ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টিএফআই সেলে গুম-নির্যাতনের মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানিতে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে, যাতে এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালও জড়িয়ে পড়ে।
মঙ্গলবার বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ অভিযোগ গঠনের আদেশ দেওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে।
এদিন র্যাবের টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন (টিএফআই) সেলে গুম-নির্যাতনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
একই সঙ্গে প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য আগামী ২১ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়। এর আগে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের শুনানি শেষ হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষে (প্রসিকিউশন) পক্ষে ছিলেন প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম ও বি এম সুলতান মাহমুদসহ অন্য প্রসিকিউটররা।
আসামিদের পক্ষে ছিলেন তবারক হোসেন ও এ বি এম হামিদুল মিসবাহ।
দুপুরে বিচারকরা এজলাসে ওঠার পর ট্রাইব্যুনালের প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ অভিযোগ পড়া শুরু করেন। এরপর আসে আসামিদের জিজ্ঞাসা করা যে, তারা দোষ স্বীকার করেন কিনা।
এ পর্যায়ে সাত সেনা কর্মকর্তার আইনজীবী তবারক হোসেন দাঁড়িয়ে পরবর্তী সময়ের বিষয়ে কিছু বলতে চান। তিনি সাক্ষ্য শুরুর আগে চার সপ্তাহ সময় প্রার্থনা করেন।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তবারকের আবেদনে সময় মঞ্জুর করতে উদ্যত হলে প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম দাঁড়িয়ে চার সপ্তাহ সময় দেওয়ার বিষয়ে বিরোধিতা করেন।
তার এ ধরনের বিরোধিতায় বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ হস্তক্ষেপ করেন। তিনি বলেন, “আমরা আপনার কাছ থেকে ধৈর্য আশা করি লারনেড চিফ প্রসিকিউটর। আমরা আপনাকেও শুনব, তারপর আদেশ দেব।”
প্রধান কৌঁসুলি বলেন, “আদেশ তো দিয়ে দিচ্ছেন।”
বিচারপতি মাহমুদ বলেন, “আদেশ দিইনি, ওপিনিয়ন দিচ্ছি। আদেশ আর ওপিনয়িন তো এক নয়। উই আর নট হ্যান্ডিক্যাপড। আপনাদের শুনব তারপর আদেশ দেওয়া হবে।”
তখন আসামি পক্ষের আইনজীবী তবারক হোসেন বলেন, অন্তত ২১ দিনের কথা আছে আইনে। অভিযোগের সব নথি পড়তে অনেক সময় প্রয়োজন। ব্যারিস্টার আরমানের (গুম-নির্যাতনের ভুক্তভোগী) একটি বই প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার, সেটি পড়তে হবে। অন্তত চার সপ্তাহ সময় প্রয়োজন।
আইনের কথা তুলে ধরে প্রধান কৌঁসুলি তাজুল বলেন, আইনে ২১ দিনের কথা বলা আছে। সে সময়তো দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক মাস আগে তাদের অভিযোগের কপি দেওয়া হয়েছে। এখন ২১ দিনের বেশি দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা বিচারের সময় নষ্ট করতে চান।
তখন আসামির আইনজীবী তবারক আবার কথা বলতে চাইলে প্রধান কৌঁসুলি রেগে গিয়ে তাকে বসতে বলেন, “বসেন আপনি। বসেন।”
তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান গোলাম মর্তূজা মজুমদার আইনজীবী তবারককে বসতে বলেন। তখন তবারক বসে যান।
এরপর তাজুলের বলা শেষ হলে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান চার সপ্তাহ সময় দেন এবং তাজুলকে আশ্বাস দেন যে বিচার চলাকালে নিয়মিত শুনানি চালানো হবে, যাতে সময় নষ্ট না হয়।
এরপর প্রধান কৌঁসুলি আর কোনো প্রতিবাদ করেননি।
এ পর্যায়ে আসামি পক্ষের আইনজীবী তবারক উঠে বলেন, “মাননীয় চিফ প্রসিকিউটরকে আমি যথাযথ সম্মান দেখিয়ে কথা বলি। কিন্তু ট্রাইব্যুনালের সামনে তিনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন। আমার বয়সের সম্মানটুকুও দেননি। আমি আপনাদের কাছে বিচার দিলাম।”
এদিন সকাল ১০টার দিকে ১০ সেনা কর্মকর্তাকে ঢাকার সেনানিবাসের বিশেষ কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
তারা হলেন- র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম।
পলাতক আসামিরা হলেন–সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক ডিজি এম খুরশিদ হোসেন ও হারুন অর রশিদ, র্যাবের সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. খায়রুল ইসলাম।