Image description
 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্ব কেবল বক্তব্য বা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয়, বরং তাদের উপস্থিতি, আচরণ ও নান্দনিকতার মাধ্যমেও একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই একজন রাজনীতিক, যার শিফন শাড়ি, সংযত সাজ ও মর্যাদাসম্পন্ন ভঙ্গি সময়ের সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ভাষায় পরিণত হয়েছিল।
হালকা রঙের শিফন শাড়ি, পরিমিত মেকআপ, মুক্তোর গয়না এবং মাথায় শাড়ির আঁচল—এই উপস্থাপনাটি কেবল ব্যক্তিগত রুচির প্রকাশ ছিল না। এটি ধীরে ধীরে একটি ধারাবাহিক ভিজ্যুয়াল পরিচয় তৈরি করে, যা তাঁকে জনপরিসরে আলাদা মর্যাদা ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছিল। একজন গৃহিণী খালেদা খানম পুতুল থেকে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় এই নান্দনিক ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়ভাবে অটুট ছিল।
এই উপস্থিতি ছিল এক ধরনের নীরব রাজনৈতিক কৌশল। এমন একটি সমাজে, যেখানে নারীর নেতৃত্বকে দীর্ঘদিন সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে, সেখানে খালেদা জিয়ার পোশাক, অলংকার ও আচরণ সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। তাঁর ব্যক্তিগত উপস্থাপন রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো উচ্চকণ্ঠ ছিল না, কিন্তু প্রভাব ছিল গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী।
বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থান ছিল দৃঢ়ভাবে জাতীয়তাবাদী। সরকার ও বিরোধী—উভয় সময়েই তিনি একাধিকবার ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে জোট গঠন করেছেন। এসব দলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে রক্ষণশীল হলেও, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত উপস্থিতি কখনোই কঠোর ধর্মীয় রীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েনি।
তিনি কখনো প্রকাশ্যে হিজাব বা অতিরিক্ত ধর্মীয় পোশাক গ্রহণ করেননি। বরং শিফন শাড়ির আঁচল মাথায় রেখে তিনি এমন একটি মধ্যপন্থী ভঙ্গি বজায় রেখেছেন, যা একদিকে শালীনতা ও সংযমের প্রতীক, অন্যদিকে আধুনিক ও অভিজাত নারীর পরিচায়ক। এই দ্বৈত অবস্থান তাঁকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে আরও সুদৃঢ় করে।
বাংলাদেশি সমাজে বিধবা নারীর ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে সীমাবদ্ধ ও সংযত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান এই বাস্তবতার মধ্য দিয়েই ঘটেছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা পরিচয় সমাজে এক ধরনের নৈতিক মর্যাদা ও সহমর্মিতার স্থান তৈরি করে দেয়। জাতীয় শোক ও নারীর ত্যাগের প্রতীক হিসেবে তাঁর উপস্থিতি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক বৈধতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসে পরিণত হয়।
শাড়ির আঁচল মাথায় রাখার মাধ্যমে তিনি শালীনতা ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠলেও, তা কখনো তাঁকে দুর্বল বা অন্তর্মুখী করে তোলেনি। বরং তিনি বিধবা পরিচয়ের সামাজিক প্রত্যাশাকে নতুনভাবে নির্মাণ করে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনের ব্যবহারও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় নারীদের অধিকাংশ সময় পারিবারিক বা আত্মীয়তামূলক সম্বোধনে ডাকা হয়। কিন্তু ‘ম্যাডাম’ শব্দটি একটি আনুষ্ঠানিক দূরত্ব তৈরি করে, যা প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের ধারণার সঙ্গে যুক্ত। খালেদা জিয়ার আচরণ, ভাষা ও নান্দনিক উপস্থিতি তাঁকে রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে দৃশ্যমানভাবে সংযুক্ত করেছিল।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হামজা আলাভির পোস্ট-কলোনিয়াল রাষ্ট্র তত্ত্ব অনুযায়ী, উপনিবেশ-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতা কেবল নির্বাচিত নেতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং একটি বিশেষায়িত বেতনভুক্ত অভিজাত শ্রেণি—আমলা, সামরিক কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ পেশাজীবীরা—রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠামো পরিচালনা করে। এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি এই শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠাও জরুরি।
খালেদা জিয়া তাঁর সংযত আচরণ, পরিমিত ভাষা ও অভিজাত নান্দনিকতার মাধ্যমে এই শ্রেণির কাছেও নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন। একই সঙ্গে ইসলামপন্থী দলগুলো, যারা তাত্ত্বিকভাবে নারী নেতৃত্বের বিষয়ে আপত্তি রাখে, বাস্তবে তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে সক্ষম হয়। নির্বাচনী বাস্তবতা ও তাঁর শালীন, অ-উস্কানিমূলক উপস্থিতি এই গ্রহণযোগ্যতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই কারণেই খালেদা জিয়ার শিফন শাড়ি কেবল ব্যক্তিগত পোশাক হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সময়ের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক প্রতীকে রূপ নেয়—যার মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে সংযত ও কর্তৃত্বপূর্ণ, ধর্মনিরপেক্ষ অথচ রক্ষণশীলদের কাছে গ্রহণযোগ্য, এবং অভিজাত হয়েও জনসম্পৃক্ত একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খালেদা জিয়ার এই নান্দনিক উপস্থিতি তাই শুধুই রুচির প্রকাশ নয়; এটি ছিল ক্ষমতা, লিঙ্গ ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার এক নীরব কিন্তু গভীরভাবে কার্যকর ভাষা।

 

সূত্র: ঢাকা স্ট্রিম