বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটগুলো চায় চলতি বছরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ভোট হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার সঙ্গে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিলে যাওয়ায় যাচাই-বাছাই করে ফেব্রুয়ারির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ সরকারের কাছে দেবেন কমিশন প্রধানরা। এরপর সেই প্রস্তাবনা নিয়ে নির্বাচনমুখী দলগুলোর মতামত নেবে সরকার। সেই মতামত চূড়ান্ত হলে সেটি নির্বাচন কমিশনের কাছে যাবে। এরপর নির্বাচন কমিশন এসব মতামতের মধ্যে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য আর কতটুকু কমিশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা পর্যালোচনা করে তাদের প্রস্তাব পাঠাবে আইন মন্ত্রণালয়ে। সেই প্রস্তাবনা নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসব বিষয় চূড়ান্ত হবে এবং আইনি রূপ লাভ করবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার প্রস্তাব।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, সেটি চূড়ান্ত হতে মধ্য মার্চ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এবার যেহেতু মার্চ মাসে রমজান, তাই কাজের গতি কিছুটা স্লথ হয়ে যেতে পারে। সেই হিসেবে এপ্রিল মাস নাগাদ সংস্কার প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত হতে পারে এবং এরপরই কমিশনের জন্য নির্বাচনের পথ সুগম হবে। তাই সরকারের সবুজ সংকেত পেলে অক্টোবরে তফসিল দিতে চায় নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, সরকার যখন নির্বাচন চাইবে, ইসিও তখন নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুত। দ্রুত নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক দল ও প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপ রয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলমান সংকট সমাধানের একমাত্র পথ বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও ইঙ্গিত দিয়েছেন দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করার।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ডিসেম্বরে ভোট করতে গেলে অক্টোবরে তফসিল করতে হবে। অক্টোবরের মধ্যে আইনকানুন বিধিবিধান সংস্কার শেষ করতে হবে।
সিইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ-পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, উনি (সিইসি) ঠিকই বলেছেন। ডিসেম্বরের নির্বাচন করলে অক্টোবরে তফসিল দিতে হবে। কিন্তু সেটা করতে চাইলে নির্বাচন কমিশনকেই প্রস্তাব দিতে হবে সংস্কার কমিশনের কোন কোন প্রস্তাব তারা গ্রহণ করবে। সেটা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠালে কেবিনেটে উঠবে, তারপর চূড়ান্ত হবে।
এ উপদেষ্টা আরও বলেন, তবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলব, সংস্কার প্রস্তাব যেগুলো এসেছে তার মিনিমামটাও যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে ডিসেম্বরের মধ্যে সম্ভব না। সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি লেগে যেতে পারে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করবে, সেটার ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনের দিনক্ষণ। তা ছাড়া কতগুলো বিষয় রয়েছে, যেগুলোর সংস্কার করতেই হবে। এবার সেটা না হলে অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হবে। প্রধান উপদেষ্টা তার ঘোষণায় বলেছেন, অল্প সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে এবং বেশি সংস্কার চাইলে জুনের মধ্যে নির্বাচন। তাই জুনে না হোকÑ মার্চ, এপ্রিল বা যে কোনো সময় হতে পারে।
সিইসির বক্তব্যের সঙ্গে একমত নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলি। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, অক্টোবরের মধ্যে অবশ্যই তফসিল ঘোষণা করা সম্ভব। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা করে তফসিল ঘোষণা করা সম্ভব। এ সময় তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটা নির্বাচন হয়েছিল। এরপর ১২ জুন আর একটা নির্বাচন হয়েছিল। তখন কিন্তু তিন মাসেই সব হয়েছে।
এদিকে চলমান সংকট নিরসনে শুরু থেকেই নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করে আসছে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাবগুলো দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে। গতকাল রবিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণে এ বছরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। শুধু তাই না, কোনো সংকট যাতে তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা উচিত।
এদিকে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা বা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনাÑ এসব নিয়ে যখন চারদিকে আলোচনা চলছে, তখন নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করলেন সিইসি। তিনি বলেছেন, তফসিল ঘোষণা হলে সে সময় যতগুলো দল নিবন্ধিত থাকে আমরা তাদের নিয়ে নির্বাচন করি। এখন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নিবন্ধনের ধরন পাল্টে যাবে। তাই শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তফসিল পর্যন্ত যারা নিবন্ধিত থাকবে, অপেক্ষা করছি সে পর্যন্ত। তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত, কতটা পার্টি নিবন্ধিত থাকে, আমরা তা দেখতে চাই।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেসবের অনেকটি এরই মধ্যে প্রকাশ হয়েছে। সেখানে কয়েকটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে গেলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সিইসি। তিনি বলেছেন, পার্লামেন্টের স্থায়ী কমিটির হাতে নির্বাচন কমিশনের কোনো কাজ গেলে ইসির স্বাধীনতা খর্ব হবে। তিনি বলেন, স্থায়ী কমিটির ওপর নির্ভরশীল হতে চাই না। এ সংক্রান্ত সুপারিশ বাতিল করতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কাজের সমালোচনা করে সিইসি বলেন, সুপারিশে অনেক কিছু দেওয়া যায়। বাস্তবায়ন করা কঠিন।