদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।
এই ছয় শহীদের প্রতিকৃতি এঁকেছেন শিল্পী মাসুক হেলাল। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রতিকৃতিগুলো তুলে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন।
আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘অভ্যুত্থানের এই সময়টাকে যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা যেন দেশের সব বৈচিত্র্যকে নিয়ে সহাবস্থান করতে পারি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন থাকে, সবার জীবনের সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের সদস্য ড. চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস আলোচনা করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এই শহীদ পরিবারের মানুষদের যে বেদনা, যে শূন্যতা, তা আমাদের প্রবলভাবে আবেগতাড়িত করেছে। আমরা প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়েছিলাম, নিজেরাই যেন মানুষ হিসেবে মরে গিয়েছিলাম। এই অল্প বয়সী তরুণেরা আমাদের প্রতিবাদের সাহস দিয়েছে। আমরা এই অভ্যুত্থানের প্রতিটি হত্যার বিচার চাই। এই কচি মুখগুলো আমাদের যেন মনে থাকে। এই দেশে যেন আর কোনো বৈষম্য না থাকে।’
জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনী চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত, প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
