২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে ঢাকা-১০ আসনে সংসদ সদস্য হন শেখ ফজলে নূর তাপস। ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে প্রভাবশালী শেখ পরিবারের এই রাজনীতিবিদ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের পর ওই বছরের ১৬ মে মেয়র হিসেবে শপথ নেন তিনি। দায়িত্বে ছিলেন গত বছরের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। যদিও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন আগে গোপনে দেশ ছাড়েন তিনি।
তাপস মেয়র থাকার সময় ৮১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন পদে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পান আরও ২৯৬ জন। নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী মেয়রের পছন্দের লোক। অর্থ বাণিজ্যের পাশাপাশি এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টিই ছিল মুখ্য। চাকরি দেওয়ার বিষয়ে তিনি ছাত্রলীগ ও গোপালগঞ্জের প্রার্থীদের প্রাধান্য দিতেন। নগর ভবনকে রীতিমতো আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় বানিয়ে রাখেন তাপস।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, করপোরেশনের বিভিন্ন পদে সবর্শেষ ২৫২ জনকে নিয়োগ দিতে শেখ পরিবারের পরিচয়ের দাপট দেখান সাবেক মেয়র তাপস। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক অনুসারী নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেন তিনি। এর মধ্যে হিসাব সহকারী পদে ৭৬, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ৭৭, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মী পদে ৫০, পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক পদে ৩১ ও ইপিআর সুপারভাইজার পদে ১৮ জন নিয়োগ পান। নিয়োগের পদে পদে রয়েছে জাল-জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই দেওয়া হয়েছে বেশিরভাগ নিয়োগ। শুধু তাই নয় নিয়োগ দেওয়ার দুই মাসের মাথায় পরীক্ষার্থীদের খাতাসহ অনেক তথ্য পুড়িয়ে ফেলা হয় শেখ তাপসের নির্দেশে।
এসব নিয়োগের অনুমোদন করেননি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব ও ডিএসসিসির বাছাই কমিটির সদস্য মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম। তার অনুমোদন ছাড়াই কর্মীদের নিয়োগপত্র দিয়ে দেয় ডিএসসিসি। জানতে চাইলে উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যেখানে যেখানে সমস্যা ছিল সেখানে আমি স্বাক্ষর করিনি। যেসব নিয়োগে আমার স্বাক্ষর নেই তাহলে ধরে নিতে আমি ওই নিয়োগের পক্ষে মতামত দিইনি অথবা অনুপস্থিত ছিলাম।’
জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়াদের বেশিরভাগের বাড়ি গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও বরিশালের। হিসাব সহকারী পদে নিয়োগ পাওয়া ৭৬ জনের মধ্যে ১৩ জন তাপসের সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-১০ আসন, অর্থাৎ নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, কলাবাগান ও ধানমন্ডির বাসিন্দা। মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার ছয়জন, ফরিদপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার আটজন পেয়েছেন চাকরি। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগ পাওয়া ৭৭ জনের ১০ জন ঢাকা-১০ আসনের বাসিন্দা। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের ৬ জন, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের ৬ জনের চাকরি হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের বছরে ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা বেতন দিতে হচ্ছে ডিএসসিসি।
পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক পদে ৩১ জনের মধ্যে ১০ জন তাপসের নির্বাচনী এলাকার। গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের তিনজন পেয়েছেন চাকরি। গোপালগঞ্জের সোহাগ হাওলাদার নামে এক ব্যক্তি একসঙ্গে দুই সরকারি চাকরি করছিলেন। গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহায়ক পদে কর্মরত থাকাকালে গত বছরের ৪ জুলাই পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন সিটি করপোরেশনে। সরকার পতনের পর করপোরেশনের চাকরি ছাড়েন তিনি।
সূত্র জানায়, তাপস মেয়র থাকার সময় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন পদে কাকে নেওয়া হবে, সেটি তিনি নিজেই চূড়ান্ত করতেন। এরপর তার পছন্দের প্রার্থীদের তালিকা সিটি করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামানের কাছে দিতেন। সে অনুযায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা করতেন তিনি। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার খাতাও তিনি দেখতেন। সাবেক মেয়রের কথামতো নিয়োগের পুরো বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন আকরামুজ্জামান। তাপস মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর আকরামুজ্জামানকে প্রেষণে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সচিব করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডে বদলি করা হয়েছে।
ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মী বলেন, মেয়র তাপস টাকা খেয়ে অনেক লোকের চাকরি দিয়েছেন। তিনি সব সময় হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন। আগের মেয়র সাঈদ খোকন দক্ষ-অদক্ষ লোক হিসেবে ১ হাজার ২৭০ জনকে চাকরি দিয়েছিলেন। মেয়র তাপস আসার পর শুধু সাঈদ খোকন চাকরি দেওয়ার কারণে ৯০০ লোকের চাকরি খেয়ে ফেলেন। পরে নিজে ৪০০ লোকের চাকরি দিয়েছেন।
ওই কর্মী আরও বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির স্থায়ী ৪৪ জনের চাকরিও খেয়েছেন তাপস। আমার জানা মতে, দক্ষিণ সিটিতে বিভিন্ন দপ্তরে ৪২ জনকে চাকরি দিয়েছেন সচিব আকরামুজ্জামান, যাদের চাকরি দিয়েছেন তারা সচিবের কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। আমি অন্তত ১৭ জনের নাম জানি।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বর্তমান সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভুঞা কালবেলাকে বলেন, করপোরেশনের পরবর্তী বোর্ড সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সর্বশেষ নিয়োগে মন্ত্রণালয় থেকে যে কর্মকর্তা এসেছিলেন তার স্বাক্ষর নেই বলে শুনেছি। আমি মনে করি নিয়োগ প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে হয়নি। এখন আমরা করপোরেশনের সর্বোচ্চ ফোরামে আলোচনা করে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা নেব। এখন ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি আছে। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।
নিয়োগ পরীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেককেই কায়দা করে লিখিত পরীক্ষায় পাস করানো হয়েছে। রাজস্ব বিভাগের ‘উপ-কর কর্মকর্তা’ পদে গত চার বছরে নিয়োগ পাওয়া ৯ জনের মধ্যে সাতজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দলীয় বিবেচনায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের বেশির ভাগ মেয়র তাপসের লোক পরিচয় দিয়ে রাজস্ব বিভাগে প্রভাব খাটাতেন। এ ছাড়া রেভিনিউ সুপারভাইজার পদে ২৬ জন, লাইসেন্স সুপারভাইজার পদে ৭ জন, রেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে ৭ জন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ২৫ জন, হিসাব সহকারী পদে ২২ জন, এই ৮৭টি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায়।
রাজস্ব বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘উপ-কর কর্মকর্তা’ পদে নিয়োগ পাওয়া মুন্সি গিয়াস উদ্দিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। গিয়াস গত মেয়র নির্বাচনের সময় তাপসের পক্ষে কাজ করেছেন। পুরস্কার হিসেবে পরে তাকে এই পদে বসানো হয়। একইভাবে দক্ষিণ সিটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একজন নেতার মেয়ে সাদিয়া সারওয়ার আলী, নিউমার্কেট এলাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রফিকুল ইসলামকেও ওই পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ‘উপ-কর কর্মকর্তা’ পদে চাকরি পাওয়া সৈয়দ সাদমানের পরিবারের সঙ্গে সাবেক মেয়র তাপসের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলমের জামাতা তাসিম হাসানকেও উপ-কর কর্মকর্তা করা হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদও রয়েছে। এ পদে চারজনকে নিয়োগ দিয়েছেন তাপস। তাদের মধ্যে শিহাব উদ্দিন কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি।
একটি ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজ তত্ত্বাবধান করেন পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক। এই পদে নিউমার্কেট থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সাদ্দাম হোসেনকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা খলিলুর রহমানও পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক পদে চাকরি পেয়েছেন। আরেকজন পরিদর্শক রাসেল হাওলাদারের বাবা এলিফ্যান্ট রোড ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতা। ‘রেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট’ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম একসময় ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন। একই পদে নিয়োগ পাওয়া শ্রাবনী আক্তার ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার স্ত্রী।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে অনিয়ম নিয়ে কথা না বলা এবং বাধা দেওয়ার লোক না থাকায় স্বজনপ্রীতি, পছন্দের মানুষ ও দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তিদের সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে গত সাড়ে চার বছরে যেভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এর তদন্ত হওয়া উচিত। শুধু দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া অন্যায়। অনিয়মের প্রমাণ পেলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।