Image description

বগুড়ায় ১২ বছরের এক বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী কিশোরী চাচাতো ভাইয়ের দ্বারা বারবার ধর্ষণের শিকার হয়। প্রথম বার ঘটনার পরে পারিবারিকভাবে ঘটনাটি মিমাংসা করা হয়। দ্বিতীয় বার একই ঘটনা ঘটলে মেয়ের পরিবার মামলা করার চেষ্টা করে। চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের দেওয়ার শর্তে মামলা করা থেকে বিরত থাকে ভুক্তভোগীর পরিবার। তবে শেষ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার মেয়েকে বিয়ে করেনি চাচাতো ভাই। ২৫ হাজার টাকায় এই অপরাধ মিমাংসার পথ বেছে নেয় মেয়ের বাবা-মা। এমন ঘটনা শুধু বগুড়ার প্রতিবন্ধী কিশোরীর জন্য নয়, বরং ভুক্তভোগী বেশির ভাগ শিশুর জন্যই ঘটে থাকে বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও শিশু অধিকারকর্মীরা।

আইনজীবী এবং শিশু ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের মতে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপস-মিমাংসা করায়, সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় এবং অনেক মামলা থাকায় দীর্ঘসূত্রিতার জন্য বিচার পর্যন্ত যায় না।

বাড়ছে নির্যাতন: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৯৬৩ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার মনিটরিং থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এই হিসেবমতে প্রতি দিন তিন জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। আসকের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, গত বছর একই সময়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৬৩১টি। এক বছর ব্যবধানে শিশু নির্যাতন বাড়ে ৫২ শতাংশ। ২০২৫ সালের একই সময় ধর্ষণের শিকার হয় ৪৩২ জন শিশু, যা গত বছর ছিল ২৩৪ জন। এক বছর ব্যবধানে ধর্ষণ বাড়ে ৮৪ শতাংশ।

আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, 'আমরা মামলা করে শেষ পর্যন্ত যেতে পারি না। কারণ মামলা চলাকালীন মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। মেয়ের পূর্বের ঘটনা টেনে সংসারে বিপত্তি ডাকতে চান না বাবা-মা। জজকোর্টের আইনজীবী সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ভাড়া বাড়িতে থাকে বলে শিশু নির্যাতন করার পর বাড়ি বদল, সাক্ষী না পাওয়া এবং টাকার বদলে মামলা তুলে নেয় অভিভাবকরা। অনেক সময় মামলাও করে না।

শিশু যেসব নির্যাতনের শিকার হয় বেশি: সাধারণত দেখা যায় ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে। আসকের তথ্য মতে ২০২৫ সালের প্রথম ১১ মাসে ৩৮৭শিশু হত্যা করা হয়, মামলা হয় ২৯১টি। ছয় বছর বয়সের মধ্যে শিশু হত্যা করা হয় ৯২ জনকে। ১২ বছরের মধ্যে ৯১ শিশু হত্যার শিকার হয়। সবচেয়ে বেশি হত্যার শিকার হয় ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশু এই সংখ্যা ১৭৪ জন।

কেন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক রেজাউল করিম সোহাগ বলেন, সামাজিক বিছিন্নতা থেকে শিশুর ওপর নির্যাতন বাড়ছে। শিশুর জন্য পরিবারে এক রকম এবং পরিবারের বাইরে এক রকম বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। এখন মানুষ বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকার কারণে এক কেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে-যার ফলে তাদের মধ্যে হতাশা, রাগ ক্ষোভ বাড়ছে। এসব অস্বভাবিক অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ শিশুর ওপর চড়াও হচ্ছে, কখনো কখনো শিশু নিজেও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশুরা ঢাকায় আসে। তারা বিভিন্ন পেশায় যায়-এমন শিশুরা নির্যাতনে শিকার হয় বেশি। তারা ঘরে বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়, আবার নিজেও নির্যাতনকারী হয়ে পড়ে।

আমাদের বিচার করতে হবে জজকোর্টের আইনজীবী ও সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (সরকারি আইনজীবী) অ্যাডভোকেট ফোরকান মিয়া বলেন, এই ধরনের ঘটনাগুলো অনেক ক্ষেত্রে আপস-মিমাংসার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। সাক্ষী পাওয়া যায় না। কিন্তু বিচার পর্যন্ত আনা জরুরি।

ডব্লিইউডিডিএফের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি বলেন, ভুক্তভোগীকে যে কোনো মূল্যে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাদের নিয়ে কাজ করে তাদের সমন্বয় করতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লবি বিভাগের পরিচালক অ্যাডভোকেট দিপ্তী সিকদার বলেন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, এসিড নিক্ষেপ, বাল্যবিবাহ, শারীরিক নির্যাতন, সাইবার সহিংসতা প্রভৃতি নির্যাতনে আইনি সহায়তা দেয় মহিলা পরিষদ। তিনি বলেন, 'আমরা যেসব মামলা করি এবং সেগুলো শেষ পর্যন্ত যেতে পারে সেগুলোতে অপরাধী শাস্তি পায়। কিন্তু ভুক্তভোগীরা নিজেরা মামলা করলে তা শাস্তি পর্যন্ত যায় না বললেই চলে।